যুক্তরাজ্যে অবশেষে বসন্তকাল এসেছে। এই সময়ে যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপজুড়ে মিজেল (হাম)-এ আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি এবং পিতামাতাদেরকে মিজেল-এর ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়া হচ্ছে।
মিজেল বা হাম কি?
অনেকেই মনে করে থাকেন যে মিজেল বা হাম ‘শুধু র্যাশ অর্থাৎ ফুসকুড়ি মাত্র’ কিন্তু এটি তার চেয়েও অনেক বেশি একটা কিছু। এটি একটি গুরুতর রোগ যা সহজেই ছড়িয়ে পড়ে এবং এটি মেনিনজাইটিস, সেপসিস এবং অন্ধত্বসহ অন্যান্য মারাত্মক অসুস্থতা বা জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
হাম সাধারণত ঠাণ্ডার লাগার মতো উপসর্গ দিয়ে শুরু হয়। কয়েকদিন পরে শরীরে সামান্য ফুলে ওঠা ফুসকুড়ির দাগ দেখা দেয়। এটি শরীরে ছড়িয়ে পড়ার আগে মুখে শুরু হয়। এই দাগগুলি একসাথে যুক্ত হয়ে ফুসকুড়ি সৃষ্টি করতে পারে। ফ্যাকাশে ত্বকে ফুসকুড়ি লাল বা লালচে-বাদামী রঙের দেখাতে পারে এবং কালো বা বাদামী ত্বকে ফুসকুড়ি ঘন বাদামী রঙের হতে পারে যা নজরে আসা কঠিন হতে পারে। এসব ফুসকুড়ি খুব রঞ্জক এবং অসমতল হতে পারে।
লণ্ডনের একজন জিপি ডাঃ মুহাম্মদ নকভির পরামর্শ হচ্ছে- www.swLondon-healthiertogether.nhs.uk ওয়েবসাইটে গিয়ে বিভিন্ন ত্বকের রঙে মিজেলের র্যাশ অর্থাৎ ফুসকুড়িগুলোর ছবি কেমন দেখায় তা দেখে নিন।
ডাঃ নকভি বলেন, “আপনার নিজের এবং আপনার সন্তান ও প্রিয়জনের ত্বকে র্যাশ বা ফুসকুড়ি দেখতে কেমন হতে পারে তা আপনাকে জানতে হবে। কারণ এটি বিভিন্ন রঙের ত্বকে খুব অন্যরকম দেখা যেতে পারে।”
ভ্যাকসিন আমাদের সেরা সুরক্ষা
তবে সুখবর হলো- যদিও হামের কোনো চিকিৎসা নেই, তবে মাত্র দুটি টিকা এর বিরুদ্ধে আজীবন উত্তম সুরক্ষা দিয়ে থাকে।
ডাঃ নকভি ব্যাখ্যা করে বলেন, অনেকেই মিজেল, মাম্পস এবং রুবেলা (এমএমআর) টিকার উভয় ডোজ না পাওয়ার কারণে বেশি সংখ্যক মানুষ মিজেলে আক্রান্ত হচ্ছেন।
ডাঃ নকভি বলেন, “আমার এমন অনেক রোগী আছেন যাদের মিজেলে ভূক্তভোগী নানা-নানী বা বয়স্ক কোন আত্মীয়স্বজন নেই। তাদের সৌভাগ্য এই যে, এর ফলে মিজেল কতটা বিধ্বংসী হতে পারে সে সম্পর্কে তাদের ব্যক্তিগত তিক্ত কোন অভিজ্ঞতা নেই।
“এটি যেমন যুক্তরাজ্যের টিকাদান কর্মসূচির সফলতা নির্দেশ করে তেমনি এর অর্থ হচ্ছে কখনো কখনো মানুষ টিকা নেয়ার গুরুত্ব বুঝতে পারে না এবং তারা নিজের এবং তাদের সকল সন্তানের এমএমআর টিকার উভয় ডোজ নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার ব্যাপারে সক্রিয় থাকে না।”
টিকার মাত্র দুটি ডোজ মিজেল, মাম্পস এবং রুবেলার বিরুদ্ধে প্রত্যেককে সারা জীবনের জন্য কার্যকর সুরক্ষা দেয় যা তাদেরকে এবং তাদের আশেপাশের মানুষজনকে নিরাপদ রাখে।”
লেইলানির কাহিনী
লেইলানির জন্ম হয়েছিলো নির্ধারিত সময়ের আগেই এবং তার বিকাশও বাধাগ্রস্ত হয়েছিলো। তাঁর জীবনের প্রথম ১০ সপ্তাহ কেটেছে নিবিড় পরিচর্যা (ইনটেনসিভ কেয়ার)-সহ শিশুদের জন্য বিশেষায়িত পরিচর্যা ইউনিটে। তাঁর মা নিকোল জানান, একেবারে শিশু অবস্থায় ২০০৪ সালে লেইলানির মিজেল ধরা পড়ে ।
