ডা. আনিসা প্যাটেল বলছেন, সাধারণত যেসব ক্যান্সারে বেশিরভাগ মানুষ আক্রান্ত হয়ে থাকেন তার মধ্যে অন্ত্রের (বাওয়েল) ক্যান্সারে আক্রান্তদের সংখ্যা চতুর্থ সর্বাধিক হলেও যুক্তরাজ্যে এই ক্যান্সার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের মৃত্যুর কারণ। তারপরও অনেকেই তাদের অন্ত্রের অভ্যাস সম্পর্কে কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করেন।
তিনি বলেন, “আমি দুই সন্তানের মা এবং সারে এলাকার একজন জিপি। তাই ৩৯ বছর বয়সে আমার যখন স্টেইজ-৩ অন্ত্রের ক্যান্সার ধরা পড়লো তখন আমি আসলেই একটা ধাক্কা খেয়েছি।”
“আমি পুরোপুরি সুস্থ ও সবল। আমার পারিবারে ক্যান্সারের কোন ইতিহাস নেই এবং আমার ক্যান্সারের ঝুঁকির কোন কারণও ছিলো না। তাই আমি আমার কাহিনীটি অন্যদের সাথে ভাগাভাগি করছি এই ভেবে যে, তারা যেন অন্ত্রের ক্যান্সারের লক্ষণগুলো সনাক্ত করতে পারেন যাতে দ্রুততর সাহায্য পেতে পারেন।”
অন্ত্রের ক্যান্সার কী?
বৃহদন্ত্র আমাদের পরিপাকতন্ত্রের (পাচন ব্যবস্থা) একটি অংশ যা আমাদের খাবার থেকে পানি শোষণে সাহায্য করে এবং আমাদের শরীর থেকে খাদ্যের বর্জ্য অপসারণ করে। এই ক্যান্সার মলাশয় ও মলদ্বারসহ বৃহদন্ত্রের যে কোনও অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
বৃহদন্ত্রের ক্যান্সার কেন হয় তা সবসময় স্পষ্ট না হলেও ব্যক্তির জিনগত পরিবর্তন, তার আশপাশের পরিবেশ এবং জীবনযাপনের অভ্যাসও এর পেছনে একটি কারণ হিশেবে কাজ করতে পারে।
ডা. প্যাটেল আমাদের বলেন: “আপনি যদি মাত্রাতিরিক্ত ওজনের হন, ধূমপান করেন বা এটি আপনার কোনো নিকট আত্মীয়ের হয়ে থাকে তাহলে আপনার বৃহদন্ত্রের ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকতে পারে। অন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগ (যেমন ক্রোনের রোগ বা আলসারেটিভ কোলাইটিস) বা অন্ত্রের পলিপ থাকা ব্যক্তিদেরও এই ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকতে পারে।”
যুক্তরাজ্যে প্রতি বছর ৪২,৯০০টি নতুন অন্ত্রের ক্যান্সার ধরা পড়ে, যার মধ্যে ২,৬০০ জনের বয়স ৫০ বছরের কম। তিনি আরও বলেন, “যদিও ৯০% ক্ষেত্রে ৫০ বছরের বেশি বয়সীদের বেলায়ই এটি বেশি হয়, কিন্তু আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে এটি যে কারও যে কোনও বয়সে হতে পারে।”
আমি কি এটি প্রতিরোধ করতে পারি?
অন্ত্রের ক্যান্সার প্রতিরোধযোগ্য না হলেও স্বাস্থ্যকর জীবনধারা বজায় রাখার মাধ্যমে এই ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করা যেতে পারে। ডা. প্যাটেল বলেন, “এই সহজ কিছু পরামর্শ (টিপস) অনুসরণ করে আমরা টাইপ-২ ডায়াবেটিস এবং অন্ত্রের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি কমাতে পারি”।
“প্রচুর ফল, শাকসবজি এবং আঁশযুক্ত স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, লাল (রেড মিট)এবং প্রক্রিয়াজাত মাংস কম খাওয়া এবং নিয়মিত ব্যায়ামের সাথে সক্রিয় থাকার পরামর্শ দেবো আমি। এছাড়াও আপনি ধূমপান ত্যাগ করে, মদ্যপান কমিয়ে এবং প্রয়োজনে ওজন কমিয়ে সহায়তা পেতে পারেন।” এ ব্যাপারে আরও জানতে অ্যাপ ডাউনলোড করতে পারেন: www.nhs.uk/better-health থেকে।
কি কি উপসর্গ আমি খুঁজবো?
