সারওয়ার-ই আলম
বই, রেডিও আর খবরের কাগজ- এ তিনটা জিনিসের প্রতি কৈশোরে আমার দুর্দান্ত আসক্তি ছিল। মাইজদী পাবলিক লাইব্রেরিতে সম্ভবত এমন কোন বই ছিল না যেটাতে আমার স্পর্শ লাগেনি। এমনও অনেক দিন গেছে আমি সারারাত জেগে বই পড়েছি। বিবিসি বাংলা রেডিও আর খবরের কাগজের কথা কী আর বলব। রোদবৃষ্টি যাই থাকুক না কেন প্রতিদিন ঠিকই শহরে গিয়ে আমি খবরের কাগজ কিনে নিয়ে আসতাম। দেরীতে যাওয়ার কারণে যেদিন কাগজ পেতাম না, সেদিন বসে বসে আগের দিনের কাগজের দরপত্র বিজ্ঞপ্তিগুলো পড়তাম। না, আমার স্বজনদের মধ্যে কেউ ঠিকাদার ছিলেন না। কিন্তু তারপরও কেন জানি আমি দরপত্র বিজ্ঞপ্তি পড়তাম। কী মজা পেতাম তা আজ আর বলতে পারব না! সে যাই হোক! আজ অবশ্য বই কিংবা খবরের কাগজ নিয়ে কথা বলছি না।
আজ কিছু কথা বলতে বসেছি রেডিও নিয়ে। রেডিও নিয়ে বলতে বসেছি এ জন্য যে, আজ আমাদের শৈশব ও কৈশোরকে বহুভাবে পুলকিত করা এবং কখনো কখনো নানাভাবে আন্দোলিত করা বিবিসি বাংলা রেডিও বন্ধ হয়ে গেছে। গত দুই দশকে বিবিসি তেমন একটা না শুনলেও রেডিওটি বন্ধের খবরে বেশ কষ্ট পেয়েছি। কষ্ট পেয়েছি কারণ- বিবিসি বাংলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার কৈশোর, আমাদের গ্রামের বাড়ী, গ্রামের বাড়ীর সন্ধ্যা। বিবিসি বাংলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার নিস্তরঙ্গ কৈশোরের শুদ্ধতম বিনোদন।
বিবিসি বাংলা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে গ্রামের বাড়ীর উঠোনে হারিকেন জ্বালিয়ে গোল হয়ে বসে সান্ধ্য অধিবেশন শোনার স্মৃতি। আহা কী সোনালী স্মৃতি! ছেলেবুড়ো সকলেই গভীর মনযোগ দিয়ে শুনতাম ঢাকার খবর। আমাদের মাঝারি আকৃতির প্যানাসোনিক রেডিও ছিল। একটা নির্দিষ্ট অবস্থানে এটাকে কৌণিকভাবে বসাতে হতো। তা না হলে কথা পরিষ্কার শোনা যেতো না। শুধু শোঁ শোঁ শব্দ করতো। শব্দ পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত অ্যান্টেনা তুলে ঘুরিয়ে-ঘারিয়ে নানা কসরত চলতেই থাকতো। এ কসরত চলাকালে কেউ একটা শব্দ করেছে তো মরেছে। মুরব্বীদের কাছ থেকে তার দশমণ ওজনের ধমক প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়ে যেতো। অ্যান্টেনা নাড়াচাড়া করলে কথা একটু পরিষ্কার হতো। আবার কখনো ভেঙ্গে ভেঙ্গে শুধু অল্প কিছু কথা আসতো, পুরো বাক্য শোনা যেতো না। তখন আমরা নিজেদের মনের মধ্যে সামনের পেছনের কথা জোড়া লাগিয়ে তার একটা মর্মার্থ ঠিকই উদ্ধার করে নিতাম। যেদিন আবহাওয়া ভাল থাকতো সেদিন একদম টনটনে শব্দে বিবিসি বাজতো। উচ্চশব্দে চলতো বিধায় সেদিন আশেপাশের অনেকে শুনতে আসতেন। তখন পুরো উঠোন জুড়ে লোকে গমগম করতো। এখনো পরিষ্কার মনে পড়ে সন্ধ্যার আলো-আঁধারী চিরে বহুদূর থেকে ভেসে আসতো সংবাদ পাঠকদের ভারী কণ্ঠস্বর। আর আমরা গভীর আগ্রহ নিয়ে সেসব শুনতাম। জানতাম দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক অবস্থা, আন্দোলন-সংগ্রামের তথ্যবহুল বিশ্লেষণ। বিশেষ করে ঢাকার খবর।