লেইলানির মা বলেন, “সে ছিলো আমাদের প্রথম সন্তান। সে হাসপাতাল ছেড়ে যাওয়ার মতো সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত জীবনটা উত্থানপতনের মধ্য দিয়ে চলছিলো। কোন অঘটন ঘটে কিনা অথবা মানুষজনের কাছ থেকে তার কোনো সংক্রমণ হয় কিনা এ নিয়ে আমরা খুবই সতর্ক থাকতাম। তার শিশুকালীন টিকা দেওয়াসহ তাকে সুরক্ষিত রাখতে আমাদের পক্ষে যা যা করা সম্ভব তার সবই আমরা করেছি।
“তার এমএমআর (MMR) টিকার জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়ার আগে, তার শরীরে ফুসকুড়ি (র্যাশ) আমার নজরে আসে। সঙ্গে সঙ্গে, আমি বুঝে নিয়েছি এটি মিজেল অর্থাৎ হাম। আমি আমার মাকে ফোন করলাম। লেইলানি ঠিক আছে এ আশ্বাস দেওয়ার পরও আমার মা সত্যিই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।
“লেইলানির জন্য জরুরীভিত্তিতে জিপির অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া গেলো। তার মিজেল (হাম) হয়েছে বলে জিপির কাছে ধরা পড়লো এবং জিপিও উদ্বিগ্ন হলেন। আমি তাকে জানালাম যে, লেইলানি এমনিতে ভালোই ছিলো। সে শুধু খুব বেশী ঘুমাচ্ছিলো। শিশুদের জন্য ব্যথা উপশমের ওষুধটি খাওয়ানোর ফলে তার শরীরের তাপমাত্রা কমে স্বাভাবিক মাত্রায় নেমে আসে।”
“আমি বুঝতে পারিনি আমার মা কেনো এ নিয়ে এত চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। তখন তিনি বললেন, আমার এক ফুফু শৈশবে মিজেলে আক্রান্ত হবার পর স্বাস্থ্য জটিলতায় মারা গিয়েছিলেন।
“যদিও আমি জানতাম আমার বাবার এক বোন শৈশবে মারা গেছেন, কিন্তু এ বিষয় নিয়ে আসলে তেমন কথাবার্তা হয়নি।” নিকোল বলেন, “আমি জানতাম না যে মিজেল ফুসকুড়ি নয়, বরং অন্য কিছূ। হঠাৎই আমার খেয়াল হলো আমার মা, স্বাস্থ্য পরিদর্শক এবং ডাক্তার এনিয়ে কেনো এত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন।
মিজেল নিয়ে উদ্বেগের ব্যাপারটি ডাঃ নকভি বোঝেন: “মিজেল থেকে নিউমোনিয়া এবং মস্তিষ্কের সংক্রমণসহ গুরুতর সব জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। আর মিজেল, মাম্পস বা রুবেলার কোনও প্রতিকার নেই।”
“এসব জটিলতা বিরল হলেও দুঃখজনকভাবে, মিজেলে আক্রান্ত প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন শিশুর হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন হয়। আপনার বা আপনার সন্তানের মিজেল হলে এবং শরীর খারাপের দিকে যাচ্ছে মনে হলে দয়া করে করে জরুরিভিত্তিতে পরামর্শ নিন।”
আপনি যদি মনে করেন আপনার নিজের বা আপনার সন্তানের হাম হয়েছে তাহলে আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্টে যাওয়ার আগে দয়া করে জিপি সার্জারিকে এটি জানান। শ্বাসকষ্ট, উচ্চ তাপমাত্রা যা প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেন সেবনের পরও কমছে না, কাশিতে রক্ত, ঘুম ঘুম অবস্থা বা বিভ্রম কিংবা অজ্ঞান হওয়া, মূর্ছা যাওয়া অথবা খিঁচুনি- এসবের কোনোটি হলে আপনাকে এক্সিডেন্ট এণ্ড ইমারজেন্সি (A&E)-তে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
মাম্পস এবং রুবেলা কি?
