ইংল্যাণ্ডে সাধারণত যেসব ক্যান্সারে মানুষ আক্রান্ত হয়ে থাকেন তার মধ্যে অন্ত্রের (বাওয়েল) ক্যান্সার হচ্ছে তৃতীয়। ডা. বলা ওউলাবি একজন জিপি এবং এনএইচএস ইংল্যাণ্ডের হেলথ ইনইকুয়েলিটিজ ইমপ্রুভমেন্ট ডাইরেক্টর। তিনি বলছেন, “এই ক্যান্সারে যে কেউ যে কোনও বয়সে আক্রান্ত হতে পারেন। কারো কারো বেলায় এই ক্যান্সার হবার ঝুঁকি বেশী এবং জীবন বাঁচাতে মূল কাজটা হচ্ছে আগেভাগেই রোগটা সনাক্ত করা।”
ডা. বলা বলেন, “স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বৈষম্য কমাতে আমাদের কাজের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হচ্ছে- আরো বেশী মানুষকে শুরুর দিকে তাদের ক্যান্সার রোগ সনাক্তের ব্যাপারে সমর্থ করে তোলা। তখন এটি কম আগ্রাসী থাকে এবং চিকিৎসা বেশী সফল হয়।”
“দুইভাবে এটি করা যায়। প্রথমত: এনএইচএস-এর অন্ত্রের (বাওয়েল) ক্যান্সার স্ক্রিনিং-এর আমন্ত্রণ পেলে তাতে অংশ নিয়ে। আর অন্যটি হচ্ছে আপনার কোন শারীরিক পরিবর্তন নজরে এলে আপনার জিপি প্র্যাক্টিসের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে। ক্যান্সার শুরুর দিকে সনাক্ত করা গেলে তা চিকিৎসার মাধ্যমে সারিয়ে তোলার সম্ভাবনা অনেক বেশী থাকে।
অন্ত্রের ক্যান্সার কী?
বৃহদন্ত্র আমাদের পরিপাকতন্ত্রের (পাচন ব্যবস্থা) একটি অংশ যা আমাদের খাবার থেকে পানি শোষণে সাহায্য করে এবং আমাদের শরীর থেকে খাদ্যের বর্জ্য অপসারণ করে। এই ক্যান্সার মলাশয় ও মলদ্বারসহ বৃহদন্ত্রের যে কোনও অংশে বেড়ে উঠতে পারে। এটি তখনই হয় যখন কোষের বৃদ্ধি ঘটে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে এবং তা টিউমার সৃষ্টি হয়। কখনো কখনো ক্যান্সারসৃষ্ট এই টিউমার থেকে কোষগুলো শরীরের অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে পড়ে। তখন সফলভাবে রোগের চিকিৎসা কঠিনতর হয়ে পড়ে।
অন্ত্রের ক্যান্সারের চিহ্ন আপনি নিজে দেখার বা এর কোনো লক্ষণ আপনার নজরে আসার আগেই স্ক্রীনিং-এর মাধ্যমে এটি শুরুর দিকেই ধরা পড়ে। এ ব্যাপারে আরো তথ্য নীচে দেখুন। আপনি যদি এর কোনো চিহ্ন দেখেন বা কোনো লক্ষণ আপনার নজরে আসে তাহলে আপনার জন্য স্ক্রীনিং নয়। তাই স্ক্রীনিং-এর জন্য ডাক পাবার অপেক্ষা করবেন না। তখন গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে- আপনার জিপি প্র্যাক্টিসের সাথে যোগাযোগ করে তা পরীক্ষা করানো।
অন্ত্রের ক্যান্সার সবসময় সুস্পষ্ট নয়