স্বীকার করতেই হবে- আশির দশকে বিবিসি ছিল নির্ভরযোগ্য সংবাদের অন্যতম উৎস। গণমানুষের গভীর আস্থার প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠেছিল বিবিসি বাংলা। আজো মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি যে সাংবাদিকতা পড়ে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিয়ে জীবন শুরু করেছি এর পেছনেও সম্ভবত ভূমিকা পালন করেছে বিবিসি বাংলা। ওই যে কৈশোরে রেডিও আসক্তি তৈরী হয়েছিল আমার বিবিসি বাংলা শুনে, সেটাই সম্ভবত অজান্তে আমার মনে বপন করে দিয়েছিল সাংবাদিকতার প্রথম বীজ। তাই প্রিয় এ রেডিওটি আজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেশ কষ্ট অনুভব করছি। লণ্ডনে আসার পর বিবিসি’র চারজন সাংবাদিকের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ও যোগাযোগ তৈরী হয়। তাঁরা হলেন- কাজী জাওয়াদ, উদয় শংকর দাশ, কামাল আহমেদ ও মোয়াজ্জেম হোসেন। এঁরা প্রত্যেকেই বরেণ্য সাংবাদিক। স্বনামধন্য। জাওয়াদ ভাই, উদয় দা ও মোয়াজ্জেম ভাইকে বিভিন্ন সভা-সমিতিতে কাছে থেকে জানার সুযোগ হয়েছে। তাদের ব্যক্তিত্বের স্নিগ্ধতায় মুগ্ধ হয়েছি। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে ঋদ্ধ হয়েছি। বিশেষ করে জাওয়াদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা বয়সের ব্যবধান টপকিয়ে বন্ধুত্বে রূপ নিয়েছে। মাঝে মাঝেই টেলিফোনে আমাদের দীর্ঘ আড্ডা হয়। আমাদের আলোচনা প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গে আবর্তিত হতে থাকে, কিন্তু কথা ফুরায় না। উদয় দা একবার পপলারে আবৃত্তির এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেয়ার আগে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে বলেছিলেন, সারওয়ার আমার অতি প্রিয় মানুষগুলোর মধ্যে একজন। সেদিন আমি ভীষণ অভিভূত হয়েছি। বুঝতে পেরেছি তাঁর হৃদয়ে আমার জন্য ভালবাসার একটা জায়গা নির্ধারিত আছে।
আজ ফেইসবুকে মোয়াজ্জেম ভাইয়ের একটা পোস্ট পড়ে এই ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অনুভূতির সংকলন। একটা ছবি দিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘শেষবারের মত মাইক্রোফোনের সামনে পরিক্রমা উপস্থাপনার সময়’। অল্প ক’টি কথা। কিন্তু একেবারে মন ছুঁয়ে গেলো। আমি বারকয়েক তাঁর ছবিটার দিকে তাকালাম। তাকিয়ে চিন্তা করছিলাম, যে রেডিওর শ্রোতা হিসেবে রেডিওটি বন্ধ হওয়ার খবরে আমি মর্মাহত, সে রেডিওর সাংবাদিক হিসেবে তাঁর মনের অবস্থাটা কেমন! বিবিসি বাংলা বন্ধের এ ক্ষণে, এক সময়ের একজন শ্রোতা হিসেবে গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি সেসব মেধাবী, পরিশ্রমী ও সাহসী সাংবাদিকদের প্রতি যাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমে আশির দশকে তৈরী হয়েছে আমার মত অনেক সংবাদকর্মীর সংবাদ সংযোগ, জীবনে সাংবাদিক হওয়ার সুপ্ত বাসনা। ইলফোর্ড, এসেক্স ৩১ ডিসেম্বর ২০২২
লেখক: কবি, সাংবাদিক