লন্ডনের চিঠি
সাগর রহমান ♦
ঘরটাতে পা দিয়েই মনে হলো, পাড়ি জমিয়েছি দূর অতীতে। এ ঘরের প্রতিটি আসবাবপত্র: ছাত্র-ছাত্রীদের বসার বেঞ্চ, শিক্ষকের টেবিল, টেবিলের পেছনে দাঁড়ানো দুটো বড় কাঠের আলমিরা, প্রমাণ সাইজের দুটো লেখার বোর্ড, পেছনের দেয়ালে রাণী ভিক্টোরিয়ার সাদা-কালো পোট্রেট- সবকিছুই বলছে সময়টা বর্তমানের নয়। বোর্ডের ওপরে লেখা তারিখের উপরে চোখ পড়তেই ধারণাটা স্পষ্ট হলো। ওখানে, উপরের ডানকোণায় লেখা: ২৪ মে, ১৮৯৪। বাহ, রীতিমত একশো তিরিশ বছর পেছনে চলে এসেছি। বসে আছি ভিক্টোরিয়ান ইংল্যাণ্ডের এক ক্লাস ঘরে, লণ্ডনের র্যাগেড স্কুলে, বর্তমানে যা র্যাগেড স্কুল মিউজিয়াম নামে প্রতিষ্ঠিত। এই ক্লাসরুমটা এমনভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে যে কড়িবরগায় ঝোলা কয়েকটি ইলেকট্রিক বাতি আর স্মোক এলার্ম বাদ দিলে আপনার মধ্যে খানিক দ্বিধা জমে উঠতেই পারে যে, সময়তীরের উল্টোদিকে ভ্রমণ করে পৌঁছে গেছেন উনবিংশ শতাব্দীর এক দুপুরে।
আমরা তিনজন শিক্ষক, ত্রিশজন ছাত্র-ছাত্রী। ক্লাস-আউটিংয়ে গিয়েছি পূর্ব লণ্ডনের মাইল-এন্ড পার্কের পাশে অবস্থিত র্যাগেড স্কুল মিউজিয়ামে। মিউজিয়ামের অন্যতম আর্কষণ এই ক্লাসঘরটি, উদ্দেশ্য- ভিক্টোরিয়ান আমলের বাচ্চাদের ফ্রি শিক্ষা ব্যবস্থার রূপটি কেমন ছিল, কেমন হতো তাদের প্রাত্যহিক ক্লাসের অভিজ্ঞতা- সে ইতিহাসটি বর্তমান কালের মানুষদের দেখানো, জানানো। আমরা ক্লাসে ঢুকতেই দেড়শো বছর আগের স্টাইলে পোশাক পরা এক শিক্ষিকা আমাদের তিন শিক্ষককে ঘরের এক পাশে রাখা একটি লম্বা কাঠের সোফায় বসতে দিয়ে বললেন, আগামী ত্রিশ মিনিট আপনাদের বাচ্চারা আমার ক্লাসের স্টুডেন্ট, সুতরাং, আপনাদের আপাতত চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছু করার নেই, রিল্যাক্স এণ্ড এনজয় দ্য শো। বলে তিনি অর্থপূর্ণ হাসলেন। তার হাতে একটি লম্বা বেত। সেটির ডগা বাতাসে নাচছে। আমাদেরকে একপাশে বসিয়ে দিয়ে পরমূহুর্তে তিনি ক্লাসের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। টেবিলে রাখা শিক্ষকের বিশেষ কায়দার চশমাটি নাকের ডগায় পরলেন, তারপর হাতের বেতটি দিয়ে সজোরে আঘাত করলেন নিজের টেবিলে। ত্রিশজন ছাত্র-ছাত্রী এতক্ষণ বেশ কলকল করে যাচ্ছিল, তার বেতের শপাং শব্দে স্পষ্টতই আঁতকে উঠে তার দিকে এক নিমেষে ফিরে তাকালো। ভদ্রমহিলার ততক্ষণে রুদ্র মূর্তি। বোর্ডে লেখা তারিখটি দেখিয়ে কড়া গলায় বললেন, “আজ চব্বিশ মে, আঠারোশ চুরানব্বই। ব্যাসিক রুল: প্রত্যেকের হাত থাকবে হাঁটুর উপরে, পিঠ থাকবে টান টান, কোন ব্যাঁকত্যাড়া বসা যাবে না, কোনো প্রশ্ন করা যাবে না, শিক্ষক প্রশ্ন করলে উত্তর জানা থাকলে হাত তুলতে হবে, অনুমতি ছাড়া কোনো উত্তর দেওয়া যাবে না, ফিসফিস করে এক বিন্দু কথা বলা যাবে না…“ এমন বেশ কিছু নিয়মকানুন জানিয়ে দিয়ে