ডা. আনিসা প্যাটেল একজন জিপি। তিনি বলেন, “এটি আতঙ্কজনক যে, যুক্তরাজ্যে ক্যান্সারে যত মানুষের মৃত্যু ঘটে তার মধ্যে অন্ত্রের (বাওয়েল) ক্যান্সার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের মৃত্যুর কারণ। ৩৯ বছর বয়সে স্টেইজ-৩ অন্ত্রের ক্যান্সার ধরা পড়াটা আমার জন্য আসলেই ছিলো একটা ধাক্কা। কারণ, আমি পুরোপুরি সুস্থ ও সবল। আমার পরিবারে অন্ত্রের ক্যান্সারের কোন ইতিহাস নেই।”
“২০১৮ সালের জানুয়ারীতে আমার কিছু প্রাথমিক উপসর্গ দেখা দেয়। আমি খুব ক্লান্তি বোধ করছিলাম। একজন জিপি হিশেবে ব্যস্ততার পাশাপাশি আমার ৫ ও ৬ বছরের দুই শিশু সন্তানের লালন-পালনে আমাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হতো।
“আমি ভেবেছিলাম এটি ‘ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম’ (আইবিএস)। কারণ, আমার কোষ্ঠকাঠিন্য বেড়ে গিয়েছিলো। সেইসাথে যখন টয়লেট পেপারে অল্প পরিমাণে রক্ত নজরে আসে তখন মনে করেছি এটি হয়তো পাইলসের কারণে হচ্ছে।”
“উপসর্গ শুরুর পর আমি জিপির সাথে দেখা করেছি। কিন্তু আমার রক্তপরীক্ষার ফলাফলে কোনো সমস্যা ধরা পড়েনি।”
“সময়ের সাথে সাথে উপসর্গগুলো খারাপ হতে শুরু করলো। আমার ঘন ঘন এবং জরুরীভাবে টয়লেটে যাওয়ার দরকার হয়ে পড়লো এবং পেটব্যাথা শুরু হলো। এছাড়া লক্ষ্য করলাম, আমার মলের আকার বদলে তা ফিতার মতো চ্যাপ্টা হয়ে গেছে।”
“টয়লেটে যাওয়ার অভ্যাস সম্পর্কে কথা বলাটা কঠিন মনে হতে পারে। কিন্তু আমি বিষয়টি নিয়ে আমার স্বামীর সাথে কথা বললাম। তিনি একজন বাওয়েল ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট (পরিপাকতন্ত্রের ডাক্তার)। এরপর আবার জিপির কাছে যাওয়ার ব্যাপারে আমরা দুজনেই সম্মত হলাম।”
“তখন পর্যন্ত অনেকের মতোই আমিও আমার এই উপসর্গগুলো অন্যান্য সম্ভাব্য কারণে সৃষ্ট বলে ধরে নিয়েছিলাম। কিন্তু এবার রক্তপরীক্ষার ফলাফল স্বাভাবিক না আসায় জিপি আমাকে পরবর্তী পরীক্ষা-নীরিক্ষার জন্য পাঠালেন এবং আমার বাওয়েল ক্যান্সার ধরা পড়লো।”
“আমাকে হতাশা গ্রাস করলো। আমি বিচলিত এবং দিশাহীন হয়ে পড়েছিলাম। অনেক সময়ে এতো মন খারাপ, রাগান্বিত এবং বিরক্ত বোধ হতো যে নিজেকে প্রবোধ বা সান্তনা দিতে পারতাম না। ক্যান্সারযুক্ত টিউমার অপসারণের জন্য অপারেশন করতে গিয়ে আমি ভয় পেয়েছিলাম। আমি জানতাম না জ্ঞান ফিরে পাবার পর কি শুনবো। ক্যান্সার কি চলে যাবে, আমার কি কেমো-রেডিওথেরাপির প্রয়োজন হবে- এসব প্রশ্ন মনে ঘুরছিলো।”
“সৌভাগ্যক্রমে, আমার টিউমার সম্পূর্ণভাবে অপসারণ করা হয়েছিল এবং ক্যান্সার ফিরে আসার ঝুঁকি কমাতে আমার তিন মাস কেমোথেরাপি নিতে হয়েছিল।
অন্ত্রের (বাওয়েল) ক্যান্সারের উপসর্গগুলি কি কী?
