মুহাম্মাদ মামুনুর রশীদ ♦
সিলেটের সাম্প্রতিক ঘন ঘন বন্যার কারণ হিসাবে উজানে ভারতে একদিনে অস্বাভাবিক মাত্রায় অতি ভারী বৃষ্টিপাতকে দায়ী করা হয়। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে, উজানের এই পানি সুরমা নদী দিয়ে বাঁধাহীন ভাবে প্রবাহিত হতে পারছে কি না। উজানের এই পানি প্রবাহিত হওয়ার পথে হাওরের উপর নির্মিত একাধিক বাঁধ ও সড়কের সম্মুখীন হয়, যেগুলোর মধ্যে কিশোরগঞ্জের মিঠামইন-অষ্টগ্রাম-ইটনা সড়ক অন্যতম। এই সড়কটি নির্মাণের আগে সিলেটের স্মরণকালের ইতিহাসে এমন ঘন ঘন আকস্মিক বন্যার নজির ছিল না। তাই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, এই বাঁধ ও সড়কের সাথে সিলেটের বন্যার কোনো সম্পর্ক আছে কি-না।
২১ জুন ২০২৪ ইংরেজি তারিখে ডেইলি স্টারে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘উজান থেকে নেমে আসা অতিবৃষ্টির পানি ধরে রাখতে ও পরিবহনে হাওর ও নদী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু ক্রমাগত অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প সংযুক্ত হাওরগুলোকে বিচ্ছিন্ন পকেট হাওর করে ফেলছে, ফলে বন্যা দীর্ঘায়িত হচ্ছে।’
২৭ জুন ২০২২ ইংরেজি তারিখে বণিক বার্তায় প্রকাশিত অপর এক সাক্ষাৎকারে পরিবেশ বিজ্ঞানী, টেকসই উন্নয়ন ও পানি সম্পদ বিশেষজ্ঞ এবং যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের লক হ্যাভেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. খালেকুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের হাওর অঞ্চলে কিছু মহাসড়ক বানানো হয়েছে এবং কিছু বাঁধ দেয়া হয়েছে সেচের জন্য। এতেও পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মিঠামইন-অষ্টগ্রাম-ইটনা ৩০ কিলোমিটার লম্বা মহাসড়কের মাধ্যমে আমাদের হাওর অঞ্চলকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। বর্ষাকালে হাওরে যখন পানি বেড়ে ওঠে, তখন এক নদীর পানি অন্য নদীতে গিয়ে পড়ে। তাতে পানির প্রবাহ চলমান থাকে। ফলে বন্যার প্রবণতা একটু কমে আসে। কারণ, হাওরে বর্ষাকালে সব নদী একটা বড় অঞ্চল হয়ে যায়, বড় একটা সাগরের মতো হয়ে যায়। বাঁধ দিয়ে কিংবা মহাসড়ক বানিয়ে সেটাকে খণ্ডিত করা হলে পানিপ্রবাহ বিঘ্নিত হয়। হাওরের যে মহাসড়কের কথা বলছি সেটিকে যদি হাওরের বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে করা হতো বা উড়াল সেতুর মতো নির্মাণ করলে এর নিচ দিয়ে পানি, মাছ, নৌকা সব যাতায়াত করতে পারত এবং হাওরের বৈশিষ্ট্য বজায় থাকত। এই ৩০ কিলোমিটার মহাসড়কে মাত্র ২ শতাংশ খোলা রাখা হয়েছে, অর্থাৎ সেতু রাখা হয়েছে। এর ন্যূনতম ৩০ শতাংশ অংশ খোলা রাখা প্রয়োজন ছিল’।
সিলেটে ঘন ঘন বন্যার কারণ অনুসন্ধানে সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো সমীক্ষা চালানো হয়েছে বলে জানা যায়নি । সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা বন্যার কারণ হিসাবে উজানে অতি বৃষ্টিপাত, নদী-হাওর ভরাট ও দখলকে দায়ী করছেন। নদী-হাওর ভরাট ও দখল আগেও ছিল। তাতে পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হলেও ঘন ঘন বন্যা হয়নি। গত কয়েক বছর ধরে কেন সুরমা নদী দিয়ে আগের মতো পানি নামছেনা? পানি প্রবাহের স্বাভাবিক গতিপথ কেন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে? সে প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা জরুরী ।
২০২২ সালে সিলেটে ভয়াবহ বন্যার পর ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে সুরমা নদী খনন কাজের উদ্বোধন করেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিলেট-১ আসনের সংসদ সদস্য ড. এ কে আব্দুল মোমেন। পরবর্তীতে এই প্রকল্প ঝিমিয়ে পড়ে। আর এগোয়নি। নদী খনন করে উজানের পানি কতটুকু ধারণ করা যাবে, সেটা নিয়ে যদিও শুরু থেকে প্রশ্ন ছিল। জানা যায় সুরমা নদীর তলদেশে বিপুল পরিমাণ পলিথিন বর্জ্য থাকায় নদীর খনন কাজ সম্ভব হয়নি। নদীর তলদেশে বিপুল পরিমাণ পলিথিন বর্জ্য আছে তা জানার পরও সেটা অপসারণ না করেই খনন কাজ বন্ধ করে দেওয়া কতটুকু সমীচীন হলো, সেটা ও আলোচনার দাবী রাখে।সরকার জেনেশুনে নদীর জীববৈচিত্র হুমকির মধ্যে রাখার দায় এড়াতে পারেনা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের চেরাপুঞ্জিতে একদিনে অস্বাভাবিক মাত্রায় ভারী বৃষ্টিপাত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। আগামীতে এই ধরণের অস্বাভাবিক মাত্রায় ভারী বৃষ্টিপাত প্রায়ই ঘটতে পারে বলে তাঁরা সতর্ক করে দিয়েছেন। তাই সুরমা নদীর পানি প্রবাহের পথ নির্ঝঞ্ঝাট ও নির্বিঘ্ন রাখা ছাড়া এই সমস্যা থেকে উত্তরণের কোন উপায় নেই।
সিলেট, ১লা জুলাই ২০২৪
লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট ও জজ কোর্ট, সিলেট