হাতের বেতটি নাচালেন বাতাসে, এবং সেটির দিকে ইংগিত করে বললেন, অন্যথায় এটি পড়বে পিঠের উপরে। আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা জানে যে, এর পুরোটাই অভিনয়, কিন্তু তারপরও ভদ্রমহিলার অবিশ্বাস্য অভিনয় গুণে মনে হতে লাগলো হয়তো সত্যি সত্যি তিনি বুঝি বেত ব্যবহার করে বসবেন। যে ছাত্র-ছাত্রীগুলোকে ক্লাসে চুপচাপ রাখতে আমাদের রীতিমত হিমশিম খেতে হয়, তারাও দেখলাম, কী যাদুমন্ত্রবলে চুপসে আছে, একদম স্পিকটি-নট অবস্থা, চোখে-মুখে ভয়!
প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীকে একটি করে শ্লেট এবং চক দেওয়া হলো, সাথে লেখা মোছার জন্য এক টুকরো ছোট কাপড়। ক্লাস শুরু হলো বর্ণ পরিচয় দিয়ে। দুটো বোর্ডের একটিতে সেই পুরনো আমলের প্যাঁচানো ইংরেজি অক্ষর লেখা। বেতের ডগা ব্যবহার করে শিক্ষিকা একটি একটি করে বর্ণ উচ্চারণ করে গেলেন, ছাত্র-ছাত্রীদেরকে তার সাথে সাথে সুর করে পড়তে হলো। এ থেকে জেড, জেড থেকে এ- এমন করে দুইবার পড়া শেষ হলে কয়েকটি শব্দ শেখালেন। এর মাঝে কেউ বিন্দুমাত্র শব্দ করলে তিনি বিকট চিৎকার করে উঠলেন, মনের ভুলে কেউ একটু বাঁকা হয়ে বসলেই পিঠ সোজা করে বসার নির্দেশ দিলেন, হাত নিজের কোল ছেড়ে ভুলক্রমে বেঞ্চির উপরে উঠে এলে সেটা যথাস্থানে ফিরিয়ে নেবার জন্য ভৎর্সনা করলেন। একটি ছেলে পানির বোতল খুলতে গেলে তিনি সেটা কেড়ে নিয়ে বললেন, আগামী আধাঘন্টায় তোমার ডিহাইড্রেশান হয়ে যাবে না, ক্লাসে কোনোরকম খাওয়া কিংবা পান- পুরোপুরি নিষিদ্ধ। বর্ণমালা শেখা হলে তিনি সবাইকে বললেন, বোর্ড দেখে দেখে শ্লেটে সেটা লেখার অভ্যাস করার জন্য। এভাবে ইংরেজির ক্লাস শেষ হলে ভদ্রমহিলা এবার অন্য বোর্ডটির দিকে এগিয়ে গেলেন। সেখানে “স্টালিং মানি টেবিল“ লেখা। আবার শুরু হলো সুর করে করে পড়ানো: এক ফার্দিংস = এক পেনি, দুই হাফপেনিংস = এক পেনি, পাঁচ শিলিং = এক ক্রাউন…। বোর্ড জুড়ে এমন বেশ কয়েকটি ভিক্টোরিয়ান আমলে ব্যবহার হওয়া টাকা-পয়সার হিসেব লেখা। হঠাৎ একটি বাচ্চার দিকে তার দৃষ্টি গেল। বেচারা একটু শরীর হেলান দিয়ে বসেছিল। ভদ্রমহিলা তাকে উঠে এসে ক্লাসের সামনে আসতে বললেন। তারপর টেবিলের উপরে রাখা বিশেষভাবে কাটা একটি কাঠের ছোট টুকরো তার পিঠের সাথে ধরে দুই হাতে সেটা আটকে দিয়ে বললেন, সোজা হয়ে না বসতে পারার শাস্তি। এভাবে তোমাকে বাকি ক্লাস দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। অন্য একজন মাথা চুলকাচ্ছিল বলে তাকেও ডেকে নিলেন। হাতের চার আঙুল ঢোকানো যায় এমন চারটি গর্ত করা দুটো ছোট্ট কাঠের টুকরোয় বেচারার দুই হাত আটকে দিয়ে তাকেও দাঁড় করিয়ে দিলেন। এরপর শুরু করলেন এতক্ষণ যা পড়াচ্ছিলেন, তার পরীক্ষা নেওয়া। তার প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারা দুইজনকে ডেকে নিয়ে পরিয়ে দিলেন লম্বা কাগজের