লণ্ডনে সিপিবি’র জনসভায় মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
সারওয়ার-ই আলম ♦
লণ্ডন, ৪ এপ্রিল: বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)-এর প্রাক্তন সভাপতি ও বর্তমান সদস্য মুক্তিযোদ্ধা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ও সম্ভাবনাকে পদদলিত করে উল্টো পথে চলছে বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শ্রেণি চরিত্রে আজ আর মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। দুটি দলই আজ লুটেরা ও ধনিক শ্রেণির দলে পরিণত হয়েছে। তিনি গত পহেলা এপ্রিল সোমবার লণ্ডনের মাইক্রো বিজনেস সেন্টারে কমিউনিস্ট পার্টি যুক্তরাজ্য ও ইউরোপ কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত জনসভায় একথা বলেন।
দেশে বর্তমানে দ্রব্যমূল্য যেভাবে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে সিণ্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে, সে অবস্থা থেকে রক্ষা পাওয়ার স্থায়ী ও নির্ভরযোগ্য উপায় কী হতে পারে সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, টেকসই সমাধান হলো মু্ক্ত বাজার অর্থনীতি থেকে বের হওয়া। মু্ক্ত বাজার অর্থনীতি থেকে বের হয়ে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় উৎপাদন ও ক্রেতা সমবায় পদ্ধতি চালু করা। একইসঙ্গে সম্পদের বণ্টন করতে হবে ধনিক শ্রেণি থেকে দরিদ্র শ্রেণির দিকে, দরিদ্র শ্রেণি থেকে ধনিক শ্রেণির দিকে নয়। এই দুটি কাজ যতদিনে করা না যাবে ততদিনে শুধু সরকার পরিবর্তন করে অর্থনীতিতে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে না। মোদ্দা কথা হলো ‘সিস্টেম’-এ পরিবর্তন আনতে হবে। ‘সিস্টেম’-এ পরিবর্তন না আনলে জনগণের কাঙ্খিত মুক্তি কখনোই অর্জিত হবে না। ধনিক শ্রেণি আরও ধনি হবে, দরিদ্র শ্রেণি আরও দরিদ্র হবে।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমালোচনা করে জনাব সেলিম বলেন, এ দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। দুটি দলই লুটেরা ও ধনিক শ্রেণির ওপর নির্ভর করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। ক্ষমতায় থাকার জন্য তারা হেলমেট বাহিনী, হোণ্ডা বাহিনী, গুণ্ডা বাহিনী তৈরি করে।
তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগের শ্রেণি চরিত্র একেবারে বদলে গেছে। একটা সময় ছিল যখন এই দলটি ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির দল। আর এখন দলটির নেতৃত্ব কোটিপতিদের দখলে। আওয়ামী লীগ আজ ধনিক শ্রেণির দলে পরিণত হয়েছে।
জনাব সেলিম বলেন, বাংলাদেশে আজ সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা হলো মন্ত্রীগিরি, এমপিগিরির ব্যবসা। গত পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, এমপিদের অনেকেরই সম্পদের পরিমাণ কমপক্ষে পঞ্চাশ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারী হিসেবে গত ১৬ বছরে দেশ থেকে পাচার হয়েছে ১১ লক্ষ কোটি টাকা। এই টাকা শ্রমিকদের হাতে গেলে তারা বিদেশে পাচার করত না, দেশে বিনিয়োগ করত।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সরকারের মধ্যে একটা চরিত্রগত মিল হলো তারা তারা উন্নয়নের গল্প শুনিয়ে মানুষকে ভুলিয়ে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে চায়। কিন্তু ইতিহাস বলে এভাবে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। আইয়ুব খানও উন্নয়নের গল্প শুনিয়ে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিলেন। এরশাদও একই কাজ করেছেন। তারা কেউই থাকতে পারেননি।
