লণ্ডনের চিঠি
সাগর রহমান ♦
বসে বসে ঢাকার মেট্রোরেল দেখছিলাম ইউটিউবে। স্টেশানের ডিজাইন, টিকেট কাটার মেশিন, উপরে এবং নিচে উঠা-নামার সুব্যবস্থা, নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে রেলে ঢোকার দরজায় ডিজাইন- সব মিলিয়ে চমৎকার লাগছিল। নিঃসন্দেহে একটা উত্তম কাজ হয়েছে। গতবার যখন ঢাকায় গিয়েছি, শাহবাগ থেকে মিরপুর যেতে উবারে ঝাড়া তিনঘন্টা বসেছিলাম বলে পরবর্তীতে ঢাকার রাস্তায় বেরুনোর কথা উঠলেই হাঁসফাঁস লাগতে শুরু করতো। ঢাকায় যেসব বন্ধুরা থাকেন, তারা দেখলাম চলাচলের দিব্যি একটা নিজস্ব ‘সিস্টেম’ করে নিয়েছেন। দিনের কোন এলাকায় কোন রাস্তাঘাট তুলনামূলক ব্যস্ত থাকে, সেসব তাদের মুখস্ত। তারওপর রাস্তাঘাটের লাইভ আপডেট হওয়া এ্যাপ আছে। সেসবও ব্যবহার করে চমৎকার একটা সহাবস্থান তৈরি করে নিয়ে চলাফেরা করেন। সমস্যা হয়, আমরা যারা কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে যাই, তাদের। কিছু বুঝে না বুঝে যেদিকে যখন যাবার দরকার কি ইচ্ছে হয়, রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি, তারপর জ্যামে আটকে বসে থেকে থেকে অবসন্ন হয়ে যাই। মনে আছে, গতবার একদিন মহাখালিতে এমন জ্যাম লেগেছিল যে আমি বাস থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে মতিঝিল পর্যন্ত চলে গিয়েছিলাম। মেট্রোরেল দেখে এজন্যই বোধহয় এত ভাল লাগছিল। তার ওপর পুরো ব্যবস্থাটা বেশ পরিকল্পিত মনে হয়েছে। ট্রেনগুলোও অনেক সুন্দর মনে হলো, ভেতরে যথেষ্ট জায়গা দেখা যাচ্ছে, বড় বড় জানালা খোলামেলার একটা আবহ দিয়েছে। জয়তু মেট্রোরেল।
লণ্ডনের মেট্রোরেলকে আণ্ডারগ্রাউণ্ড, কিংবা টিউব বলে ডাকা হয়। এসব রেলের বেশিরভাগ স্টেশান এবং পথ মাটির নিচে, অনেকটা পিপীলিকার বসতবাড়ির মতো মাটির নিচে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে খুঁড়ে পুরো লণ্ডন শহরকে জালের মতো জড়িয়ে নিয়ে সিস্টেমটা দাঁড় করানো হয়েছে। মাটির নিচে হওয়াতে সুবিধাটা হলো উপরের বাস চলাচলের রাস্তায় এর কোন প্রভাব পড়ে না। ফলে স্বভাবতই পুরো শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা হয়ে গেছে দ্বিতল। উপরে বাস, ট্রাক, কার। নিচে ট্রেন। লণ্ডনের মেট্রোরেলের বয়স হয়ে গেছে দেড়শো বছরেরও বেশি। তবে সিস্টেমটার আদি ডিজাইন নিঁখুত হওয়াতে এত পরিবর্তিত পৃথিবীতেও পুরনো সিস্টেমের সাথে প্রয়োজনমত নতুন সংযোগ দিতে বিন্দুমাত্রও বেগ পেতে হয় না। আদি ট্রেনলাইনগুলোও দিব্যি চলছে নতুন লাইনগুলোর সাথে।
আমি নিশ্চিত, বাংলাদেশের মেট্রোরেলের পাত বসানোর আগে নগর পরিকল্পনাবিদ এবং ইঞ্জিনিয়াররা ভবিষ্যতের ঢাকার কথা ভেবেই পুরো আয়োজনটি শুরু করেছেন। আগামীতে যখন নতুন মেট্রোরেল তৈরি হবে অন্য কোন রাস্তায়, কে জানে হয়তো একসময় ঢাকার মাটির নিচ দিয়েও আমরা দেখতে পাবো ট্রেন সিস্টেম, তখন আজকের সিস্টেমটার সাথে ফ্রেম জুড়ে দিয়ে বাড়িয়ে নেওয়া হবে যোগাযোগের চৌহদ্দি। স্বপ্ন দেখি, অদূর ভবিষ্যতে ঢাকা হয়ে পড়বে জ্যাম মুক্ত আধুনিক শহর!
