গাজীউল হাসান খান ♦
কথিত আছে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় চাঁদাবাজি হতে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের সময়। ডেমোক্রেটিক এবং রিপাবলিকানদের মতো দুটি প্রধান দলের সম্মিলিত নির্বাচনী খরচ তিন বিলিয়ন ডলারের অনেক বেশি বলে ধরে নেওয়া হয়। চার বছর অন্তর অন্তর নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের খরচ নির্বাহের জন্য সেপ্টেম্বরের শেষ দিক থেকেই বড়মাপের চাঁদা উত্তোলন শুরু হয়ে যায়। তবে মধ্যবর্তী নির্বাচনসহ ধরা হলে রিপাবলিকানদের তুলনায় ডেমোক্র্যাটদের খরচ কিছুটা বেশি হয় বলে মনে করা হয়। নির্বাচন পরিচালনা কর্মীদের বেতন, প্রচারণার জন্য গণমাধ্যমে ব্যয়, শহর-নগরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশে বিলবোর্ড স্থাপন, ছাপা ও ডাক খরচ এবং সব শেষে পরিবহন বা যানবাহন সব মিলিয়ে সে এক আকাশচুম্বী খরচের ব্যাপার।
যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশ্বের অন্যতম প্রধান পরাশক্তির দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বলে কথা। বিশ্বের অন্যতম প্রধান ধনতান্ত্রিক দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্ন ধারার জাঁকজমক তো থাকতেই পারে। সে খরচ নির্বাহের জন্য তো গৌরীসেনরা রয়েছেনই। তার পরও শেষ পর্যন্ত তহবিল সংগ্রহ এবং খরচের পরিমাণের মধ্যে একটা ব্যবধান থেকেই যায়। তখনই চলে আসে দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতার মতো বিষয়গুলো। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে বিভিন্ন দেশ, ব্যবসা বা শিল্প প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিগতভাবে পুঁজিপতিদের কাছ থেকে অবদান রাখার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এতে সৌদি আরব, আমিরাত ও কুয়েত থেকে তাইওয়ান পর্যন্ত অনেক দেশকেই সম্পৃক্ত হতে দেখা যায়। এর মধ্যে বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করার ক্ষেত্রটি হচ্ছে আজকের ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েল। তবে ইহুদি জনগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে বড় শিল্পপতিদের বসবাস হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে। রয়েছে আমেরিকান ইসরায়েলি পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি (এআইপিএসি) বা লবিইস্টরা, যারা ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে সারা বছর কাজ করে। তাদের রয়েছে অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি।
মূলত এখান থেকেই অর্থাৎএই প্রক্রিয়ায়ই শুরু হয় বিভিন্ন ব্যাবসায়িক লেনদেন, বাণিজ্য, সামরিক ও বেসামরিক চুক্তি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে উচ্চকক্ষের সিনেটর এবং নিম্নকক্ষের কংগ্রেসম্যানরা পর্যায়ক্রমে এই প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়েন। এবং সেখান থেকেই শুরু হয় আন্তর্জাতিকভাবে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করার বিভিন্ন প্রক্রিয়া, দ্বন্দ্ব এবং সংঘাত। ঢুকে পড়ে কায়েমি স্বার্থের প্রশ্ন, সাম্রাজ্যবাদের বিভিন্ন স্বার্থ সংরক্ষণের প্রতিযোগিতা এবং অবশ্যম্ভাবীভাবে দুর্নীতি বিস্তারের অকথিত কৌশল। শুরু হয় উচ্চমূল্যের উন্নত প্রযুক্তির সামরিক সাজসরঞ্জাম বিক্রি ও পরমাণু অস্ত্র বিস্তারের বিভিন্ন কৌশল। এতে পরাশক্তিগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য ধরে রাখার পাশাপাশি চলে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের মধ্যে দ্বিদলীয় ক্ষমতার লড়াই ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব। তখনই গণমাধ্যমের বিভিন্ন শাখায় প্রকাশিত হতে শুরু করে অপ্রকাশিত দুর্নীতির সাতকাহন। যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন সময়ে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ও তাঁদের সন্তান কিংবা পরিবারের অন্য সদস্যদের অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা দুর্নীতির তথ্যাবলি। তখনই গরম হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অঙ্গন, কংগ্রেস, গণমাধ্যম এবং জনজীবন। বোঝা যায়, প্রকৃত অর্থে যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকার কতটা কার্যকর এবং দুর্নীতি কতটা গভীরে প্রোথিত।
