দিলু নাসের ♦
লণ্ডন, ১৫ জানুয়ারী ২০২৩:
সত্তর দশক, সিলেটের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির গৌরবের দশক। গত শতাব্দীর এই দশকেই মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করেছি দেশের স্বাধীনতা। সারাদেশের ন্যায় স্বাধীনতা-উত্তর সিলেটের শিল্প-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও দেখা দেয় প্রাণচাঞ্চল্য। নানামুখী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে মুখর ছিল সিলেটের শিল্প-সাহিত্যাঙ্গন।
সত্তর দশকে বিশেষ করে স্বাধীনতা-উত্তর সিলেট জন্ম দিয়েছে অনেক প্রতিভাবান লেখক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মীকে। সিলেটের শিশু-কিশোর ও তরুণদের কাছেও এই সময়টা অত্যন্ত স্মরণীয় সাফল্যের প্রতীক।
সারাদেশের ন্যায় বিভিন্ন শিশু-কিশোর যুবকল্যাণ সংগঠনের নানামুখী শিক্ষা, সাংস্কৃতিক কর্ম তৎপরতায় মুখর ছিল সিলেট। সুন্দর একটা শিল্প-সাংস্কৃতিক আবহ ছিল সর্বত্র। ছিল সবার মাঝে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, একে-অন্যের প্রতি ভালবাসা। স্বাধীনতা-উত্তর সিলেটে শিশু-কিশোরদের জন্য গঠিত হয়েছিলো অনেকগুলো জাতীয় সংগঠন। তার মধ্যে অন্যতম ছিলো ‘সুরমা খেলাঘর আসর, চাঁদের হাট, শাপলা-শালুকের আসর ইত্যাদি। নিয়মিত সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যদিয়ে এসব সংগঠন সিলেটের শিশু-কিশোরদের মুক্ত চিন্তার বিকাশ ঘটিয়েছিল।
আমিও সেসময় ছিলাম এসব সংগঠনের ক্ষুদে সদস্য। চাঁদের হাট এবং শাপলা শালুকের আসরের অঘোষিত কার্যালয় ছিলো আমাদের বাসা। এখান থেকেই সকল কর্মতৎপরতা চালানো হতো। এই সুবাদে সেসময়ের জাতীয় এবং স্থানীয় অনেক লেখক-সাংস্কৃতিক কর্মীর যাতায়াত ছিলো আমাদের বাসায়। বলতে গেলে আমি তাদের ছায়াতলেই বেড়ে উঠেছি।
সেসময় সিলেট সাহিত্য সংস্কৃতির যেসব অনুষ্ঠান হতো আমার অগ্রজ বিশিষ্ট ছড়াকার, লেখক মিলু কাসেম আমরা সকল ভাইবোনদেরকে সে সবে নিয়ে যেতেন। সাহিত্যের অনুষ্ঠানে সিলেটের খ্যাতিমান লেখকরা কবিতা পড়তেন, আলোচনা করতেন, আর আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। সেসময় সিলেটের শিশু সাহিত্যকেন্দ্রিক স্মরণীয় স্মৃতিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য সাপ্তাহিক যুগভেরীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শাপলার মেলার কর্মকাণ্ড। যুগভেরীর এই ছোটদের পাতাকে ঘিরে সিলেটের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গন মুখরিত হয়ে উঠেছিল। সম্ভবত ১৯৭৩ সালে যুগভেরীর তৎকালীন সহ-সম্পাদক অজয় পালের পরিচালনা ও মাহবুবুর রহমান এবং মিসেস ফাহমিদা রশীদ চৌধুরীর সার্বিক সহযোগিতায় জন্ম নিয়েছিল ‘শাপলার মেলা’। শাপলার মেলার আসর আমার শৈশব-কৈশোরকে আলোকিত করেছিলো। এই আসর পরিণত হয় সিলেটের শিশু-কিশোর, নবীন-প্রবীণ শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতিপ্রেমীদের মিলনমেলায়।