টুপি। যাতে লেখা: ডি। ডি ফর ডানকি। অর্থাত, পড়া না পারার শাস্তি স্বরুপ এই গাধার টুপি। এরপর শুরু হলো নীতি শিক্ষার ক্লাস। কীভাবে জীবনে চলা উচিত, কীভাবে দৈনন্দিন জীবনে আচার-আচরণ করা উচিত- সেসব নিয়ে সেই সুরে সুরে নীতিশিক্ষা দেওয়া। পড়ালেন: তুমি যদি ভাল হও, তবে ভালতর হওয়ার জন্য নিরন্তর চেষ্টা করা উচিত, আর যারা ভালতর, তারা সেরা না হওয়া পর্যন্ত থামে না।
চোখের সামনে অভিনীত হতে যাওয়া আঠারোশ চুরানব্বইয়ের একটি ক্লাসঘরের ছবি কখন যে আমার নিজের ছোটবেলার স্মৃতির ঝাঁপিটি খুলে দিলো। স্পষ্ট দেখলাম, সুলতারপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভাঙা শিশুক্লাসে বসে আছি। বোর্ডের মধ্যে লেখা: অ আ ক খ, ১ ২ ৩। হুজুর স্যার পড়াচ্ছেন, সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলে, সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি। স্পষ্ট শুনলাম, দল বেঁধে গলার স্বর সপ্তমে চড়িয়ে স্যারের সাথে সাথে পড়ে চলেছি: দুই একে দুই, দুই দুগুনে চার, তিন দুগুনে ছয়…। বাইরে রোদ চক চক করছে। খোলা জানালায় হাওয়া খেলে যাচ্ছে। রমনী ডাক্তারের পাগলা চিকিৎসালয়ের সামনে বেঁধে রাখা পাগলটি এই থেকে থেকে হা হা করে হেসে উঠছে তো পর মুহূর্তে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। স্যারের হাতে নাচানো জোড়া বেতটির ভয়ে গলা ফাটিয়ে পড়ে যাচ্ছি বটে, কিন্তু দুষ্টুমির সাথী সহপাঠির সাথে চোখে চোখে কথা হচ্ছে, স্কুলের পর আজ কোন গাছে আম পাড়তে যাবো…। হুঁশ করে দীর্ঘশ্বাস পড়লো আমার। আমার স্কুল শিক্ষার বয়স ভিক্টোরিয়ান আমলের নয়, কিন্তু এ দেখি পুরোপুরি একই ব্যাপার! এদিকে র্যাগেড স্কুলের ক্লাস শেষ হলো। চোখ থেকে শিক্ষকের বিশেষ চশমাটি নামিয়ে রাখতে রাখতে এতক্ষণে হাসলেন শিক্ষিকা। বললেন, ওয়েলকাম ব্যাক টু দ্য টু থাউজেন্ড টুয়েন্টি ফোর। আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা যেন নি:শ্বাস ফেলার সুযোগ পেলো এতক্ষণে। বেত উধাও, উধাও শাস্তির নানান উপকরণও। পথের পাঁচালি উপন্যাসে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় নিশ্চিন্দপুর গ্রামের প্রসন্ন গুরুমহাশয়ের পাঠশালায় বর্ণনা লিখেছিলেন: “… বেত ছাড়া পাঠশালায় শিক্ষাদানের বিশেষ উপকরণ-বাহুল্য ছিল না। তবে এই বেতের উপর অভিভাবকদেরও বিশ্বাস গুরুমহাশয়ের অপেক্ষা কিছু কম নয়। তাই তাঁহারা গুরুমহাশয়কে বলিয়া দিয়েছিলেন, ছেলেদের শুধু পা খোঁড়া এবং চোখ কানা না হয়, এইটুকুমাত্র নজর রাখিয়া তিনি যত ইচ্ছা বেত চালাইতে পারেন…“। আমাদের ছোটবেলায়ও অনেক অভিভাবককে তাদের ত্যাঁদড় বাচ্চাদের উপরে শিক্ষকের বেত্রাঘাতকে স্বাগত জানাতে বলতে শুনেছি, স্যার, এই ছেলের হাড্ডি আমাদের, মাংস আপনার…। জেনে অবাক হলাম যে, ১৯৮৬ পর্যন্তও এ দেশের স্কুলগুলোতে বেতের নিত্য ব্যবহার ছিলো!
শিক্ষিকা এবারে এই র্যাগেড স্কুলের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বলতে লাগলেন। র্যাগেড স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল থমাস বার্নাডো নামক এক মহামতি ভদ্রলোকের হাত ধরে। ১৮৬৬ সালে ভদ্রলোক ডাবলিন থেকে লণ্ডনে এসেছিলেন ডাক্তারি পড়বেন বলে। কথা ছিল, ডাক্তারি পড়া শেষ হলে মিশনারি হয়ে চলে যাবেন চীনে। কিন্তু চোখের সামনে দেখলেন এমন এক শহর যেখানে নাগরিকেরা, বিশেষত শ্রমজীবি মানুষরা ঠাসাঠাসি করে বাস করে, রোগে ভুগে ভুগে বেঁচে থাকে কোনোক্রমে, আর যাদের বাচ্চারাও খুব ছোট বেলাতেই ঢূকে পড়ে মাঠের কাজে, কেননা, এসব গরীব বাচ্চাদের পড়াশোনার কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। থমাস দেখলেন, পূর্ব লণ্ডনের মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া কলেরায় তিন হাজারেরও বেশি মানুষ কীভাবে ধুঁকে ধুঁকে মারা যায়, যে রোগ হয়তো খানিকটা শিক্ষা-দীক্ষা থাকলে কত সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যেতো। থমাস নিজের ডাক্তারি পড়া এবং চীনে যাওয়ার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা বাদ দিয়ে লেগে পড়লেন এ এলাকার কাজে। ১৮৬৭ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন শ্রমজীবি মানুষদের বাচ্চাদের জন্য “র্যাগেড স্কুল“ যেখানে ফ্রি-এডুকেশান দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে এসে পড়ে নতুন শতাব্দী। ততদিনে শিক্ষা বিস্তারের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে চোখে পড়ার মতো উদ্যোগ শুরু হয়েছে। এলাকায় এলাকায় সরকারী স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে “র্যাগেড স্কুল“ এর মতো ব্যাক্তি মালিকাধীন স্কুলগুলোর প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যেতে শুরু করলে ১৯০৮ সালে বন্ধ হয়ে যায় থমাস বার্নাডের স্কুলটি। ততদিনে তার স্কুল থেকে হাজার হাজার বাচ্চা জীবনের জন্য অতি প্রয়োজনীয় প্রাথমিক শিক্ষা পেয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে, সারা বিশ্বে। ১৯০৮ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া স্কুল বিল্ডিংটি পরবর্তী সত্তুর বছর পর্যন্ত নানা ধরনের কাজে ব্যবহৃত হয়েছে, কিন্তু ১৯৮০ সালের দিকে বিল্ডিংটির এমন অবস্থা হয় যে এটি ভেঙে ফেলার কথা উঠে। কিন্তু বহু স্মৃতি বিজড়িত স্কুলটির ভেঙে ফেলার কথায় বাগড়া দেয় স্থানীয় কিছু মানুষ। নিজেদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে বিবেচিত হওয়া স্কুলটি রক্ষায় তারা প্রতিষ্ঠা করেন র্যাগেড স্কুল মিউজিয়াম ট্রাস্ট, এবং এই ট্রাস্টের হাত ধরেই ১৯৯০ সালে স্কুলটির যাত্রা শুরু হয় মিউজিয়াম হিসেবে।
