নজরুল ইসলাম বাসন ♦
বৃহত্তর সিলেটের সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে খুব একটা ভাল কথা শোনা যায় না। তার কারণ হল সরকারি হাসপাতালগুলোতে রয়েছে অনিয়ম ও কর্তব্যে অবহেলা, জবাবদিহিতার অভাব। বেসরকারি হাসপাতালগুলো ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে সিলেট শহরে গড়ে উঠেছে। তাদের রয়েছে সুরম্য প্রাসাদোপম হাসপাতাল, এসব হাসপাতালের ভবনগুলোই সার। এসব দেশী বিদেশী বাহারী নামের হাসপাতালগুলোর ব্যবসাও ভালো, তবে স্বাস্থ্য সেবার মান কতটুকু তা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই বলতে পারবেন। বছর দুয়েক আগে ব্রাক-এর সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আহমদ মোশতাক রাজা চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ ‘স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের বিকাশ’ একটি গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলো। এতে স্বাস্থ্য খাতের সমস্যা ও সমাধানের কথাও বলা হয়েছে। এই গ্রন্থের গবেষণায় দেশী বিদেশী প্রথিতযশা শতাধিক পেশাজীবী অংশ নিয়েছিলেন।
উল্লেখিত এই গ্রন্থে আমেরিকা ও ব্রিটেন প্রবাসীদের অবদানের কথা ও সংযোজন করা হয়েছিল আমেরিকার পবের্র কথা লিখেছিলেন খ্যাতিসম্পন্ন চিকিৎসক ডা: জিয়া উদ্দিন আহমদ, লণ্ডন পর্বের কথা লিখেছিলেন জেনারেল প্রাকটিশনার ডা: ফাহিম ও এই প্রতিবেদক লিখেছিলেন ব্রিটেন প্রবাসীদের অবদানের কথা।
আমার কাজ ছিল সিলেটের স্বাস্থ্যখাতে অনাবাসি বাঙালিদের কি ধরনের অবদান রয়েছে এই তথ্য সংগ্রহ করা। এখানে বলে রাখি, গত তিন দশকের অধিক মিডিয়াতে কাজ করার সুবাদে আমার মোটামুটি জানা আছে সিলেট শহরে হার্ট ফাউণ্ডেশনের হাসপাতাল, লায়ন্স শিশু হাসপাতাল, জালালাবাদ রোটারি শারিরীক অক্ষমতাসম্পন্নদের জন্যে হাসপাতাল, বিয়ানীবাজারে ক্যানসার হাসপাতাল, গোয়াইনঘাটে জাস্ট হেল্প আই হাসপাতালগুলোতে ব্রিটেন প্রবাসিদের ও বিরাট অংকের আর্থিক সহযোগিতা রয়েছে। আমার জানামতে জগন্নাথপুর, বিশ্বনাথ, কুলাউড়া, নবীগঞ্জের মত উপজেলাগুলোতে অনাবাসি বাঙালিরা অলাভজনক সেবামূলক হেলথ সেন্টার গড়ে তুলেছেন। এসব হেলথ সেন্টারের সাথে বেশ জড়িত বেশ কিছু ব্রিটিশ বাঙালি ডাক্তারের নামও সংগ্রহ করেছিলাম, যারা ব্রিটেনে এনএইচএসে কাজ করেছেন এবং করছেন এখন নিজেদের এলাকায় হেলথ সেন্টার প্রতিষ্ঠা করে স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। এই মহতী উদ্যোগগুলোর সাথে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা সমাজকল্যাণ বিভাগের কোনও প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ নেই বল্লেই চলে, এই সংস্থাগুলোর নেকনজর থাকলে এই সামাজিক উদ্যোগগুলোর মধ্যে একটি পরিপূর্ণতা আসতো।
আমার আজকের লেখার শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের লব্ধ প্রতিষ্ঠিত প্রফেসর ডা: জিয়া উদ্দিন আহমদের নাম উল্লেখ করেছিলাম। তাঁর জনক একাত্তরের শহীদ সার্জন ডা: শামস উদ্দিন আহমদ ও মাতা অধ্যক্ষা হুসন আরা আহমদকে আজও সিলেটের মানুষ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। অধ্যক্ষ হুসন আরা আহমদ, ব্রাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ, ‘ফ্রেণ্ডস অব ভিলেজ ডেভেলপমেন্ট’-এর প্রতিষ্ঠাতা যেহীন আহমদ একদিন স্বপ্ন দেখেছিলেন সিলেটে একটি কিডনি হাসপাতাল করার। তাদের উৎসাহ ও প্রেরণায় একদল স্বপ্নবাজ মানুষ প্রতিষ্ঠা করলেন ‘কিডনি ফাউণ্ডেশন সিলেট’। বছর ছয়েক আগে সিলেটের উপশহরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কিডনি হাসপাতাল স্বল্পমুল্যে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে দরিদ্রদের জন্য বিনামুল্যে ডায়ালাইসিস দেয়ার উন্নত চিকিৎসার এক নজির সৃষ্টি করলেন কিডনি হাসপাতালের চিকিৎসক ও স্টাফবৃন্দ। উদ্যোক্তাদের আগ্রহ ও উৎসাহ গেলো বেড়ে। এই মহতী উদ্যোগের সাথে জড়িত হলেন