সামরিন আহমেদ ♦
শিশু ও তরুণদের সহায়তার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ একজন নিবন্ধিত কাউন্সেলর হিশেবে আমি নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি- একটি শিশুর জীবনের প্রথমদিককার মুহূর্তগুলো কীভাবে তার ভবিষ্যত গড়ে দিতে পারে।

আমাদের কমিউনিটিতে শিশুরা লালিতপালিত হয়ে থাকে একটি বাড়ির হৃদপিণ্ড হিসেবে। অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানের মঙ্গলের জন্য প্রতিদিন অগুণতি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। এই সিদ্ধান্তের ব্যাপ্তি পুষ্টিকর খাবারের জোগান থেকে শুরু করে অপরিহার্য স্বাস্থ্যসেবা লাভের দিকটি নিশ্চিত করা পর্যন্ত। কিন্তু শারীরিক স্বাস্থ্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সমান গুরুত্বপূর্ণ শিশুর মানসিক বিকাশের দিকটির যত্ন নেওয়া।
একটি শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশের ৯০ শতাংশই ঘটে থাকে পাঁচ বছর বয়সের মধ্যে। এই সময়টা গড়ে দেয় তার চিন্তা করা, অন্যের সাথে যোগাযোগ করা এবং আশপাশের পৃথিবীটার সাথে নিজেকে যুক্ত করার সক্ষমতা। জীবনের এই প্রথম বছরগুলো তার শক্ত ভিতগুলো গড়ে দেয়ার সময়। আর অভিভাবক হিশেবে, প্রতিটি ছোট ছোট আদান-প্রদান (মিথস্ক্রিয়া)- যা একটা মৃদু হাসি বা আলিঙ্গন থেকে শুরু করে ঘুমপাড়ানির গল্প শোনানো পর্যন্ত বিস্তৃত- একটা দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে।
শিশুর মানসিক বিকাশে সহায়তার জন্য আপনার ভুরিভুরি খেলনা কিনে দেয়ার কিংবা দিনভর বাইরে ঘুরিয়ে আনার দরকার নেই। সবচেয়ে সেরা শিক্ষাটা শিশু পেয়ে থাকে প্রাকৃতিকভাবে দৈনন্দিন ভাব বিনিময়ের মধ্যদিয়ে। আলাপচারিতা, খেলাধূলা, এমনকি রান্নাবান্না বা কেনাকাটার মতো দৈনন্দিন কাজে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমেও আপনি আপনার শিশুর অতি দরকারি জীবন-দক্ষতা গড়ে তুলতে সহায়তা করতে পারেন এবং এসবের মাধ্যমে হয়ে যেতে পারে তার স্কুলের সঠিক শুরুটা।
আমাদের ঐতিহ্য ও প্রথাগুলো প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে এ ধরণের সমৃদ্ধ সুযোগ করে দিতে পারে:
♦ গল্প বলা: মাতৃভাষায় নিজ দেশের প্রচলিত লোককাহিনী শোনানো বা ঘুমপাড়ানির গান গাওয়া, যা শিশুর ভাষাগত দক্ষতা এবং তার সংস্কৃতিগত গৌরব শক্তিশালী করতে পারে।
♦ একসাথে রান্নাবান্না: শিশুদেরকে চাপাতি তৈরিতে সহায়তা করতে দিলে বা ডালের পরিমাণ মাপতে দিলে- এগুলো শিশুদের সংখ্যা, বস্তুর গঠনবিন্যাস এবং হাত ও চোখের সমন্বয়ের মতো বিষয়গুলোর সাথে পরিচিত করে তুলবে।
♦ পারিবারিক সমাবেশ: বয়স্কদের সাথে বসলে, পারিবারিক ইতিহাস শুনলে ও আলাপ-আলোচনায় অংশ নিলে শিশুদের ভাষাগত দক্ষতা বাড়ে এবং তারা যে পরিবারের অংশ- সেই উপলব্ধিটা শিশুদের মনে জন্ম নেয়।