যুগভেরী অফিসে শাপলার মেলার আসর বসতো নিয়মিত, বড় ভাইয়ের সাথে আমিও যেতাম সেই আসরে, সেখানে আসতেন কবি দিলওয়ার, অজয় পাল, মাহবুবর রহমান, তবারক হোসেন, বেলাল মোহাম্মদ, মাহমুদ হক, শামসুল করিম কয়েস, তুষার কর, বুদ্ধদেব চৌধুরী, গিয়াস উদ্দিন আউয়াল, বিদ্যুৎ কর, পরেশ দেবনাথ, ফজলুল করিম অপি, লোকমান আহমদ, আজিজ আহমদ সেলিম, রোকেয়া খাতুন রুবী, শাহেদা জেবু, হোসনে আরা হেনা, হীরা শামীম, আবুল কাশেম মিলু, সৈয়দ নাহাশ পাশা, নূরুজ্জামান মণি, আবুবকর মোহাম্মদ হানিফ প্রমুখ এবং আমার মতো আরও কিছু ক্ষুদে বন্ধু।
শাপলার মেলার পরিচালক ছিলেন মিতাভাই। প্রতি সপ্তাহে যুগভেরীর শিশুদের পাতা শাপলার মেলা সযতেœ সাজাতেন তিনি। সেই পাতায় ছড়া-কবিতা গল্পের সাথে সবচেয়ে আকর্ষণীয় যে বিষয়টি ছিলো তা হলো মিতাভাইয়ের চমৎকার চিঠি। শিশু কিশোর পাঠকদের জন্য মিতা ভাই এই চিঠিটি লিখতেন যা আমাদের কাছে খুব প্রিয় ছিলো। যুগভেরীর আসরে মাঝে মাঝে উপস্থিত থাকলেও মিতা ভাইকে তখনও স্বনামে চিনতাম না। বেশ পরে জেনেছি সেই মিতাভাই বিশিষ্ট ছড়াকার অজয় পাল। এর পর অনেক দিন তাকে অজয় দা না বলে মিতা ভাই বলেই সম্বোধন করেছি। যখনই দেখা হতো মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিতেন। তখনকার সময়ে যে কজন লেখকের লেখা ভালো লাগতো এবং সিলেটের শিল্প-সাহিত্য আর সাংস্কৃতিক অঙ্গন ছিল যাদের পদচারণায় মুখরিত তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম।
প্রিয় লেখকদের সান্নিধ্যে থেকে এবং তাদের রচনা পড়ে পড়ে নিজে যখন লেখক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর, তখন যেসব প্রিয়জনদের ঐকান্তিক সহযোগিতায় আমার নাম ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম বিশিষ্ট ছড়াকার কবি মাহমুদ হক, তৎকালীন স্বনামধন্য ছড়াকার শামসুল করিম কয়েস, কবি সাংবাদিক হামিদ মোহাম্মদ, ছড়াকার-সাংবাদিক অজয় পাল প্রমুখ। আমি তাদের কাছে চিরঋণী।
আমার লেখালেখি শুরু হয়েছিলো গল্প দিয়ে। স্থানীয় কাগজগুলোতে আশির দশকের প্রারম্ভে বেশ কিছু গল্প ছাপা হয়েছিলো। যেহেতু আমার অগ্রজ আবুল কাশেম মিলু চমৎকার ছড়া লিখতেন, তাই আমি ছড়ার ছন্দ-তালের ভেতরেই বেড়ে উঠেছি এবং কবি দিলওয়ার, তুষার কর, শামসুল করিম কয়েস, মাহমুদ হক, অজয় পালের মতো সিলেটের স্বনামধন্য ছড়াকারদের ছড়ার ছন্দ আমাকে প্রতিনিয় দোলা দিতো তাই ছাপার অক্ষরে নাম প্রকাশিত হওয়ার আগে আমি লুকিয়ে লুকিয়ে ছড়া লেখার চেষ্টাও কম করিনি।
