লণ্ডনের চিঠি
সাগর রহমান ♦
গত ২মে রাত সাড়ে দশটার সময় আমার মনে পড়লো, আমি লণ্ডনের মেয়র নির্বাচনে ভোট দিতে ভুলে গেছি। নিজের এই অনাগরিকসুলভ কাজে আমি নিজের উপর অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছি। বিরক্ত হয়ে উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করতে লাগলাম মনে মনে। আজ সারাদিন খুব সকাল থেকে স্কুলে ছিলাম। স্কুলের পরে অভিভাবক মিটিং ছিল কয়েক ঘন্টা। কিন্তু তারপরও অন্তত তিনটি ঘন্টা ছিল, যে সময়ে গিয়ে অনায়াসে ভোট দিয়ে আসা যেতো। অর্থাৎ, ব্যস্ত থাকার অজুহাত ধোপে টিকে না। দুষলে দুষতে হয় আমার রাজনীতিবিমুখতা কিংবা বরাবরের ভুলোমনাকে। কিন্তু আসলেই কি সব দোষ আমার? আবার চেষ্টা করলাম একটা অজুহাত দাঁড় করাতে। এত বড় একটা নির্বাচন, অথচ কোথাও একটি পোস্টার, ফেস্টুন, মিছিল, মিটিং, গাড়িবহর, মোটর, শোভাযাত্রা, ব্যানার, ধড়পাকড়, জনসভা, পথসভা, উঠোনবৈঠক, গোল-মিটিং, সংবর্ধনা সভা, হঠাৎ সভা, চা-বিস্কুট পান-তামাক খাওয়ানো, মারামারি, হানাহানি, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, স্টাফরুমে উত্তপ্ত আলোচনা, চা-দোকানের সরগরম, দেয়াল লিখন, অমুক ভাইয়ের চরিত্রকে দুধে ধোয়া তুলসিপাতা বানানোর চেষ্টা, প্রার্থীদের নরম গরম শ্লীল-অশ্লীল সভ্য অসভ্য কথার চালাচালি, পরস্পরের প্রতি কাদা ছোড়াছুড়ি, নির্বাচন কমিশনারের পক্ষপাতিত্ব নিয়ে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান, কেন্দ্র দখল, রাতের অন্ধকারে ভোট প্রদান, ভেজাল ভোট, ভেজাল ভোট গণনা, এবং এসবের সম্মিলনে একরত্তি গণউত্তেজনা ও গণহিস্টিরিয়া নেই- এ কেমন নির্বাচন!
মাস খানেক আগে বাসায় একটা চিঠি এসেছিল এ বাসায় আমরা যারা ভোটার আছি, তাদের নাম-ধাম সাকিন ঠিক আছে কি-না, স্রেফ তার একটি পরীক্ষা হিসেবে। বলা হয়েছে, যদি সব ঠিক থাকে, তবে আমাদের আর কিছু করার নেই, শুধু যথাসময়ে ভোট দিতে গেলেই চলবে। আর না হলে একটি নাম্বারে বা অনলাইনের একটি লিংকে যোগাযোগ করে তথ্য হালনাগাদ করতে হবে। আমাদের জন্য তথ্যগুলো সব ঠিক ছিল। সুতরাং, চিঠি পড়ে রেখে দিলাম, এবং সে চিঠি সপ্তাহ পরিক্রমায় আরো অনেক কাগজের ভিড়ে যথানিয়মে হারিয়ে গেছে! এদিকে একটি সাদামাটা চিঠি পাঠিয়েই কর্তৃপক্ষ হাত ধুয়ে ফেলেছে, এরপর আর কোনো খোঁজ-খবরই নেই! ভোটার হিসেবে আমাদের একটা মান-ইজ্জতও তো আছে, না-কি! সুতরাং, যে নির্বাচনে আমাকে সম্মাানিত ভোটার হিসেবে কোনো ইজ্জত দেওয়া হয়নি, সে নির্বাচনে আমি নাই-বা গেলাম। তারও ওপর, যে নির্বাচনের ভোটকেন্দ্র খুঁজতে রীতিমত গুগল ম্যাপের সাহায্য নেওয়া লাগে, সেটা বোধহয় কর্তৃপক্ষ চুপি-চুপিই সেরে ফেলতে চায়। সুতরাং, আমি এমন একটি বালখিল্য অভিমানকে ঢাল হিসেবে দাঁড় করিয়ে সান্তনা পেতে চাইলাম, কিন্তু মন তাতে পুরো সায় দিলো না। নাগরিক হিসেবে নাগরিক কর্তব্য করাটা দরকার ছিল। কাজটা ঠিক হয়নি আমার।
পরদিন পত্রিকায় জানলাম, নাহ, আমি এক নই। লণ্ডনের প্রতি একশো জন নাগরিকের অন্তত ষাট ভাগ নাগরিক আমার মতো মেয়র নির্বাচনে ভোট দিতে যায়নি। মাত্র চল্লিশ দশমিক পাঁচ ভাগ মানুষ এ নির্বাচনে ভোট দিতে গিয়েছে, যেটি গত দুই হাজার একুশ সালের মেয়র নির্বাচনের তুলনায় এক দশমিক পাঁচ ভাগ কম। কিন্তু এ পরিস্থিতি কেন? ব্রিটেনকে বলা হয় গণতন্ত্রের সূতিকাগার। একটি অঞ্চলের অর্ধেকেরও কম মানুষ যদি ভোট দিতে যায়, তবে সে ভোটে যিনি জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন, তিনি আসলে বড় জোর এক চতূর্থাংশের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় আরোহন করেন। একে চাইলে ব্যর্থ গণতন্ত্র বলা যায় নাকি?
আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং রাজনীতিবিজ্ঞানে যেহেতু মূর্খ, তাই এসব বড় বড় বুলি কপচানো বাদ দিয়ে ঠিক করলাম, আমাদের স্টাফরুমে ব্রিটেনের মানুষদের ভোটের প্রতি অনীহার আলোচনাটা একটু তুলে দেওয়া যাক। দেখি, শিক্ষকরা এ নিয়ে কী ভাবছেন। স্টাফরুমে আমরা মোট চারজন। ক্লাসের ফাঁকে বসে আছি। জাতিতে একজন একজন ব্রিটিশ, একজন আফ্রিকান, একজন ইন্ডিয়ান, অন্যজন আমি । আফ্রিকান এবং ইন্ডিয়ান বললাম বটে, তবে ঐ দুইজনেরও এদেশেই জন্ম। আমি কেবল বড় বেলায় এদেশে এসেছে, ইংরেজি বলার আগে মাথার মধ্যে আগে ট্রান্সলেশান করে নিতে হয়। প্রথম সুযোগেই আমি ভোটের আলোচনা তুলে ফেললাম। স্পষ্ট দেখলাম, তিনজনই ভ্রু কুঁচকে তাকালেন, এবং প্রবল অবিশ্বাস নিয়ে আমি জানলাম যে তিনজনের একজনও ভোট দিতে যায়নি। না, তারা কেউই আমার মতো নির্বাচনের কথাটা ভুলে যাননি, কিংবা অন্য কোনো অজুহাতের কারণেও তাদের ঐ অনাগরিকসুলভ আচরণ নয়। তাদের না যাওয়ার কারণটা অনেকটাই সোজাসাপ্টা। ব্রিটিশ ভদ্রলোক প্রথম বাক্যেই বললেন, হু কেয়ারস? ভোট দিতে কেন যায়নি – সেটা আরেকটু বিস্তারিত জানতে গেলে সে বেশ অট্ট হাসি দিয়ে খোঁচা দিলো, তোমার কি ধারণা আমার আর করার মতো আর্কষণীয় কিছু নেই? ভদ্রলোক এখনো ত্রিশ পার হননি। আমাদের বাকি তিনজনের তুলনায় অনেকটাই বয়স কম। সুতরাং, তার থেকে আরো কিছু শোনার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু উনি আর আলোচনায় অংশ নিতে অপারগতা বোঝালেন তার সামনে থাকা বাচ্চাদের পরীক্ষার খাতা কাটা-কুটিতে ডুবে গিয়ে। আফ্রিকান ভদ্রলোক বিজ্ঞের হাসি হাসতে হাসতে বললেন, কাকে ভোট দিবো? সব সমান। ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত সব সাধু। সবগুলো সমান করাপ্টড। তারপর সে গত প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের কীর্তিকলাপ, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক যে চতুর কৌশলে তার স্ত্রীর কর ফাঁকি দেওয়াটাকে এড়িয়ে গেছেন – সেসব, ইইউ ভোট নিয়ে তামাশা, এমন বিষয়-আশয় নিয়ে বেশ দীর্ঘ আলাপচারিতা চালিয়ে গেলেন। আর ইন্ডিয়ান ভদ্রমহিলা তার ব্যাগ থেকে একটি ছোট্ট কৌটো বের করে, তার ভেতরে রাখা বাদাম জাতীয় কিছু আস্তে করে চিবুতে চিবুতে বললেন, স্যার, ও যারা নির্বাচিত হবার, তারা আগেই ঠিক করা থাকে। শুধু কেবল তোমার আমার উপস্থিতির মাধ্যমে ওটিকে বৈধতা দেবার চেষ্টা। আমি একসময় খুব আগ্রহ করে যেতাম। এখন আর যাই না। আমার হাজবেণ্ড অবশ্য যায়। তবে আমার কোনো আগ্রহ নেই। নির্বাচন প্রক্রিয়ার উপর এতবড় অনাস্থাসূচক অভিযোগ, অথচ তিনি দেখলাম দিব্যি হাসিমুখে কথাটা বলে তার বাদাম চিবুনোতে মন দিলেন।
বলাবাহুল্য, এরপরে আর উৎসাহব্যঞ্জক আলোচনা চলে না। আমি দমে গেলাম। আফ্রিকান ভদ্রলোকের বোধহয় আমার মুখ দেখে মায়াই হলো। জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের দেশের নির্বাচনের কথা বলো। ওখানে মানুষের আগ্রহ আছে? আমি বিপুল উৎসাহ নিয়ে বললাম, আগ্রহ আছে মানে? ভোটের চেয়ে বড় উতসব আমাদের আর কিছু নেই। ঐ সময় আমরা সব নাওয়া-খাওয়া ভুলে যাই। জীবন-যাপনের চব্বিশ ঘন্টার একটি ঘন্টাও এ আলোচনা ছাড়া আমরা থাকতে পারি না। এসব সাধারণ কথা-বার্তা বলা শেষ করে বেশ গর্বের সাথে যোগ করলাম, সারাবিশ্বে এ মুহূর্তে আমাদের চেয়ে রাজনীতিমনস্ক আর কোনো জাতি আছে বলে আমি মনে করি না। ব্রিটিশ ভদ্রলোক এতক্ষণ তার কাজ করে যাচ্ছিলেন। এবারে চকিতে আমার দিকে তাকালেন। অন্য দুইজনেরও দৃষ্টি আমার দিকে। আমি গা করলাম না যদিও, তবে কেন জানি মনে হলো, তিনজনের চোখের দৃষ্টিই একটি আপ্তবাক্য স্মরণ করিয়ে দিতে চাচ্ছে আমাকে: টু মেনি কুক, স্পয়েল দ্য ব্রুথ।
লণ্ডন, ২৪ মে ২০২৪
লেখক: কবি, কথা সাহিত্যিক