♦ উৎসব ও উদযাপন: ঈদ বা দিওয়ালীর উৎসবের প্রস্তুতি হিশেবে ঘর সাজানো কিংবা মিষ্টি বানানোর মতো কাজে তাদেরকে জড়িত করা হলে তা শিশুদের সৃজনশীলতা অর্জন এবং ছোট ছোট কাজে হাত, কব্জি, আঙুল ও মাংশপেশীর ব্যবহারের কৌশল (ফাইন মোটর স্কিল) শিখতে সহায়ক হয়।
আপনার শিশুর বিকাশে সহায়তায় শীর্ষ কিছু টিপস
১. ধীরে এগোন: আপনার শিশুকে তার নিজস্ব গতিতে এগোতে উৎসাহিত করুন।
২. আলাপচারিতা: আপনার শিশুর সাথে কথা বলুন। তার কথা অস্পষ্ট হলেও জবাব দিন। এটা তার যোগাযোগের ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাস বাড়াবে।
৩. প্রতিটি মুহূর্তই হোক একেকটি শিক্ষণীয় মুহূর্ত: মুদি (গ্রোসারী) দোকানে কেনাকাটায় গেছেন? ফলগুলো শিশুর সাথে মিলেই গণনা করুন। কাপড় ধুয়ে দিচ্ছেন? কাপড়গুলোর ভিন্ন ভিন্ন রঙের নাম বলুন।
৪. কৌতূহল উৎসাহিত করুন: “এরপর কী ঘটতে যাচ্ছে বলে তুমি মনে করো?” তাকে এ ধরণের উন্মুক্ত প্রশ্ন করুন।
৫. সৃজনশীল হোন একসাথে: খেলনা নিয়ে খেলুন, গল্প বলুন, এবং খেলার ভান করার মাধ্যমে কল্পনার অনুসন্ধান করুন।
‘স্টার্ট ফর লাইফ’
অভিভাবকদের জন্য একটি মূল্যবান ও ব্যবহারিক নির্দশনা
‘স্টার্ট ফর লাইফ’ ওয়েবসাইট থেকে পাবেন সহজে অনুসরণযোগ্য সব উপদেশ যেটি ব্যস্ত অভিভাবকদের কথা মাথায় রেখে তৈরি। আপনি হয়তো ‘স্পিচ ডেভেলপমেন্টে’র জন্য ভালো কোনো আইডিয়া খুঁজছেন, হয়তো বা কোনো আদানপ্রদানমূলক (ইন্টারএক্টিভ) খেলার বিষয়ে কিছু টিপস অথবা আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির বিষয়ে কোনো উপদেশ চাইছেন- এসব বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য এই ওয়েবসাইট হতে পারে একটা ভালো ঠিকানা।
শিশুর জীবনের প্রথম বছরগুলো কেবলই কিছু মাইলফলক শেখার চেয়েও অনেক বেশি কিছু। এই সময়টা হচ্ছে- অর্থপূর্ণ সংযোগ গড়ে তোলার সময়। খেলাধূলার মাধ্যমে, আলাপচারিতার মাধ্যমে এবং সংস্কৃতিগত ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয়ার মাধ্যমে শিশুর সাথে যেসব ভাব-বিনিময় হয় সেসবের প্রতিটিই তার জীবনে একটা দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। শিশুর জীবনের এই অতি গুরুত্বপূর্ণ বছরগুলো সর্বোচ্চ কাজে লাগাতে অনুপ্রেরণা ও নির্দশনা পেতে ভিজিট করুন: https://www.nhs.uk/start-for-life/ ওয়েবসাইটটি।
একজন অভিভাবকের দৃষ্টিকোণ
তিন সন্তানের মা ইয়াসমিন বিবি বলেন, ‘স্টার্ট ফর লাইফ’ ওয়েবসাইটটি আমার জন্য সত্যিই খুবই উপকারে এসেছে। এটা সহজ ও ব্যবহারিক এমনসব আইডিয়া দিয়ে ভরপুর যেগুলো- স্কুলে বাচ্চা আনা-নেওয়া হোক কিংবা রাতের খাবারের আয়োজনের ব্যস্ততা হোক- আমার ব্যস্ত দিনগুলোর সাথে একেবারে যুৎসই। এটা আমার কাছে বন্ধুসুলভ এমন একটা নির্দেশনা যা আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে- শিশুদের নিয়ে আমরা যা যা করছি সেসবই যে তাদের জন্য একটা বিশাল পার্থক্য গড়ে দিতে পারে।
লেখক: নিবন্ধিত (রেজিস্টার্ড) শিশু কাউন্সেলর