পঞ্চাশের দশকে সংঘটিত কোরিয়া যুদ্ধের (শীতল লড়াই) সময় থেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হতে শুরু করে। সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতি কিংবা আধিপত্যবাদ বিস্তারের সূচনা থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি আর আগের গণতন্ত্র, মানবতাবাদ ও আইনের শাসনের সাংবিধানিক পথ ধরে এগোয়নি। সে অবস্থায় নতুন প্রজন্মের রাজনীতিক হিসেবে মাত্র ২৯ বছর বয়সে অর্থাত্ ১৯৭২ সালে জো বাইডেন অঙ্গরাজ্য ভেলওয়্যার থেকে সিনেটর নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন থেকে দীর্ঘ ৩৭ বছর ক্যাপিটল হিলে একজন ডেমোক্র্যাট সিনেটর হিসেবে বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি প্রত্যক্ষ করছেন। তিনি ২০২০ সালে নিজে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার অধীনে ৪৭তম ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর কিছুটা আগে থেকেই অর্থাৎ রিপাবলিকান দলীয় প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশের আধিপত্যবাদী রাজনীতির প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেননি। মধ্যপ্রাচ্য, তাইওয়ান ও উন্নয়নশীল বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে তিনি তত্পর হয়েছিলেন। তিনি প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মতো একজন প্রগতিশীল ধারার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কাজ করেও মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদিবাদী ইসরায়েলের বিভিন্ন অনৈতিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থানে যেতে পারেননি। ফলে তাঁর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে অর্থাত্ প্রথাগত রাজনীতির বাইরে থেকে আসা ডোনাল্ড ট্রাম্পের কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি ও ইসরায়েলে ইহুদিবাদীদের অনৈতিক কার্যকলাপ ও অন্যায়ভাবে বসতি বিস্তারের কর্মসূচিতে কাঙ্ক্ষিতভাবে বাধা প্রদান করতে পারেননি। বরং জর্জিয়া, আর্মেনিয়া এবং ইউক্রেনের মতো রাশিয়ার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলকে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর আওতাভুক্ত করার লক্ষ্যে তত্পর হয়ে উঠেছিলেন। এটি ছিল তাঁর একটি সাম্রাজ্যবাদী কূটনীতি ও সামরিক পদক্ষেপের অংশ। এ ধারণা পশ্চিমা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকের।
উপরোল্লিখিত সময় থেকেই জো বাইডেন ইউক্রেনের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁর সম্পর্ক জোরদার করার প্রক্রিয়া চালু রেখেছেন। ইউক্রেনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কির পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট পেট্টো পরোসেনকোর সময় থেকেই জো বাইডেন ও তাঁর পঞ্চাশোর্ধ্ব পুত্র হান্টার বাইডেন ইউক্রেনে কিছু ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেছিলেন। পুত্র হান্টার বাইডেন ব্যবসা নিয়ে অর্থাত্ তাঁর কর প্রদানের ক্ষেত্রে যে ফাঁকি দিয়েছেন, সে বিষয়টি এখন অত্যন্ত জটিল আকার ধারণ করেছে। হান্টার বাইডেন ১৪ মিলিয়ন ডলার কর ফাঁকি দিয়েছেন বলে এখন যে অভিযোগ উঠেছে, তা শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হলে তাঁর (হান্টারের) সর্বোচ্চ ১৭ বছর কারাদণ্ড হতে পারে। তা ছাড়া হান্টারের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে অস্ত্র খরিদ করা এবং তা ঘোষণা না করার অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়গুলো জো বাইডেনের আসন্ন দ্বিতীয় টার্মের নির্বাচনে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ সেসব ঘটনা থেকে জো বাইডেনও বিচ্ছিন্ন নন। তদুপরি জো বাইডেন ইসরায়েলের ব্যাপারে এখনো দায়মুক্ত হতে পারেননি। শুরুতে ইসরায়েলকে সমর্থন দিতে গিয়ে তিনি নিজেকে একজন ‘ইহুদিবাদী’ বলে ঘোষণা করেছিলেন। তদুপরি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গাজায় যুদ্ধ বন্ধ করার ব্যাপারে তিনবারের মধ্যে দুইবার ভেটো প্রদান করেছেন। তারপর তৃতীয়বারে গাজার রাফায় নেতানিয়াহুর আক্রমণ প্রতিহত ও ত্রাণসামগ্রী বিতরণের জন্য যে ব্যবস্থা নিয়েছেন (ভোট প্রদানে বিরত থাকা), সেটিও ‘বাধ্যতামূলক’ নয় বলে প্রচারিত হয়েছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বব্যাপী শান্তিকামী মানুষ অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আরবরা এবং মুসলিম সম্প্রদায় এখন প্রকাশ্যেই জো বাইডেনের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান অব্যাহত রেখেছে। এর আরো কারণ রয়েছে; যেমন—গাজা উপত্যকা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টি। এ প্রসঙ্গে বাইডেন প্রশাসন যেমন স্পষ্ট করে কিছু বলছে না, তেমনি দুই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভিত্তিতে ফিলিস্তিন সমস্যার যে সমাধানের কথা বলা হচ্ছে, সে ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে কোনো কার্যকর ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে না; বরং বাইডেন নেতানিয়াহুকে অস্ত্র দিয়ে যাচ্ছেন। এতে গাজায় শিশু, নারী ও পুরুষসহ মৃতের সংখ্যা ৩২ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী অপর শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিশ্বব্যাপী অভিযোগ উঠেছে যে ট্রাম্পের সাহায্য ও সমর্থনের কারণেই বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এতটা অগ্রসর হওয়ার দুঃসাহস দেখাতে পেরেছেন। ট্রাম্প শুধু ইসরায়েলের প্রকৃত বন্ধুই নন, তিনি ইসরায়েলের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করতে চান তাঁর ইহুদি জামাতা জ্যারেড কুশনারকে। তা ছাড়া ট্রাম্প তাঁর জামাতাকে নিয়ে অবৈধভাবে সমরাস্ত্রসহ অন্যান্য ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে আগ্রহী ইসরায়েলব্যাপী। ট্রাম্প সম্প্রতি তাঁর বিশাল অঙ্কের কর ফাঁকির মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার উদ্দেশ্যে ১৭৫ মিলিয়ন ডলারের একটি বন্ড ঘোষণা করেছেন, যা আইনজীবীরা একটি ন্যক্কারজনক কৌশল বলে উল্লেখ করেছেন। তা ছাড়া কর ফাঁকি ও অন্যান্য আয় গোপন করা এবং কর ফাঁকি দেওয়ার কারণে আইনগতভাবে শুধু ট্রাম্পের নয়, তাঁর পুত্র-কন্যাদেরও সাজা হতে পারে। এই সম্পূর্ণ বিষয়টি এখন চূড়ান্তভাবে বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে। এই বিষয়টি আগামী নির্বাচনের আগেই সুরাহা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এতে ট্রাম্পের পক্ষে যত জনপ্রিয়তাই থাকুক না কেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা সম্ভব না-ও হতে পারে। এমন একটি অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররা তাঁদের আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে সন্দিগ্ধ হয়ে পড়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন নিয়ে যাঁরা এত দিন গর্ব করতেন, তাঁরা বর্তমান নেতৃত্বের অপকর্ম নিয়ে বেশ কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থায় ইসরায়েলের গাজা আক্রমণ ও গণহত্যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রব্যাপী যে নতুন প্রজন্ম দিনে দিনে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, তারা কোনোক্রমেই আর সে পুরনো নেতৃত্বকে সমর্থন দিতে নারাজ।
সাম্রাজ্যবাদ, কর্তৃত্ববাদ এবং সব পর্যায়ের দুর্নীতি ও অনিয়মকে বাদ দিয়ে নতুন প্রজন্ম আবার এক নতুন যুক্তরাষ্ট্র গড়ে তুলতে আগ্রহী, যার মূল চালিকাশক্তি হবে প্রকৃত গণতন্ত্র, মানবতাবাদ ও আইনের শাসন।
০৫ এপ্রিল ২০১৪
লেখক: বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক