সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ
মতিউর রহমান চৌধুরী ♦
লণ্ডন, ১২ আগস্ট: ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আকস্মিক সরকার পতন। এর জেরে অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল নানা ক্ষেত্রে। নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর সেই অস্থিরতা কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। নিরাপত্তাসহ নানা কারণে মাঠে পুলিশ ছিল না গত কয়েক দিন। সড়কে ট্রাফিক ছিল না। প্রশাসনে অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল। নতুন সরকারের উদ্যোগে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া শুরু করেছে। দেশের প্রায় সব থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সড়ক নিরাপত্তায় ট্রাফিক সদস্যরা মাঠে নামছেন। দাবি পূরণের আশ্বাস পাওয়ায় পুলিশ সদস্যরা কর্মবিরতি প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন। প্রধান বিচারপতি নিয়োগের পর সোমবার থেকে সচল হয়েছে হাইকোর্ট। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিবর্তন করা হচ্ছে। আগের সরকারের সময়ে দায়িত্ব পাওয়া অনেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে চলে যাচ্ছেন। সরে দাঁড়িয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। নতুন গভর্নর নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা একের পর এক বৈঠক করছেন। সোমবার নিজের অধীনে থাকা মন্ত্রণালয়ের সচিবদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গেও তার বৈঠক হয়েছে।
- সংখ্যালঘু-বিষয়ক সংগঠিত অপরাধের অধিকাংশই রাজনীতি সংশ্লিষ্ট – সেনা প্রধান
- সেনাবাহিনীতেও গুরুত্বপূর্ণ পদে রদবদল, সরানো হয়েছে পুলিশ ও র্যাব প্রধানকে
- হাসিনার প্রতি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার গুরুত্বপূর্ণ বার্তা: গণ্ডগোল পাকিয়ে লাভ হবে না, লোকজন আবার ক্ষেপে উঠবে
- বিজয় আসলেও ষড়যন্ত্র থেমে নেই – বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ
- ছাত্র-জনতা এখনো রাজপথ ছাড়েনি
ছাত্র জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের অনেক জায়গায় হামলা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়িঘর ও প্রতিষ্ঠানে বেশিরভাগ হামলা হয়েছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনও আক্রান্ত হয়েছেন। নিরাপত্তার দাবিতে গত কয়েকদিন ধরে তারা বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে আসছেন। যদিও বিভিন্ন ফ্যাক্টচেকিং গ্রুপ এবং সংবাদ মাধ্যমের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার কারণে সংখ্যালঘুদের কেউ কেউ আক্রান্ত হয়েছেন। শুধু সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে নয়। এছাড়া সংখ্যালঘুদের উপর হামলা নিয়ে গুজব এবং ভুয়া তথ্য ছড়ানো হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। প্রতিবেশি দেশ ভারতে এ ধরনের প্রচারণা বেশি হচ্ছে।
এদিকে সোমবার খুলনায় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত ২০টি জেলায় ৩০টির মতো সংখ্যালঘু-বিষয়ক অপরাধ সংগঠিত হয়েছে। যার অধিকাংশই রাজনীতি সংশ্লিষ্ট। সেনাবাহিনী প্রধান খুলনা বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়ের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তিনি জানান, পুলিশ বাহিনী স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করলে ব্যারাকে ফিরে যাবে সেনাবাহিনী। ছাত্র জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগের অনেক মন্ত্রী-এমপি দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। দেশে যারা আছেন তারাও প্রকাশ্যে আসছেন না। দলের প্রধানকে দেশে আনার দাবিতে গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ করেছেন। মিছিল থেকে সেনাবাহিনীর সদস্যদের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। সেনাবাহিনীর গাড়িতে আগুন দেয়া হয়েছে। অবশ্য সেনা তৎপরতার পর সেখানেও এখন পরিস্থিতি শান্ত। ৫ই আগস্ট সরকার পতনের পর দলের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য-বিবৃতি দেননি কেউ। দলীয় কার্যালয় খোলার মতো অবস্থাও নেই।