• মলের পরিবর্তন, যেমন নরম মল, ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য
• কমবেশি প্রায়শই টয়লেটে যেতে হয়
• মলের মধ্যে রক্ত, যা লাল বা কালো রঙের হতে পারে
• মলদ্বার থেকে রক্তপাত
• প্রায়শই মনে হয় আপনার টয়লেটে যেতে হবে,
এমনকি যদি আপনি এইমাত্র টয়লেট থেকে এসেও থাকেন
• পেট ব্যথা এবং/অথবা ফোলা
• চেষ্টা না করেই ওজন কমে যাওয়া
• অকারণে খুব ক্লান্তি বোধ করা
যুক্তরাজ্যে প্রতি বছর প্রায় ৪২,৯০০টি নতুন অন্ত্রের ক্যান্সার ধরা পড়ে, যার মধ্যে বেশিরভাগ ব্যক্তির বয়স ৫০ বছরের বেশি হলেও এর মধ্যে বাওয়েল ক্যান্সার ইউকে-এর হিসাবমতে, ডা. প্যাটেলের মতো ২,৬০০ জনের বয়স ৫০ বছরের কম।
ডা. ওউলাবি বলছেন, “যদি আপনার মল কালো বা গাঢ় লাল হয় বা আপনার ডায়রিয়ার সাথে রক্ত যায়, তাহলে জিপির সাথে একটি জরুরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক করুন বা NHS-এ 111 নম্বরে ফ্রি ফোন করুন।”
“যদি আপনার মলদ্বার থেকে অবিরাম রক্তপাত হয় বা টয়লেটে প্রচুর রক্ত থাকে (যেমন পানি লাল হয়ে যায় বা আপনি বড় আকারের জমাট রক্ত দেখতে পান), তাহলে আপনাকে A&E-তে যেতে হবে বা 999 নম্বরে ফোন করতে হবে।”
কারো উদ্বেগজনক কোন উপসর্গ থাকলে তাদেরকে ডাক্তারের সাথে কথা বলতে বিব্রত বোধ না করার অনুরোধ জানিয়েছেন ডা. প্যাটেল এবং ডা. ওউলাবি।
ডা. ওউলাবি বলেছেন, “আপনি যদি আপনার উদ্বেগ সম্পর্কে কিংবা টয়লেট হওয়া বা না হওয়া নিয়ে কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করেন, দয়া করে মনে রাখবেন আমরা শরীরের সকল অংশ পরীক্ষা করতে অভ্যস্ত এবং এই জাতীয় বিষয়ে কথাবার্তা আমরা সবসময় সব সময়ই শুনে থাকি।”
ডা. প্যাটেল আরো বলেন, “আপনি যদি মনে করেন যে কোনো কিছু সঠিক বোধ হচ্ছে না তবে দয়া করে আমাদের দেখাতে আসুন। আর আপনার উপসর্গ যদি তিন সপ্তাহ বা তার বেশি সময় ধরে থাকে তবে আপনার জিপির সাথে যোগাযোগ করা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এটি ক্যান্সার না-ও হতে পারে- তবে যদি তা হয়েই থাকে তাহলে আগেভাগে সনাক্ত করা গেলে সেটি হবে অধিক চিকিৎসাযোগ্য। আর ডাক্তার দেখানোর পরও যদি আমার মতো আপনারও উপসর্গ থেকে থাকে, তাহলে দয়া করে আবার জিপির কাছে যান।”
অন্ত্রের (বাওয়েল) ক্যান্সার স্ক্রীনিং করাতে বিলম্ব করবেন না
৫৬-৭৪ বছর বয়সী এবং বেশীরভাগ ৫৪ বছর বয়সী ব্যক্তিদেরকে প্রতি দুই বছর অন্তর অন্তর এনএইচএস (NHS)-এর বাওয়েল ক্যান্সার স্ক্রীনিং কর্মসূচীতে অংশ নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। এক্ষেত্রে ঘরে বসে করা পরীক্ষা যায় এমন সরঞ্জাম (হোম টেস্টিং কিট) যার নাম Faecal Immunochemical Test (বা সংক্ষেপে ‘FIT kit’) ব্যবহার করা হয়। এই কর্মসূচী এখন ৫০ উর্ধ বয়সীদের জন্যও সম্প্রসারিত করা হচ্ছে। ফলে আপনি ৫৬ বছর পূর্ণ করার আগেই এ পরীক্ষার সুযোগ পেতে পারেন। ৭৫ বছর এবং তদুর্ধ বয়সীরা এই ‘FIT kit’ ০৮০০ ৭০৭ ৬০ ৬০ নম্বরে ফোন করে পেতে পারেন।