ক্লাস ঘরের বাইরে থমাস বার্নাডের একটি আবক্ষ ছবি আছে। সাদা কালোয় তোলা বেশ বড় আকারের ফটোগ্রাফ। ভারী শরীরের থমাসের মাথায় সেই আমলের কালো হ্যাট, ঠোঁটের উপরে ঝুলছে মোটা চুমরানো গোঁফ, গোল ফ্রেমলেস চশমা। থ্রি পিস স্যুটে সজ্জিত ভদ্রলোকের মুখ ভয়ংকর থমথমে, দেখলেই মনে হতে পারে এই বুঝি ধমকে উঠলেন। আরেকটি ছবি দেখলাম হল ঘরে, একটি বেঞ্চিতে বসে আছেন পায়ের উপর পা তুলে, তাকে ঘিরে বেশ কয়েকটি বাচ্চা, বসে কিংবা কিংবা দাঁড়িয়ে আছে তার পাশ ঘেঁষে, প্রত্যেকের মুখে হাসি। কিন্তু থমাস? সেই রাশভারী চেহারা, ভ্রুঁ কুঁচকানো।
ছবি দুটো আমি খুব ভালো করে দেখলাম, এবং দেখে মনে হলো, এই মহৎপ্রাণ মানুষটির ভ্রুঁ কুঁচকানো রাশভারী চেহারার পেছনে কুলকুল করে বইছে যে মানবিকতার বোধ, মানুষের প্রতি, মানুষরে অধিকারের প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসা ও কর্তব্যবোধ, তা তার সর্বাংগে এমন করে লেপ্টে আছে যে এই ভদ্রলোককে ক্যামেরার সামনে লোক দেখানো ত্যালত্যালে হাসি হাসতে হয় না।
র্যাগেড স্কুল মিউজিয়ার ভিজিট শেষ করে বাইরে বেরিয়ে এলাম। আমাদের বাচ্চারা তাদের সদ্য পাওয়া ভিক্টোরিয়ান স্কুলের অভিজ্ঞতা আলোচনা করতে করতে চলেছে নিজেদের কিং চার্লস আমলের স্কুলের দিকে। এই স্কুলটি ঠিক পাশ ঘেঁষে একটি খাল বয়ে চলেছে। হাঁটছি খালের পাশ ঘেঁষে। বাইরে সতেজ রোদ। নীল আকাশ। বাতাস বইছে। ভাবছিলাম, একটি দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের মতোই গুরুত্বপূর্ণ তার ইতিহাস-ঐতিহ্য। সেই ঐতিহ্য রক্ষা করার কায়দাটি ইংরেজদের এত ভালো আর কেউ পারে বলে আমার জানা নেই।মনে পড়লো, থমাসের মতো এমন কত অসংখ্য মহৎ প্রাণের কাজে, চিন্তায়, আত্মত্যাগে, দানে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের বাংলাদেশের কত অসংখ্য প্রতিষ্ঠান- আমি নিজে যেই স্কুলে পড়েছি, সেটির প্রতিষ্ঠাও হয়েছে হানিফ নামক এক ভদ্রলোকের দানে- তাদেরকে মনে রাখা আমাদের কর্তব্য। ঐতিহ্য হচ্ছে দেশের বুনিয়াদ, যার উপরে ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে থাকে পরবর্তীকালের সব অর্জন। যে কোনো দেশের টেকসই উন্নয়নের অন্যতম পূর্ব শর্ত তার পূর্বাতিহাস ও ঐতিহ্যটিকে জানা, লালন করা, এ অনেকটা পুষ্টির মতো, দেখা যায় না, কিন্তু যাকে ছাড়া সব অচল হতে বাধ্য- এ সত্যটি যেন মনে থাকে আমাদের।