সারওয়ার-ই আলম
কী চাঞ্চল্যকর তথ্য! তালেবান সরকার আফগানিস্তানে নারী শিক্ষা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। নিষিদ্ধের ঘোষণাগুলো আসে দুই ধাপে। মঙ্গলবার ২০শে ডিসেম্বর প্রথম নিষেধাজ্ঞাটি জারি করা হয়। এদিন আকস্মিকভাবে নারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে তালেবান প্রশাসন। খবরটি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয় এবং বিশ্ব নেতৃবৃন্দের অনেকেই শক্ত ভাষায় এর প্রতিবাদ করেন। সরকারের এই অনাকাঙ্খিত সিদ্ধান্তে দেশটির বিভিন্ন স্থানে নারীরা প্রতিবাদে ফেটে পড়লে বুধবার ২২শে ডিসেম্বর সরকার আরো কঠিন অবস্থানে যায়। এদিন সকল প্রকার নারী শিক্ষা নিষিদ্ধের ঘোষণা আসে।
আফগান সরকারের ওয়েবসাইট থেকে এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানা না গেলেও যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত ডেইলি মেইল বার্তা সংস্থা এএফপি’র বরাত দিয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। কাগজটির ‘ ২২শে ডিসেম্বরের অনলাইন ভার্সন’-এ বলা হয়েছে, ‘ নারীর উচ্চ শিক্ষা নিষিদ্ধের পর তালেবান সরকার সকল প্রকার নারী শিক্ষা নিষিদ্ধ ঘোষণা করল’। শুধু তাই নয়, নারী শিক্ষকদের চাকুরীর ওপরও সরকারের এ নিষেধাজ্ঞা জারি হলো। ডেইলি মেইল বলছে, আফগানিস্তানের শিক্ষা মন্ত্রী নেদা মোহাম্মেদ নাদিম দেশটির সকল সরকারী ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেরিত এক চিঠির মাধ্যমে সরকারের এ নিষেধাজ্ঞার কথা জানান। ওয়াল স্ট্রীট জার্নালের বরাত দিয়ে ডেইলি মেইল আরো লিখেছে, গোলাম সারওয়ার হায়দারী নামে কাবুলের একজন দোকানদার তাঁর কন্যাকে টিউশন সেণ্টারে পাঠালে, তাকে বাড়ীতে ফেরত পাঠানো হয়।
যে মুহূর্ত সারা বিশ্বে নারীরা জ্ঞানে-বিজ্ঞানে পুরুষের সাথে পাল্লা দিয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে, সে মুহূর্তে তালেবান সরকারের এই রুঢ় সিদ্ধান্ত নি:সন্দেহে চরম হতাশাব্যঞ্জক। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে অনেকেই তালেবান সরকারের এ সিদ্ধান্তকে মানবতা বিরোধী হিসেবেও অভিহিত করেছেন।
তালেবান নারীর প্রতি যে নিপীড়নমূলক আচরণ করছে, তার সবই করছে ইসলামের দোহাই দিয়ে।তারা ইসলামী শরীয়াভিত্তিক রাষ্ট্র কায়েম করতে চায়। কিন্তু ইসলামের নামে নারীর প্রতি এই বৈষম্যমূলক আচরণ ইসলাম কতটা সমর্থন করে তা খতিয়ে দেখার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। নারী শিক্ষা বিষয়ে বিভিন্ন ইসলামী মতাদর্শের অনুসন্ধানে জানা যায়, ইসলাম কার্যত নারী শিক্ষা নিষিদ্ধতো করেই নি, বরং পুরুষের পাশাপাশি নারী শিক্ষাকেও সমান গুরুত্ব দিয়েছে।
অনুসন্ধান করে জানা যায়, আল-তিরমিযি হাদিস সংকলনে হযরত আনাস রা: বর্ণিত ২১৮ নম্বর হাদীসে বলা হয়েছে, ‘’ জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক নর-নারীর ওপর ফরজ’’। এখানে লক্ষ্যণীয় যে, এ হাদীসে শুধুমাত্র পুরুষ বা শুধুমাত্র নারী শিক্ষার কথা বলা হয়নি। বলা হয়েছে নারী পুরুষ উভয়ের কথাই। এবং নারীদেরকে কম কিংবা পুরুষদেরকে বেশী জ্ঞান অর্জনের কথাও উল্লেখ করা হয়নি। প্রশ্ন হলো, ইসলামের অন্যতম দলিলগ্রন্থ হাদীসে যেখানে নারী শিক্ষাকে সমান গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, সেখানে আফগানিস্তানের তালেবান সরকার ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের নামে নারী শিক্ষা নিষিদ্ধ করে ইসলামের যে অপব্যাখ্যা প্রতিষ্ঠা করছে সেটা কতটা যৌক্তিক?