যদি আমরা জানি আমাদের স্বাভাবিক অন্ত্রের অভ্যাস কী তাহলে যখন কিছু ঠিক মনে হচ্ছে না তখন তা আমরা ধরতে পারি। ডাঃ প্যাটেল বলেন, “সবার অভ্যাস এক নয়, তাই আমাদের শরীরের আচরণ খেয়াল করা উচিত। আপনি নিয়মিত টয়লেটে যাচ্ছেন কিনা তা খেয়াল করুন। আপনার মলের আকার ও ধরণের উপর লক্ষ্য রাখুন। এছাড়াও আপনি ফ্লাশ করার আগে টয়লেট বা টিস্যুতে কোন রক্ত আছে কিনা সেটিও খেয়াল করুন।”
যে লক্ষণগুলির দিকে আমাদের নজর রাখা উচিত তার মধ্যে রয়েছে:
• আপনার মলের পরিবর্তন, যেমন নরম মল, ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য
• কমবেশি প্রায়শই টয়লেটে যেতে হয়
• আপনার মলের মধ্যে রক্ত, যা লাল বা কালো রঙের হতে পারে
• আপনার মলদ্বার থেকে রক্তপাত
• প্রায়শই মনে হয় আপনার টয়লেটে যেতে হবে, এমনকি যদি আপনি এইমাত্র টয়লেট থেকে এসেও থাকেন
• পেট ব্যথা এবং/অথবা ফোলা
• চেষ্টা না করেই ওজন কমে যাওয়া
• অকারণে খুব ক্লান্তি বোধ করা
ডাঃ প্যাটেল বলেন, “একজন ডাক্তার হিসাবে হয়তো আমি আমার উপসর্গগুলিকে গুরুত্ব দেইনি। প্রাথমিকভাবে আমার ফোলাভাব ছিল, শিরায় টান অনুভব করেছি এবং কখনও কখনও টয়লেটে যাওয়ার তাড়না অনুভব করেছি, যা আমি ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম (আইবিএস) হিসাবে নিয়েছি। আমি মাঝে মাঝে টয়লেট পেপারে রক্ত দেখেছি, যা আমি ভেবেছিলাম পাইলস থেকে হতে পারে। কারণ, তার কয়েক বছর আগে আমার সন্তানের জন্ম হয়েছে। আমি খুব ক্লান্তি বোধ করেছি। কিন্তু দুটি ছোট সন্তানের মা হয়ে একটি পরিবার চালাচ্ছি এবং পাশাপাশি একজন জিপি হিশেবে কাজ করছি, ফলে এটিকে আমার অস্বাভাবিক মনে হয়নি ।
“কিন্তু আমার টয়লেট হওয়াসহ অন্যান্য লক্ষণগুলি আরও খারাপ হয়ে যাওয়ায় আমি অবশেষে আমার ডাক্তারকে দেখাতে গিয়েছিলাম। আমার মল পাতলা এবং ফিতার মতো চ্যাপ্টা হয়ে গেছে কারণ অন্ত্রের একটি টিউমার টয়লেটকে বাধা দিচ্ছিল। তাই লক্ষণগুলি সব সময় স্পষ্ট নাও হতে পারে। কিছু স্ক্যান এবং পরীক্ষার পর আমাকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসার জন্য রেফার করা হয়েছিল এবং তাতে অন্ত্রের ক্যান্সার ধরা পড়ে।”
তাই কারো উদ্বেগজনক কোন লক্ষণ থাকলে তাদেরকে ডাক্তারের সাথে কথা বলতে বিব্রত বোধ না করার আহ্বান জানিয়েছেন ডাঃ প্যাটেল। তিনি বলেন, “আপনি যদি আপনার উদ্বেগ সম্পর্কে বা টয়লেট হওয়া বা না হওয়া নিয়ে কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করেন, অনুগ্রহ করে মনে রাখবেন আমরা শরীরের সকল অংশ পরীক্ষা করতে অভ্যস্ত এবং সবসময় এই জাতীয় বিষয়ে কথাবার্তা আমরা সব সময় শুনে থাকি।
