৪ জুলাইর নির্বাচনে মুসলিম ভোটের নির্ধারক হবে গাজা ইস্যু
পত্রিকা প্রতিবেদন ♦
লণ্ডন, ১০ জুন: আগামী ৪ জুলাই অনুষ্ঠেয় পার্লামেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রার্থীতা দাখিল চূড়ান্ত হয়েছে। ৭ জুন চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হয়। লেবার দলীয় চার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপি এবার নিজ নিজ আসনে লেবার দলের প্রার্থী হয়েছেন। বরাবরের মত এবারও অন্যান্য দল থেকে এবং স্বতন্ত্র হিশেবে নির্বাচনে লড়ছেন অনেক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থী। তবে বিজয়ের সম্ভাবনার কারণে মূল কৌতূহলের কেন্দ্রে থাকবেন ওই চার কন্যাই। টানা ১৪ বছর ধরে ক্ষমতায় রয়েছে কনজারভেটিভ পার্টি। অর্থনীতি, এএইচএস, ইমিগ্রেশনসহ নানা ইস্যুতে দলটি জনগণের আস্থা হারিয়েছে বলে প্রতীয়মান। তার ওপর ভারতীয় বংশোদ্ভূত কনজারভেটিভ নেতা ঋষি সুনাক জনগণের ভোটে নির্বাচিত নন। অশ্বেতাঙ্গ সুনাকের নেতৃত্ব নিয়ে খোদ কনজারভেটিভ দলের তৃণমূল সদস্যদের মধ্যে নানা অসন্তোষ আছে তা লক্ষ্যণীয়।
সাম্প্রতিক বিভিন্ন জনমত জরিপ বলছে, জনপ্রিয়তায় লেবার দলের চাইতে ২০ পয়েন্ট পিছিয়ে আছে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভরা। এ অবস্থায় অনেকটা নিশ্চিতভাবে ধরে নেয়া হচ্ছে যে, এবারের নির্বাচনে লেবার দল ক্ষমতায় ফিরবে। কিন্তু লেবারের এমন নিশ্চিত জয়যাত্রায় বাগড়া দিয়ে বসেছে দখলদার ইসরায়েল রাষ্ট্র কর্তৃক ফিলিস্তিনিদের ওপর চলমান গণহত্যা। লেবার নেতা কিয়ার স্টারমার শুরু থেকে ইসরায়েলের প্রতি একান্ত অনুগত বলে প্রমাণ দিয়েছেন। ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি হামলাকেও প্রকাশে জোর গলায় সমর্থন দিয়েছেন বার বার। এ অবস্থায় লেবারের নিবেদিত ভোটার হিসেবে চিহ্নিত মুসলিমরা এবার বিগড়ে গেছেন। দেশব্যাপী মুসলিম ভোটারদের কাছে গাজার গণহত্যা এবার সবচেয়ে বেশি বড় ইস্যু। বিভিন্ন আসনে লেবারের বিপরীতে গণহত্যাবিরোধী প্রার্থী নির্বাচন করছেন। মুসলিমদের এমন বিদ্রোহের কারণে বেশকিছু আসনে লেবার পার্টি বড় রকমের ধাক্কা খেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অবশ্য শুধু মুসলিম ভোট নয়, মানবতাবাদী ব্রিটিশ জনগণের একটি অংশও ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে প্রধান দুটি দলের অবস্থানে হতাশ এবং ক্ষুব্ধ।
গাজা ইস্যুতে সবচেয়ে বেশি নাটকীয় অবস্থায় রয়েছে পূর্ব লণ্ডনের বেথনাল গ্রিন এণ্ড স্টেপনি আসন। এখানকার লেবার দলীয় এমপি রুশনারার বিরুদ্ধে জোর প্রচারণায় নেমেছে গাজায় গণহত্যা বিরোধীরা। গাজায় যুদ্ধ বন্ধে পার্লামেন্টে উত্থাপিত প্রস্তাবের পক্ষে ১২৫ জন এমপি ভোট দিলেও এই ইস্যুতে রুশনারার বিরত থাকার বিষয়টি মোটেও ভালোভাবে নেননি এলাকার জনগণ। এনিয়ে চাপে আছে রুশনারা শিবির। এছাড়া বাউণ্ডারি পরিবর্তনের ফলে তাঁর আসনে লেবার পার্টির নিশ্চিত বেশ কিছু ভোট চলে গেছে নতুন সৃষ্ট স্ট্রাটফোর্ড এণ্ড বো আসনে। আর শেডওয়েলের যে অংশ তাঁর আসনে নতুন করে এবার অন্তর্ভূক্ত হয়েছে সেই এলাকায় লেবার পার্টির একচেটিয়া সমর্থন নেই। সব মিলিয়ে রুশনারার জন্য এবার জয়ের পথটি খুব সহজ হবে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। টাওয়ার