ব্রিটিশ এক ইউটিউবারকে দেখলাম বাংলাদেশে গিয়েছেন। তিনি মূলত ট্রাভেল ব্লগ করেন। ঢাকায় বেড়াতে যাওয়ার উপরে ব্লগ করেছেন। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, ভদ্রলোক কাওরান বাজারের কাঁচা বাজারের গলা-পচা রাস্তায় লাফিয়ে লাফিয়ে পার হচ্ছেন, শাহবাগের রাস্তায় এসে নামছেন, ফুল কিনছেন, টিএসসি পাশের রাস্তাটি ধরে পুরনো ঢাকার দিকে যাচ্ছেন, লালবাগের রাস্তায় পানিতে ভেসে যাচ্ছে- সে রাস্তা রিকশায় পার হচ্ছেন। যেখানে যাচ্ছেন, সেখানেই রাস্তার মানুষ তাকে ঘিরে ধরছে, আগ্রহ ভরে সেলফি তুলতে চাচ্ছে, ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে কথা বলছে। তিনি স্ট্রিট ফুড খাচ্ছেন, পেছনে বিশ-পঁচিশ জনের একটা দল দাঁড়িয়ে তার খাওয়া দেখছে। ঝালে তিনি আহা-উহু করছেন, নানান মশলার খাবার খেয়ে মুখের নানান অঙ্গ-ভঙ্গি করছেন, পেছনের জনতা তা দেখে আনন্দে হাসছে, আঙুল তুলে ‘ভি’ চিহ্ন দেখাচ্ছে (কেন, কে জানে!)। যে রাস্তাতেই তিনি যাচ্ছেন না কেন, হাঁটছেন, কিংবা রিকশায় বসে আছেন, কাওরান বাজার কিংবা ফুলার রোড, সব জায়গাতেই তার ক্যামেরার এ্যাংগেলে অসংখ্য যান-বাহন, রিকশা, বেবিট্যাক্সি সহ হাজারো মানুষের বোঝাই ঢাকার রাস্তা। এসব দেখাতে দেখাতে তিনি ঝকঝকা হাসিতে তার ভিউয়ারদের জানাচ্ছেন, পৃথিবীর অন্তত একশত দেশ তিনি ভ্রমণ করেছেন। কিন্তু, বাংলাদেশের রাস্তায় যা দেখছেন, তা এক কথায়: ক্রেজি। চারদিকে হযবরল অবস্থা দেখাতে দেখাতে তিনি ‘ক্রেজি’ শব্দটা বেশ কয়েকবার করে বললেন। সাধারণত এসব ভিডিও এড়িয়ে চলি আমি। বিশেষত বিদেশীরা আমাদের দেশ ভ্রমণ করতে গেলে তাদের ঝকঝকা চেহারায় আমাদের হতদরিদ্র অবস্থা দেখে মধুর করে হাসেন, বেছে বেছে খারাপ খারাপ রাস্তাঘাটগুলো খুঁজে বের করে সেগুলোকে ক্যামেরায় নানান এংগেল থেকে দেখিয়ে মাঝে মাঝে সান্তনা বাক্যের ফোঁড়ন কাটেন: … তবে মানুষগুলো সবাই খুব অতিথি পরায়ন, খাবার খুব মজার ইত্যাদি ইত্যাদি। চেনা স্ক্রিপ্ট। তারা যা দেখান, তার ভেতর দিয়েই তো আমরা বেড়ে উঠেছি। তবু বিদেশিরা তাদের চোখ দিয়ে আমাদের দেশ কীভাবে দেখেন, একসময় এ বিষয়ে উৎসাহী ছিলাম বলে এসব ব্লগগুলো আগ্রহ নিয়ে দেখতাম। তারপর চেনা স্ক্রিপ্ট বার বার দেখতে দেখতে একসময় উৎসাহ হারিয়ে ফেলি, এ ধরনের ভিডিও দেখা বন্ধ করে দেই। এই ভিডিও ব্লগটি ঐদিন কেমন করে যেন টিভি স্ক্রিনে চলতে শুরু করেছে, আর আমিও কিছু না ভেবেই দেখতে শুরু করেছি। ভদ্রলোকের মুখে ঐ ‘ক্রেজি’ শব্দটা বার বার শুনে রাগ লাগতে গিয়ে হঠাৎ একটা কথা ভেবে আমার মজা লাগতে শুরু করলো। আমি ভাবলাম, এই যে লোকটাকে দেখেই রাস্তায় মানুষ ঘিরে ধরেছে, নিজেদের কাজকর্ম ভুলে তার সাথে একটা সেলফি তুলতে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, একে চাইলে নিঃসন্দেহে ‘আদেখলা’ কিংবা ‘হ্যাংলামি’ বলে চালিয়ে দেয়া যায়। চাইলে এর অন্য একটা রূপ দেখাও সম্ভব কিন্তু। জাতি হিসেবে আমরা আসলে প্রচণ্ড কৌতূহলী, নতুন মানুষ কিংবা