ডাঃ নকভি বলেন, “মাম্পস প্রায়শই মুখের পাশে কানের নীচে ফুলে থাকা অবস্থায় দেখা যায়। এতে ব্যথা থাকে । এটিকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে “হ্যামস্টার ফেইস” চেহারা হিসাবে বর্ণনা করা হয়।”
তিনি আরো বলেন, “সৌভাগ্যক্রমে, মাম্পস থেকে সৃষ্ট জটিলতা থেকে ভাইরাল মেনিনজাইটিস অথবা অণ্ডকোষ বা ডিম্বাশয় ফুলে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি হয়ে থাকলেও তা বিরল।”
রুবেলার প্রধান উপসর্গ (যাকে কেউ কেউ জার্মান মিজেল বলে থাকেন) হলো একটি দাগযুক্ত ফুসকুড়ি যা মুখে বা কানের পিছনে শুরু হয় এবং ঘাড় ও শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।
“টিকার কল্যাণে গর্ভাবস্থায় রুবেলা হওয়ার ঘটনা খুবই বিরল। কিন্তু ডাঃ নকভি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, এ সময় রুবেলায় আক্রান্ত হলে গর্ভের শিশুর স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হওয়ার, এমনকি গর্ভ নষ্ট হয়ে যাওয়ারও সত্যিকারের ঝুঁকি তৈরী হতে পারে।”
মিজেল (হাম) খুব সহজে ছড়ায়
যদি আপনাকে বা আপনার শিশুকে টিকা না দেওয়া হয়ে থাকে তবে আপনি মিজেলে আক্রান্ত হবার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন। এটি সহজেই ছড়িয়ে পড়ে এবং ক্লাসের কারো মিজেল হলে টিকা না নেওয়া দশজন শিশুর মধ্যে নয়জন শিশুই তাতে আক্রান্ত হতে পারে।
ডাঃ নকভির পরামর্শ হচ্ছে- “আপনার সন্তানের মিজেল হলে তার শরীরে র্যাশ (ফুসকুড়ি) প্রথম দেখা দেওয়ার দিন থেকে অন্তত চার দিন তাকে স্কুলে দেবেন না। আপনি মিজেলে আক্রান্ত হলেও র্যাশ (ফুসকুড়ি) প্রথম দেখা দেওয়ার দিন থেকে অন্তত চার দিন দয়া করে কাজ এবং অন্যদের কাছ থেকে দূরে থাকুন।”
মিজেলে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য পরামর্শ হলো- নিয়মিত সাবান এবং পানি দিয়ে আপনারা হাত ধোবেন যাতে আরও বেশী ঝুঁকিতে থাকা মানুষ যেমন শিশু, বয়স্ক, সংক্রমণপ্রবণ ব্যক্তি বা টিকা না নেওয়া গর্ভবতী মায়েদের কাছে এটি সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
মিজেল, মাম্পস এবং রুবেলা বিরুদ্ধে টিকা কারা পেতে পারেন?
মিজেল, মাম্পস এবং রুবেলার বিরুদ্ধে কার্যকর এবং আজীবন সুরক্ষা পেতে এমএমআর (MMR) টিকার দুটি ডোজ প্রয়োজন। এমএমআর টিকার প্রথম ডোজ সাধারণত শিশুদের এক বছর বয়সে দেওয়া হয়। এরপর দ্বিতীয় ডোজটি দেয়া হয় যখন শিশু তিন বছর চার মাসের কাছাকাছি বয়সের হয়। ডাঃ নকভি বলেন, যেসব প্রাপ্তবয়স্ক এবং শিশুর এমএমআর (MMR) টিকার একটি বা উভয় ডোজই নেননি তারা এখন তাদের টিকা নিতে পারেন। তিনি বলেন, “আপনার সন্তানের এমএমআর (MMR) টিকার উভয় ডোজ নেওয়া আছে কিনা তা জানতে তার শিশুস্বাস্থ্য রেকর্ড যা লাল বই নামেও পরিচিত সেটি দেখে নিতে পারেন অথবা তার জিপি প্র্যাকটিসকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিতে পারেন।”
তিন বছর চার মাসের কম বয়সী যেসব শিশু তাদের এমএমআর (MMR) টিকার প্রথম ডোজ আগে পায়নি তারা এখন তাদের জিপি প্র্যাকটিস থেকে এটি পেতে পারে। আর তিন বছর চার মাসের বেশি বয়সী শিশুরা যারা তাদের এমএমআর টিকার একটি বা উভয় ডোজই পায়নি তারা এখন তাদের জিপি প্র্যাকটিস থেকে দুটি ডোজই পেতে পারে।
ডাঃ নকভি বলেন, “আপনার সন্তানের সুরক্ষার জন্য তাদের বাদ পড়া এমএমআর (MMR) টিকা নিতে তাদের জিপিকে ফোন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিন।” তিনি আরো বলেন, “যদি রোজা থাকার সময়ে আপনাকে মিজেল বা কোভিডের প্রতিষেধক টিকা নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় তাহলে আপনি না করবেন না। কারণ, বেশিরভাগ মুসলিম পণ্ডিত এ ব্যাপারে একমত যে, রোজা অবস্থায় টিকা নিলে আপনার রোজা ভঙ্গ হবে না। এছাড়া যে টিকায় শূকরের জিলেটিন নেই আপনাকে সেই টিকা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়ার সময় আপনি আপনার জিপিকে বলতে পারেন।”
নিকোল বলেন, “একজন মা হিসাবে, আমি এ বিষয়ে নিজে জানার চেষ্টা করেছি এবং লেইলানি মিজেলে আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও সে রোগ থেকে সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হওয়ার পর তার এমএমআর (MMR) টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছে। মাম্পস ও রুবেলার আক্রমণ থেকেও সে যাতে কার্যকরভাবে সুরক্ষিত থাকে সেটি নিশ্চিত করার জন্য সে এমএমআর (MMR) টিকার দ্বিতীয় ডোজটিও নিয়েছে।”
টিকা সম্পর্কে আরও পরামর্শের জন্য একজন স্বাস্থ্য পেশাদারের সাথে কথা বলুন বা NHS.UK ওয়েবসাইট দেখুন। এছাড়াও আপনি ‘সাউথ ওয়েস্ট লন্ডন হেলদিয়ার টুগেদার’ ওয়েবসাইটে শিশুদের জন্য এবং গর্ভাবস্থার বিস্তৃত অবস্থার বিষয়ে স্পষ্ট এবং বিভিন্ন পরামর্শ পেতে পারেন। www.swLondon-healthiertogether.nhs.uk পাশাপাশি আপনি NHS.UK ওয়েবসাইটে মিজেল এবং মিজেল, মাম্পস এবং রুবেলা (এমএমআর)-এর প্রতিষেধক টিকা দেওয়া সম্পর্কে তথ্য পেতে পারেন।