হ্যামলেটসের বেথনাল গ্রিন এণ্ড স্টেপনি আসনে মোট প্রার্থী ১১ জন। এর মধ্যে বিভিন্ন দলের ৭ প্রার্থীর পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন ৪ জন। বেথনাল গ্রিন এণ্ড স্টেপনি আসনের প্রার্থীরা হলেন- লেবার দলের রুশনারা আলী, কনজারভেটিভ দলের ওস্কার রেনি, লিবারেল ডেমোক্রেট দলের রাবিনা খান, গ্রীন পার্টির ফোব গিল, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির জন ম্যবাট, রিফর্ম ইউকের পিটার সিটস, অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার পার্টির ভ্যানেসা হাডসন। এছাড়া চার স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেন- আজমাল মাশরুর, রেগি এডামস, মো: সুমন আহমদ ও শাম উদ্দিন।
এ আসনে ২০১০ সাল থেকে একটানা এমপি আছেন লেবার দলের রুশানারা আলী। লেবারের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এই আসনটি বাংলাদেশি অধ্যুষিত। কিন্তু গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতা ও এতে লেবার দলের সমর্থন নিয়ে এবার লেবারের বিরুদ্ধে জোর ক্যাম্পেইন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। টাওয়ার হ্যামলেটস কমিউনিটি কোয়ালিশন নামে একটি গ্রুপ আজমাল মাশরুরকে গাজার গণহত্যাবিরোধী প্রার্থী হিসেবে সমর্থন দিয়েছে। বর্ণবাদ বিরোধী বলিষ্ঠ বামপন্থী নেতা জর্জ গ্যালওয়ের ওয়ারকার্স পার্টিও আজমাল মাশরুরের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেছে। অন্যদিকে বিভিন্ন দল পাড়ি দিয়ে বর্তমানে লিবডেমে থিতু হওয়া রাবিনা খানও গাজার পক্ষের প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ আসনে এবার রুশনারা, আজমল ও রাবিনার ত্রিমুখী লড়াই দেখতে পারে ব্রিটেনবাসী।
টাওয়ার হ্যামলেটসের পপলার এণ্ড লাইম হাউস আসনে একজন স্বতন্ত্রসহ মোট ৮ জন প্রার্থী হয়েছেন। এরা হলেন- লেবার দলীয় বর্তমান এমপি আফসানা বেগম, কনজারভেটিভ পার্টির ফ্রেডি ডাউনিং, লিবারেল ডেমোক্র্যাট দলের রিচার্ড ফ্লাওয়ার্স, গ্রিন পার্টির নাটালি বিইনফেইট, রিফর্ম ইউকের টনি গ্লোভার, ওয়ার্কার্স পার্টি অব ব্রিটেইনের কামরান খান, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ম্যানি লওয়াল এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী এহতেশামুল হক। এ আসনটিও বাংলাদেশি অধ্যুষিত। লেবার দলের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এ আসনটি এবার বেশ আগে থেকে আলোচনায়। যুদ্ধবাজ ব্লেয়ারপন্থী ও দখলদার ইসরায়েল রাষ্ট্রের শুভাকাঙক্ষী হিসেবে পরিচিত কিয়ার স্টার লেবার নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে পপলার এণ্ড লাইম হাউসের এমপি আপসানা বেগম নিজ দলেই অনেকটা কোনাঠাসা হয়ে পড়েন। কারণ তিনি লেবার দলের সাবেক নেতা জেরেমি করবিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। তাকে ফাঁসাতে স্থানীয় মেয়র জন বিগসও জনগণের লক্ষ পাউণ্ড অপচয় করে আপসানার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করেছিলেন। আপসানা সেই মামলায় নির্দোষ প্রমাণিত হন। এরপর আপসানা বেগমকে সরিয়ে নতুন প্রার্থী বাছাইয়ে অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিলো লেবার পার্টি। কিন্তু গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকার পাশাপাশি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার আদায় এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে সংগ্রাম করে যান আপসানা বেগম। পার্লামেন্টের ভেতরে-বাইরে তাঁর এই বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে তাঁর বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট। এ আসনে শেষ পর্যন্ত নতুন করে প্রার্থী বাছাই ছাড়াই লেবার দল আপনাসাকে মনোনয়ন দিয়েছে। গাজায় গণহত্যার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়ার কারণে এবার আপসানার জয় অনেকটা সহজ হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এদিকে বাউণ্ডারি পরিবর্তনের ফলে পূর্ব লণ্ডনে নতুন সৃষ্ট স্ট্রাটফোর্ড এণ্ড বো আসনে প্রার্থী হয়েছেন ১০ জন। এরমধ্যে ৪ জন স্বতন্ত্র। বাকীরা বিভিন্ন দলের প্রার্থী। দলীয় প্রার্থীদের মধ্যে আছেন- লেবার দলের উমা কুমারান, কনজারভেটিভ দলের কেউন ব্ল্যাকওয়েল, লিবারেল ডেমোক্র্যাট দলের জেনি লিটল, গ্রিন পার্টির জো হাডসন স্মল, ওয়ার্কার্স পার্টি অব ব্রিটেইনের হালিমা খান, রিফর্ম ইউকের জেফ ইভান্স। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা হলেন- গাজার গণহত্যাবিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলনের আলোচিত কমিউনিস্ট নেতা ফিয়োনা লালী, টাওয়ার হ্যামলেটস কমিউনিটি কোয়ালিশন সমর্থিত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থী ওমর ফারুক, স্টিভ হেডলি ও নিজাম আলী।
বাউণ্ডারি পরিবর্তনের ফলে টিউলিপ সিদ্দিকের আসনের আসনও এবার পরিবর্তন হয়েছে। তিনি এবার হ্যামস্টেড এণ্ড হাইগেট আসনের প্রার্থী। এ আসনে এবার প্রার্থী হয়েছেন মোট ৭ জন। এরা হলেন- লেবার দলের টিউলিপ সিদ্দিক, কনজারভেটিভ দলের ডন উইলিয়ামস, লিবারেল ডেমোক্র্যাট দলের স্কট এমেরি, গ্রিন পার্টির লরনা রাসেল, রিফর্ম ইউকে পার্টির ক্যাথেরিন বেকার, রিজয়েন ইইউ পার্টির ক্রিস্টি এল্যান- কেইন এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী জনাথন লিভিংস্টোন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোনের মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক লেবার দলীয় এমপি হিসেবে পুনরায় নির্বাচন করছেন। তাঁর আসনের নাম ছিলো হ্যামস্টেড এণ্ড কিলবার্ন। টিউলিপের আসনে মুসলিম ভোটের সংখ্যা তুলনামূলক কম হওয়ার গাজা ইস্যু নিয়ে খুব একটা উদ্বেগ সেখানে নেই।
বাঙালি আরেক কন্যা রুপা হক এবারও ইলিং সেন্ট্রাল এণ্ড একটন আসনে লেবার দলের প্রার্থী হয়েছেন। এ আসনে মোট প্রার্থী এবার ৮ জন। এরা হলেন- লেবার দলের রুপা হক, কনজারভেটিভ দলের জেমস উইণ্ডসর-ক্লাইভস, লিবারেল ডেমোক্র্যাট দলের অ্যালাস্টেয়ার মিটন, গ্রিন পার্টির কেইট ক্রসল্যাণ্ড, ওয়ার্কাস পার্টির নাডা জার্সে, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির স্টিফেন বালোগ, রিফর্ম ইউকের ফেলিক্স ওরেল, এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী জুলি কার্টার।
নির্বাচনকে সামনে রেখে ভোটার হিশেবে নাম নিবন্ধনের শেষ তারিখ ১৮ জুন। পোস্টাল ব্যালটের জন্য আবেদন করা যাবে ১৯ জুন পর্যন্ত। আর প্রক্সি ভোটের জন্য আবেদনের শেষ তারিখ ২৬ জুন। ৪ জুলাই সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।