ভিনদেশি মানুষ দেখে এই যে আমাদের অনিমন্ত্রিত এগিয়ে আসা, এতো আমাদের অতিথিপরায়নতার সাথে সাথে নতুনের সাথে পরিচিত হবার, নতুনকে জানার, নতুনকে বোঝার ইচ্ছেরই প্রতিনিধিত্ব করে। প্রাণে প্রাণে হৃদয়ে হৃদয়ে মিলতে আমরা চিরকালই উন্মুখ। এতটুকু একটি দেশে এত গুলো মানুষ, তার মধ্যেই আমরা সহাবস্থান করে নিয়েছি সবকিছুর, ধীরে ধীরে গুছিয়ে নিচ্ছি নিজেদের, আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে রীতিমত বৈপ্লবিক উন্নয়ন ঘটিয়ে চলেছি, বিদেশি পর্যটকরা একদিন এসে রাস্তায় রিকশা-বাসের ভজঘটে বসে আমাদেরকে যত ‘ক্রেজি’ হিসেবেই বর্ণনা করুক না কেন, আমরা তো জানি, এর মধ্য দিয়েই নিজেদের অদম্য ইচ্ছা শক্তি আর পরিশ্রমে আমরা ঈর্ষণীয় সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে রয়েছি অনেক কিছুতেই। ভদ্রলোকের ব্লগটা দেখতে দেখতে আমার একটা আরেকটা কথা মনে হলো। আপনারা কি খেয়াল করে কখনো দেখেছেন, ঢাকার রাস্তায় বেরুলেই মনে হয়, চারদিকে বুঝি মেলা চলছে। জীবনের মেলা। হৈ চৈ, চিৎকার, চেঁচামেচি, গাড়ির হট্টগোল, রাস্তার ট্রাফিক জ্যাম, মানুষের ভিড়, সব্জির দোকান, খাবারের দোকান- এই সব কিছু সত্ত্বেও কেমন একটা আনন্দমুখর পরিবেশ চারিদিকে। এর মধ্যেই আমরা কাজ-কর্ম গুছিয়ে নেই, জীবনের নিত্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো সেরে ফেলি। হ্যাঁ, আমাদের কষ্ট হয়, দিনশেষে ক্লান্তিতে শরীর ভেঙ্গে আসতে চায়, রাস্তার জ্যামকে কী বিচ্ছিরি যে লাগে। কিন্তু আপনি কি দেখেছেন, প্রচণ্ড ভীড়ের বাসে ঘামতে ঘামতেও কোন একজন যাত্রী কোন একটা বিষয় নিয়ে বেমক্কা মন্তব্য করে বসেন, আর তাতে আশপাশের কেউ আরেক ফোঁড়ন কাটেন, তাতে অন্যরা সবাই হেসে ওঠেন। তখন বিরক্ত আমাদের সবার মুখেও কেমন হাসি ফুটে ওঠে। এমন কাণ্ড আমি গত এক যুগে লণ্ডনের কোথাও দেখিনি। এখানেও মাঝে মাঝে জ্যাম লাগে, কিংবা ট্রেন কোন কারণে কোন কোন দিন আটকে যায়। তখন লোকজন কেমন স্থবির বসে থাকে, যেন শোকসভা চলছে। কেউ কেউ বিড় বিড় করে ‘গালি-গালাজ’ করে, তবে সাধারণত সেটা বিড়বিড়ানো পর্যন্তই। লোকজন সব ভ্রু কুঁচকে ঘড়ি দেখে, আর মুখ কালো নিশ্চুপ হয়ে থাকে। কেউ কারো দিকে তাকায় না, হাসি-ঠাট্টার তো কথাই নেই। আমার খুব করে মনে হয়, আমাদের দেশের ঝামেলাগুলো যখন আস্তে আস্তে কমে যাবে, মেট্রোরেলের মতো আরো আধুনিক ব্যবস্থা এসে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থাটিকে আরেকটু গতিশীল করে তুলবে, তখন আমাদের ঐ ‘ক্রেজি’ দেশের মানুষগুলোই, আমাদের অতিথিপরায়ণ, অপার কৌতুহলী, নতুনকে জানার আকাঙক্ষায় উন্মুখ মানুষজনই আরো কত অসম্ভব সম্ভব করে দেশটাকে রকেটের গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। ঢাকার মেট্রোরেল দেখা অব্দি লণ্ডনের মেট্রোরেলকে আমার কেমন পানসে লাগছে, ভীষণ প্রাণহীন মনে হচ্ছে। কবে ঢাকা গিয়ে মেট্রোরেলে চড়ব, আমি সে আশায় দিন গুনছি।
লণ্ডন। ১১ জানুয়ারী, ২০২২।
লেখক: কথাসাহিত্যিক