জনাব সেলিম আরও বলেন, আওয়ামীলীগ আজ রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে থাকার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে চলেছে। তারা বলছে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে ক্ষমতায় একই দলের ধারাবাহিকতা অপরিহার্য। এভাবে তারা নিজেদের শাসনকে বৈধতা দিচ্ছে। কিন্তু ইতিহাস বলে কোনো দল রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে সরকারে টিকে থাকতে চাইলে সেই সরকারে ফ্যাসিজম জন্ম নিতে বাধ্য। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে বর্তমান বাংলাদেশে তাই হচ্ছে। ফ্যাসিজম জন্ম নিচ্ছে।
জনাব সেলিম বলেন, সরকার জনগণকে ভুলিয়ে রাখার জন্যও পদ্মা সেতুর কথা বলে, মেট্রোরেলের কথা বলে। কিন্তু তারা এটা জানে না যে নির্মাণের বিশালতা দিয়ে উন্নয়ন পরিমাপ করা যায় না। উন্নয়ন পরিমাপ করতে হয়— এই উন্নয়ন কার স্বার্থে হচ্ছে এবং কার টাকায় হচ্ছে তার মাধ্যমে।
বামপন্থী রাজনীতির ভবিষ্যত সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে জনাব সেলিম বলেন, ইদানিং একটি প্রশ্ন প্রায় শোনা যায়, তাহলো- বাম পন্থার কোনো ভবিষ্যত আছে কি না। এর জবাবে আমি বলব, বামপন্থার যদি কোনো ভবিষ্যত না থেকে থাকে তাহলে ভবিষ্যতেরও কোনো ভবিষ্যত নেই। বাম পন্থার যদি কোনো ভবিষ্যত না থেকে থাকে তাহলে বাংলাদেশের বাস্তবতায় দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বেরও কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।
কমিউনিস্ট পার্টি যুক্তরাজ্য ও ইউরোপ কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত এ জনসভায় সভাপতিত্ব করেন আবেদ আলী আবিদ। পার্টির যুক্তরাজ্য ইউরোপ কমিটির সহ সাধারণ সম্পাদক শাহরিয়ার বিন আলীর পরিচালনায় সভার শুরুতে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানান পার্টির যুক্তরাজ্য কমিটির সদস্য জুবের আক্তার সোহেল। এ সময় উপস্থিত ছিলেন পার্টির যুক্তরাজ্য ও ইউরোপ কমিটির সাধারণ সম্পাদক নিসার আহমেদ।
শুরুতে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মানব মুক্তির লড়াইয়ে নিহত হওয়ার সকল মুক্তিকামী মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
এরপর কমিউনিস্ট পার্টি অব ব্রিটেনের কো-অর্ডিনেশন কমিটির চেয়ারম্যান এবং টুডে পার্টি অফ ইরান এর নেতা নাবিদ সোমালির শুভেচ্ছা বার্তা পাঠ করেন পার্টির যুক্তরাজ্য ও ইউরোপ কমিটির সদস্য ডাক্তার সেলিম ভূঁইয়া।
শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন কমিউনিস্ট পার্টি অব ব্রিটেনের চেয়ারপারসন রুথ স্টাইলস, রেলওয়ে মেরিটাইম এবং পরিবহন ইউনিয়নের সভাপতি ও ট্রেড ইউনিয়নিস্ট আলেক্স গর্ডন। এছাড়া সভায় শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ডাক্তার রফিকুল হাসান খান জিন্নাহ, ডলি ইসলাম, ডাক্তার মোখলেসুর রহমান, বাম গণতান্ত্রিক জোট যুক্তরাজ্যের সমন্বয়ক বাবলু খন্দকার, বাংলাদেশী ওয়ারকার্স কাউন্সিল (বিডব্লিউসি’র) সহ সভাপতি জাহানারা রহমান জলি, কমিউনিস্ট পার্টির প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক আবু জাফর আহমেদের ভাই পরিবেশবাদী কর্মী ও সলিসিটর ইকবাল আহমেদ, বাসদ মার্কসবাদী যুক্তরাজ্যের অন্যতম নেতা মোস্তফা ফারুক, ফ্রেন্ডস অব ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক গোলাম আকবর মুক্তা, সত্যেনসেন স্কুল অফ পারফর্মিং আর্টস এর পক্ষে শেখ নুরুল ইসলাম, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী যুক্তরাজ্যের সাধারণ সম্পাদক জুবের আক্তার সোহেল, পার্টির সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য ইফতেখারুল হক পপলু প্রমুখ। সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের কাছে সম্মাননা ক্রেস্ট হস্তান্তর করেন সলিসিটর ইকবাল আহমদ।
বক্তাদের অনেকের বক্তব্যে ওঠে আসে বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার তাগিদে মেহনতি মানুষের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি। বক্তাদের অনেকে প্যালেস্টাইনে ইসরায়েলি গণহত্যার তীব্র নিন্দা করেন।