প্রতি দুই বছরে একবার বাড়িতে এই সরঞ্জাম (‘FIT kit’ ) পাঠানো হয়। নিজের বাড়ির একান্ত পরিবেশে মলের একটি ছোট নমুনা নিয়ে সেটি সিল করা বোতলে ভরে সাথে দেয়া খামে করে ফেরত পাঠাতে হয়। এজন্য কোন ডাকমাশুল (স্ট্যাম্প) লাগবে না। খালি চোখে দেখা যায় না এমন রক্তের ক্ষুদ্র চিহ্ন যা ক্যান্সারের সম্ভাব্য লক্ষণ হতে পারে সেটি মলের মধ্যে আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা হয়। মলে রক্তের উপস্থিতির অর্থ এই নয় যে, আপনার অন্ত্রের ক্যান্সার হয়েছে। তবে তখন সাধারণত আরো কিছু পরবর্তী পরীক্ষা-নীরিক্ষার পরামর্শ দেওয়া হয়।
ডা. প্যাটেল বলেন: “যদি আপনি বা আপনার পরিবারের কেউ ডাকযোগে পরীক্ষার সরঞ্জাম (কিট) পান, তাহলে আপনার কাছে আমার অনুরোধ থাকবে – দয়া করে এটি ফেলে রাখবেন না। এই কাজে মাত্র কয়েক মুহূর্ত সময় লাগে কিন্তু আপনার কোনো সুস্পষ্ট লক্ষণ না থাকলেও এটি ক্যান্সার থাকলে তা সনাক্ত করতে সাহায্য করতে পারে।”
এক হিসাব মতে, বাওয়েল ক্যান্সার স্ক্রীনিং সরঞ্জাম (কিট) ব্যবহারকারী প্রায় ৯৮ শতাংশের আর পরবর্তী পরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে না। বাকী ২ শতাংশকে আরও পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে যেতে বলা হয়। পরবর্তী আরও পরীক্ষা-নীরিক্ষার জন্য যারা হাসপাতালে যান তাদের ১০০ জনের মধ্যে প্রায় ৯ জনের ক্যান্সার সনাক্ত হয়। এছাড়া ৫৫ শতাংশের হাসপাতালে পরীক্ষা-নীরিক্ষার প্রক্রিয়া চলাকালীন পলিপ পাওয়া যায়।
ডা. ওউলাবি বলেন, “পলিপ ক্যান্সার নয়, তবে সময়ের সাথে সাথে তা ক্যান্সারে পরিণত হতে পারে। আপনার পলিপ থাকলে সেটি সহজেই অপসারণ করা যেতে পারে ।”
“প্রাথমিক অবস্থায় অন্ত্রের ক্যান্সার নির্ণয় করা গেলে এটি চিকিৎসাযোগ্য এবং নিরাময়যোগ্য হতে পারে। ‘FIT kit’ সরঞ্জামটি সত্যিই আপনার জীবন বাঁচাতে পারে।”
এনএইচএস (NHS) বাওয়েল ক্যান্সার স্ক্রীনিং পরীক্ষা সম্পন্ন করার পর যদি উপরে উল্লিখিত কোনো উপসর্গ আপনার দেখা দেয় তাহলে আবার পরীক্ষা করিয়ে নিন।
অন্ত্রের (বাওয়েল) ক্যান্সার এবং অন্ত্রের (বাওয়েল) ক্যান্সার স্ক্রীনিং সম্পর্কে আরো তথ্য পাওয়া যাবে অনলাইনে www.nhs.uk/conditions/bowel-cancer-screening ঠিকানায়।
অন্ত্রের ক্যান্সার সম্পর্কে আমাদের কথা বলা দরকার
অন্ত্রের ক্যান্সার সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে এবং এই ক্যান্সারকে ঘিরে থাকা সংস্কার দূর করতে সাহায্য করার জন্য ডা. প্যাটেল অব্যাহতভাবে তাঁর কাহিনীটি অন্যদের সাথে ভাগাভাগি (শেয়ার) করে যাচ্ছেন। ডা. প্যাটেল বলেন, “আমার জিপি, ডাক্তার, বিশেষজ্ঞ, নার্স, অনলাইন সহায়ক গোষ্ঠী এবং আমার পরিবার ও বন্ধুদের নেটওয়ার্কের সহায়তায় আমি এই নেতিবাচক পরিস্থিতিটিকে ইতিবাচক রূপে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।
আপনার যদি কোন উপসর্গ দেখা দেয় তাহলে আপনার জিপিকে দেখাতে দেরি করবেন না– প্রাথমিক অবস্থায় রোগ নির্ণয় জীবন বাঁচায়। আর আপনি যখন বাওয়েল ক্যান্সার স্ক্রীনিং সরঞ্জাম (FIT kit) পাবেন তখন দয়া করে এটি ফেলে রাখবেন না। পরীক্ষার জন্য নমুনাটি পাঠিয়ে দিন এবং আপনার দৈনন্দিন কাজ চালিয়ে যেতে থাকুন।”