“সুতরাং আপনি যদি মনে করেন যে কিছু সঠিক বোধ হচ্ছে না তবে দয়া করে আমাদের দেখাতে আসুন। আপনার লক্ষণ যদি তিন সপ্তাহ বা তার বেশি সময় ধরে চলে তবে আপনার জিপির সাথে যোগাযোগ করা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এটি ক্যান্সার না-ও হতে পারে- তবে আপনাকে তা জানতে হবে।”
যদি আপনার মল কালো বা গাঢ় লাল হয় বা আপনার ডায়রিয়ার সাথে রক্ত যায়, তাহলে জিপির সাথে একটি জরুরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক করুন বা NHS-এ 111 নম্বরে ফ্রি কল করুন। যদি আপনার মলদ্বার থেকে অবিরাম রক্তপাত হয় বা টয়লেটে প্রচুর রক্ত থাকে (যেমন পানি লাল হয়ে যায় বা আপনি বড় আকারের জমাট রক্ত দেখতে পান), তাহলে আপনাকে A&E-এ যেতে হবে বা 999 নম্বরে কল করতে হবে।
অন্ত্রের ক্যান্সার স্ক্রীনিং কি?
একটি হোম টেস্টিং কিট যার নাম Faecal Immunochemical Test (বা সংক্ষেপে ‘FIT kit’) ব্যবহার করে ৬০-৭৪ বছর বয়সী যোগ্য ব্যক্তিদের প্রতি দুই বছর অন্তর অন্তর NHS অন্ত্রের ক্যান্সার স্ক্রীনিং প্রোগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। এতে ৫০-৫৯ বছর বয়সীদেরও অন্তর্ভুক্ত করার জন্য এখন প্রোগ্রামের পরিসর বাড়ানো হচ্ছে, যাতে আপনি ৬০ বছর পূর্ণ করার আগে এ পরীক্ষার সুযোগ পেতে পারেন।
আপনি বাড়িতে কিটটি ব্যবহার করবেন। আপনার মলের একটি ছোট নমুনা নিয়ে আপনি একটি টিউবে রেখে NHS-এ জমা দেবেন। তারপর যা খালি চোখে দেখা যায় না এমন রক্তের ক্ষুদ্র চিহ্ন যা ক্যান্সারের সম্ভাব্য লক্ষণ এতে আছে কিনা তা পরীক্ষা করা হয়। মলে রক্তের উপস্থিতির অর্থ এই নয় যে আপনার অন্ত্রের ক্যান্সার হয়েছে। তবে তখন কোলনোস্কোপির মতো আরও কিছু পরীক্ষার পরামর্শ দেওয়া হয়।
ডাঃ প্যাটেল বলেন: “যদি আপনি বা আপনার পরিবারের কেউ ডাকযোগে পরীক্ষার কিট পান, আমি আপনার কাছে অনুরোধ করছি – দয়া করে এটি ফেলে রাখবেন না। এই কাজে মাত্র কয়েক মুহূর্ত সময় লাগে। আর আপনার কোনো সুস্পষ্ট লক্ষণ না থাকলেও এটি ক্যান্সার থাকলে তা ধরতে সাহায্য করতে পারে।”