এই প্রেক্ষাপটে আসছে ১৫ই আগস্ট নিয়ে কিছুটা উত্তাপ তৈরি হয়েছে। এদিন শোক দিবস উপলক্ষে নেতাকর্মীদের জড়ো হওয়ার বার্তা দেয়া হয়েছে এমন খবর এসেছে। যদিও মাঠের পরিস্থিতি আর আওয়ামী লীগের অনুকূলে নেই। ছাত্র-জনতা এখনো রাজপথ ছাড়েনি। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বলছেন, বিজয় আসলেও ষড়যন্ত্র থেমে নেই। প্রয়োজনে আবারো মাঠে নামা লাগতে পারে। প্রতিবিপ্লবের শঙ্কার কথা বলছেন রাজনৈতিক দলের নেতারাও। তারা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, এমন কোন চেষ্টা ছাত্র-জনতা রুখে দিতে প্রস্তুত আছে। ১৫ই আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। এবার এই দিবস কিভাবে পালিত হবে তা স্পষ্ট নয়। সূত্রের দাবি, দিবস পালনে সরকার কাউকে বাধা দেবে না। তবে এই দিবস ঘিরে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সুযোগ দেয়া হবে না। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার প্রতি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছেন। শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন, আপনি আসবেন, আপনার দেশ। আপনি আসেন না কেন? নাগরিকত্ব তো যায়নি। ২১ বছর প্রধানমন্ত্রিত্ব করেছেন। আপনি স্বেচ্ছায় চলে গেছেন, কেউ তো যেতে বলেননি। কিন্তু গণ্ডগোল পাকিয়ে কোনো লাভ হবে না। বরং লোকজন আবার ক্ষেপে উঠবে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দল পুনর্গঠন করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেছেন, এমন কিছু করবেন না যাতে আপনাদের জীবন বিপন্ন হয়। এই মুহূর্তে সরকারের সামনে বড় দুটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা এবং অর্থনীতি সামলানো। সরকারের উপদেষ্টারাও এই দুই খাতেই জোর দিচ্ছেন বেশি। দলীয় আবহে পরিচালিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এখন এর বাইরে এনে মানুষের সেবায় নিয়োজিত করার কাজটি খুবই কঠিন।
ইতোমধ্যে পুলিশ, র্যাব প্রধানকে সরিয়ে নতুন প্রধান করা হয়েছে। সেনাবাহিনীতেও গুরুত্বপূর্ণ পদে রদবদল করা হয়েছে। ডিজিএফআই’র প্রধানকে সরিয়ে নতুন প্রধান নিয়োগ দেয়া হয়েছে। পুলিশের পোশাক পরে যেসব কর্মকর্তা দলীয় ক্যাডারের ভূমিকায় অবর্তীর্ণ হয়েছিলেন তাদের অনেকে এখন লাপাত্তা। তারা কোথায় আছেন তাও স্পষ্ট নয়। অনেকে বলছেন, তারা হেফাজতে আছেন। আবার কেউ বলছেন আত্মগোপনে। তাদের যে আর বাহিনীতে ফেরা হচ্ছে না এটা এখন স্পষ্ট। এমন অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক করতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে নানবিধ চেষ্টা চালাতে হবে। সঙ্গে আন্দোলন করা ছাত্র জনতা এবং সাধারণ মানুষের সমর্থনও ধরে রাখতে হবে। সর্বশেষ সিপিডি সোমবার তথ্য দিয়েছে, গত ১৫ বছরে অন্তত ৯২ হাজার কোটি টাকা শুধু ব্যাংক খাতেই লুটপাট হয়েছে। পাচারের পরিমাণ আরো ঢের বেশি। রাজনৈতিক প্রভাব আর দখলে দেউলিয়া হওয়ার অবস্থা অনেক ব্যাংকে। ক্ষমতা বদলের পরও ব্যাংক দখলে মহড়া চালিয়েছে দুর্বৃত্ত চক্র। ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে থাকা এই খাতকে এখন দাঁড় করাতে হলে বহু ধরনের সংস্কারের প্রয়োজনের কথা বলছেন অর্থনীতিবিদরা।