মুক্তিযুদ্ধের বীর উত্তম খেতাবে মেজর জেনারেল আজিজুর রহমান, শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী, শহীদ শামস উদ্দিন আহমদ ফাউণ্ডেশন। বাদাঘাটে সুনামগঞ্জ রোডের তেমুখিতে সমাজহিতৈষী জুবের আহমদ চৌধুরী ৫ কোটি টাকার ভূমি বিনামূল্যে দান করে দিলেন। শ্রদ্ধেয় কর্ণেল আব্দুস সালাম বীর প্রতীকের নেতৃত্বে শুরু হল হাসপাতালের নির্মাণ কাজ। শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী আপার ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়- ‘ফিল্ড মার্শাল’-এর নেতৃত্বে পাবলিক প্রাইভেট প্রকল্পের ১০তলা বিশিষ্ট ভবনটি এখন আকাশের দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে গেছে। ২০২৫ সালের মধ্য জানুয়ারিতে এর আনুষ্ঠানিক যাত্রাও শুরু হওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। এই হাসপাতাল যে ভিন্ন মান আর রুচি নিয়ে শুরু হতে যাচ্ছে এর প্রমাণ- ভবনের সৌন্দর্য্য বর্ধনের জন্যে ইতিমধ্যে বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে। বৃক্ষপ্রেমী সংগঠন অমরাবতি এতে সহযোগী হয়েছে। শুধু অমরাবতি নয় সাংস্কৃতিক সংগঠন নৃত্যশৈলী, শহীদ স্মৃতি উদ্যানের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং কমিউনিটি নেতৃবৃন্দও কিডনি ফাউণ্ডেশনের শুভাকাঙ্ক্ষী হিসাবে এগিয়ে এসেছেন। লণ্ডনে ও আমেরিকায় গঠিত হয়েছে কিডনি ফাউণ্ডেশনের সমর্থক ও শুভাকাঙ্ক্ষী সংগঠন। কিডনি ফাউণ্ডেশন সিলেট হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে যারা আছেন তারা নিছক ব্যবসাকে সামনে রেখে এই হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করছেন না। তারা চাইছেন চিকিৎসাকে দরিদ্র মানুষের নাগালে নিয়ে আসতে। এ জন্যে তারা শুভাকাঙ্ক্ষীদের অনুদান ও জাকাত ফাণ্ড নিয়ে থাকেন। দেশী-বিদেশী অনেক সমাজহিতৈষী ব্যক্তিবর্গ নিয়মিত আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে থাকেন। এই অর্থ দিয়ে স্বল্পমূল্যে কিংবা বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়া হয়ে থাকে।
কিডনি ফাউণ্ডেশনের সেক্রেটারি কর্ণেল আব্দুস সালাম বিপি ঘোষণা করেছেন নবনির্মিত এই হাসপাতালে একটি এনআরবি ডেস্ক প্রতিষ্ঠা করা হবে। এনআরবিম্বরা তাদের আত্মীয়স্বজনের চিকিৎসার ব্যবস্থা বিদেশে বসেই করতে পারবেন। শ্রদ্ধেয় ডা: জিয়া উদ্দিন আহমদ একজন মুক্তিযোদ্ধা ও শক্তিশালি সংগঠক তার দেশে বিদেশে রয়েছে বিরাট নেটওয়ার্ক। তিনি চাইলে টেলি-মেডিসিনের মাধ্যমে চিকিৎসা পরামর্শ দেওয়াতে পারবেন। লাইসেন্স কভার করলে অনলাইনে এই ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ ছাড়াও চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ ও অনলাইনে দেয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। শ্রদ্ধেয় কর্নেল আব্দুস সালাম বীর প্রতীক যেকোন ইনোভেটিভ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকেন। তিনি নিশ্চয়ই তার স্বপ্নের হাসপাতালে আধুনিক সকল সুবিধার সংযোজন করতে দ্বিধা করবেন না।
আগেই বলেছি সিলেট কিডনি ফাউণ্ডেশন হাসপাতাল একদল স্বপ্নবাজ মানুষের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত। গত ৫/৬ বছর ধরে কৃতিত্বের সাথে চলে আসছে এই হাসপাতাল। হাসপাতালের প্রাণশক্তি হলেন এর নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক, সেবক সেবিকা ও কর্মকর্তারা। কিডনি হাসপাতালের কর্মরত টিমের নিরলস প্রচেষ্টার ফলেই হাসপাতালটি মাত্র কয়েক বছর পরেই নতুন ধাপে পদার্পণ করতে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্ম এই হাসপাতালটিতে আধুনিক চিকিৎসা প্রদান করে সিলেটের স্বাস্থ্যখাতে আরেক উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।
লণ্ডন, ২৮ জুন ২০২৪
লেখক: সাবেক মিডিয়া এণ্ড পাবলিক রিলেশন্স অফিসার, টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল, লণ্ডন