এক হিসাব মতে, অন্ত্রের ক্যান্সার স্ক্রীনিং কিট ব্যবহারকারী প্রায় ৯৮ শতাংশের আর পরবর্তী পরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে না। বাকী ২ শতাংশকে আরও পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে যেতে বলা হয়। পরবর্তী আরও পরীক্ষার জন্য যারা হাসপাতালে যান তাদের মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশের কমের ক্যান্সার ধরা পড়ে। যাইহোক, আরও ৫৫ শতাংশের হাসপাতালের প্রক্রিয়া চলাকালীন পলিপ পাওয়া যায়। পলিপ ক্যান্সার নয়, তবে সময়ের সাথে সাথে ক্যান্সারে পরিণত হতে পারে। কোলনোস্কোপির সময় পলিপগুলি সহজেই অপসারণ করা যেতে পারে এবং তা অন্ত্রের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করে।
ডাঃ প্যাটেল বলেন, “যদি অন্ত্রের ক্যান্সার প্রাথমিকভাবে নির্ণয় করা হয়, এটি চিকিৎসাযোগ্য এবং নিরাময়যোগ্য হতে পারে। পরীক্ষা সত্যিই আপনার জীবন বাঁচাতে পারে,” তিনি আরও বলেন।
চলমান সেবা সম্প্রসারণের মাধ্যমে ৫০-৫৯ বছর বয়সী যোগ্য ব্যক্তিদেরও এতে অন্তর্ভুক্ত করার ফলে বছরে প্রায় আরো ৪.২ মিলিয়ন মানুষ NHS অন্ত্রের ক্যান্সার স্ক্রীনিং প্রোগ্রামের অন্তর্ভুক্ত হবেন। এর মানে হল- সম্পূর্ণ রোলআউট সম্পন্ন হলে প্রতি বছর মোট নয় মিলিয়নেরও বেশি মানুষ ক্যান্সার স্ক্রীনিং প্রোগ্রামের জন্য যোগ্য বিবেচিত হবেন। এ ব্যাপারে আপনি www.nhs.uk/conditions/bowel-cancer-screening ভিজিট করে আরও বিস্তারিত জানতে পারেন।
কিভাবে আমি আমার রোগ ধরা পড়ার বিষয়টি মোকাবিলা করেছি
ক্যান্সার হয়েছে এই খবরে আমি কেমন অনুভব করেছি তা তিনিই বুঝবেন যার জীবন পরিবর্তনের মত খবর পাওয়ার দুর্ভাগ্যজনক অভিজ্ঞতা রয়েছে। নিজেকে হারিয়ে ফেলা, বিচলিত এবং দিশাহীন হয়ে পড়েছিলাম। অনেক সময়ে এতো মন খারাপ, রাগান্বিত এবং বিরক্ত বোধ হতো যে নিজেকে প্রবোধ বা সান্তনা দিতে পারতাম না।
টিউমার অপসারণের জন্য অপারেশন করতে গিয়ে আমি ভয় পেয়েছিলাম। আমি জানতাম না জ্ঞান ফিরে পাবার পর কি শুনবো। ক্যান্সার কি চলে যাবে? আমার কি কেমো-রেডিওথেরাপির প্রয়োজন হবে?
সৌভাগ্যক্রমে, আমার টিউমার সম্পূর্ণভাবে অপসারণ করা হয়েছিল এবং ক্যান্সারের ফিরে আসার ঝুঁকি কমাতে আমার তিন মাস কেমোথেরাপি নিতে হয়েছিল।
আমার ডাক্তার, বিশেষজ্ঞ, নার্স, অনলাইনে সহায়তা গোষ্ঠী এবং আমার পরিবার এবং বন্ধুদের নেটওয়ার্কের সাহায্যে, আমি এই নেতিবাচক পরিস্থিতিটিকে ইতিবাচক রূপে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। অন্ত্রের ক্যান্সার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে এবং এই ক্যান্সারকে ঘিরে থাকা কুসংস্কার দূর করতে সাহায্য করার জন্য আমি আমার কাহিনীটি ভাগাভাগি (শেয়ার) করি। আপনার যদি কোন উপসর্গ থাকে, তাহলে আপনার সাধারণ ডাক্তারকে দেখাতে দেরি করবেন না– প্রাথমিক অবস্থায় রোগ নির্ণয় জীবন বাঁচায়।