শুধু কী হাদীস সংকলন! ইসলামের প্রধান গ্রন্থ পবিত্র কোরআনের সূরা আলাক’র ১ নম্বর আয়াতে যে বলা হয়েছে, ‘ পড় তোমার প্রভুর নামে’— সেখানেও নারী-পুরুষের পার্থক্য করা হয়নি বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন ইসলাম বিশেষজ্ঞগণ।
অপরদিকে তিরমিযী শরীফের ৫৭৪ পৃষ্ঠায় বর্ণিত এক হাদীসে দেখা যায়, হযরত আবু মুসা আশআরী রা: এ মর্মে বর্ণনা করছেন যে, ‘’ আমরা রাসূল সা: এর সাহাবীরা যখনই যখনই কোন মাসআলার ব্যাপারে সন্দেহ বা সমস্যায় পড়তাম, তখনই আমরা হযরত আয়েশা রা: এর নিকট গিয়ে জিজ্ঞেস করতাম এবং সঠিক সমাধান পেয়ে যেতাম’’।
এ হাদীস থেকে জানা যায়, পুরুষ সাহাবীগণ নারী সাহাবীদের নিকট মাসআলা শিক্ষার জন্য যেতেন। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়- অবশ্যই তা যথাযথ পর্দা অনুসরণ করে। এর দ্বারা যে বিষয়টি পরিষ্কার হয়, তাহলো- পর্দা অনুসরণ করে নারীদের জন্য শিক্ষকতা করা বা নারীদের কাছে গিয়ে শিক্ষা গ্রহন করার ব্যাপারে ইসলামে কোন বাধা নেই। তাহলে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, আফগানিস্তানের তালেবান প্রশাসন আজ ইসলামের নামে নারীর ওপর যে ন্যাক্কারজনক বৈষম্য আরোপ করছে ইসলাম তা কতটা অনুমোদন করে?
শুধু কী তালেবান প্রশাসন! বাংলাদেশেও অনেক ইসলামী সংগঠন নারীর প্রতি তালেবানের মতই দৃষ্টিভঙ্গী লালন করে। কওমী মাদ্রাসাগুলোর কেন্দ্রীয় সংগঠন হেফাজতে ইসলামের প্রয়াত আমীর মাওলানা আহমদ শফি একবার জনসভায় নারীকে তেঁতুলের সাথে তুলনা করে চরম বিতর্কের মুখে পড়েন। তিনি বলেন, ‘’ মহিলা তেঁতুলের চেয়েও খারাপ। মহিলার দিকে দেখলে দিলের মধ্যে লালা বাহির হয়’’।
কওমী মাদ্রাসার শীর্ষ এই নেতা কন্যা সন্তানকে পঞ্চম শ্রেণীর অধিক না পড়ানোর জন্য তাঁর অনুসারীদের পরামর্শ দেন। অন্য এক ভাষণে একবার তিনি নারীদের গার্মেন্টস কারখানায় কাজ করাকে জেনার সঙ্গে তুলনা করে নারীদেরকে ভর্ৎসনা করেন।
দু:খজনক হলেও সত্য যে, নারীর শিক্ষা ও কর্ম বিষয়ে মাওলানা আহমেদ শফির মতো একজন শীর্ষস্থানীয় আলেমের যে বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি, সে দৃষ্টিভঙ্গী হাল আমলে অনেক ইসলামী বক্তার মাঝেও লক্ষ্য করা যায়। বছর কয়েক আগে আব্দুর রাজ্জাক নামে একজন মাওলানাকে বলতে শুনেছি, ‘’ ইসলাম ধর্মে নারীর অবস্থান- সব মিলিয়ে সংক্ষিপ্ত কথা- নারীর জন্ম হয় হচ্ছে কলংক, কুলক্ষণ, অমঙ্গল। নারীর কোন আত্মা নেই। নারীর জন্ম হয়েছে সেবার জন্য। স্বামী স্ত্রীকে বিক্রী করতে পারে।”
এরকম চরম নারী বিদ্বেষী বক্তব্যের নজির একটি কিংবা দু’টি নয়, অসংখ্য। সবচেয়ে দু:খজনক হলো— হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মানুষ মুগ্ধ হয়ে এসব বক্তার বক্তব্য শোনে আর মারহাবা দেয়। দেবেই বা না কেন! একেকজন বিখ্যাত ইসলামী বক্তা বলে কথা। আবার প্রত্যেকেরই রয়েছে হাজার হাজার অনুসারী।
প্রশ্ন হলো— ইসলামের নামে নারীর প্রতি এই যে বিদ্বেষ ছড়ানো এর পরিণতি কি আমরা কখনো ভেবে দেখেছি? যে সব লক্ষ লক্ষ মানুষ এসব ইসলামী বক্তাদেরকে গভীর শ্রদ্ধাভরে অনুসরণ করেন তাদের কাছে তাহলে তারা নারীর শিক্ষা ও কর্মের ব্যাপারে ইসলামের কী বাণী পৌঁছাচ্ছে? তাদের কতজনই এসব বক্তব্য যাচাই বাছাই করে দেখার যোগ্যতা রাখেন। হুজুরের বক্তব্য অন্ধের মত মেনে নেয়া ছাড়া তাদের আর কী-ই বা করার থাকে। সরল প্রাণ মুসলমানের কাছে হুজুর মানেই তো ইসলাম। হুজুরেরা যা বলেন তাই তারা মাথা পেতে নেন।
একজন আহমেদ শফি বা একজন আব্দুর রাজ্জাক বা অন্য অনেক ইসলামী বক্তা যেভাবে ইসলামের মনগড়া ব্যাখ্যা প্রচার করে চলেছেন, তাতে করে অনেক সহজ সরল ধর্মপ্রাণ বাংলাদেশী অতি সহজে তালেবানী মতাদর্শে উজ্জ্বীবিত ও উদ্বুদ্ধ হবেন— এ আশংকা কী আদৌ উড়িয়ে দেয়া যায়!
লেখক: কবি ও সাংবাদিক
ইলফোর্ড, এসেক্স
আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলনে ভাসানী এখনো প্রাসঙ্গিক
গাজীউল হাসান খান ♦ সামন্তবাদী কিংবা পুঁজিবাদী, আধিপত্যবাদী কিংবা উপনিবেশবাদী— যেখানেই যেকোনো ধরনের অপশাসন ও শোষণ দেখেছেন, সেখানেই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে গর্জে উঠেছেন আজন্ম সংগ্রামী মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। খোলা তরবারির মতো ঝলসে উঠেছে তাঁর দুটি হাত। কণ্ঠে উচ্চারিত...