গল্পের সাথে তখন কিছু ছড়াও সেসময় প্রকাশিত হয়েছে। আমি ছড়ায় শুরু থেকেই অগ্রজ লেখকদের তাল ছন্দকে প্রাধান্য দেয়ার চেষ্টা করতাম। প্রিয় মাহমুদ ভাই তখন সাপ্তাহিক দেশবার্তায় কর্মরত ছিলেন। প্রতি সপ্তাহেই তার কাছে গল্প নিয়ে যেতাম, ছাপতেনও তিনি। হামিদ ভাই ছিলেন যুগভেরীতে তার হাত দিয়ে ও অনেক লেখা ছাপার মুখ দেখেছে। আমি তখন আবু নাসের দিলু নামে লিখতাম। নাসের লিখতাম “ছ”দিয়ে। হামিদ ভাই বললেন “স”দিয়ে লিখতে, সেই থেকে এভাবেই লিখছি। একদিন দেশবার্তায় অজয় দার সাথে দেখা, অনেক কথা হলো, তিনি সম্ভবত তখন সিলেট সমাচারে কাজ করতেন। অনুরোধ করলেন একদিন সেখানে যেতে। আর বললেন তোমার ছড়া আমার ভালো লাগে, গল্প বেশী না লিখে আমি মনে করি তুমি ছড়ায় ধ্যান দিলে ভালো করবে। আমি বললাম দাদা চেষ্টা করবো, তবে ছন্দ এবং মাত্রায় আমি একেবারেই আনাড়ি। বললেন বেশী করে ছড়া পড়ো এসব দুর্বলতা ঠিক হয়ে যাবে। অজয় দা সেসময় খুব ভালো ছড়া লিখতেন। তাঁর ছড়ায় ছিলো ঝরঝরে ভাষা, প্রখর কল্পনা শক্তি, এবং তীক্ষ¦ জীবনদৃষ্টি। শিশুতোষ বিষয় ছাড়াও সে সময় তিনি অনায়াসে তাঁর শিল্পমাধ্যম ছড়ায় তুলে আনতেন সমাজের অনেক অসঙ্গতির চিত্র। ভাব বৈচিত্রের পাশাপাশি তিনি ছন্দ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। অত্যন্ত সহজ সরলভাবে তার রচনায় তিনি উপস্থাপন করেন জীবন বোধ এবং সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙক্ষাকে।
অজয় দা’র সেদিনের কথাগুলোকে হৃদয়ে ধারণ করে আমি সেসময় থেকেই মূলত ছড়ায় লেখায় মনোনিবেশ করি। এর কয়েকদিন পরে এক সকালে কবি দিলওয়ারে বাড়ীতে গেলে তিনি বলেন চলো আজ সিলেট সমাচারে যাই অজয়ের সাথে আড্ডা দিয়ে আসি।
আমরা যখন সিলেট সমাচারে আসলাম তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। অজয় দা বাইরে ছিলেন, কিছুক্ষণ পরে আসলেন সেদিনের বেশ কিছু কাগজ নিয়ে। আমাকে দেখে উৎফুল্ল হয়ে বললেন- বাহ বাহ, দুই দিলু এক সাথে।
দুদিন আগে ঢাকার একটা কাগজে আমার একটি ছড়া ছাপা হয়েছিলো দাদা সেটির খুব প্রসংশা করলেন। কিছুক্ষণ পর এক টুকরো কাগজ আর কলম হাতে দিয়ে বললেন -এ সপ্তাহের জন্য একটা ছড়া লিখে দাও। শুনে আমি তো একেবারেই নার্ভাস। বললাম দাদা পারবো না। দিলু ভাই আর আপনি সামনে, আমার মাথায় তো কিছুই আসবে না। তিনি বললেন না, তোকে এক্ষুণি লিখতে হবে, আমার আদেশ। আমি পড়লাম বিপাকে! কী নিয়ে ছড়া লিখবো। দিলু ভাই সাহস দিলেন বললেন – লিখে ফেল যা মাথায় আসে।
আমি চিন্তা করছি কি বিষয়ে ছড়া লিখবো। হঠাৎ টেবিলের উপর রাখা চলতি সপ্তাহের সিলেট সমাচারে চোখ পড়লো, প্রথম পাতায় একটা সংবাদ “ঘুষখোর অফিসার গ্রেফতার”। আমার ছড়ার বিষয় পেয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ পর কাঁপা কাঁপা হাতে অজয়দার কাছে কাগজটি এগিয়ে দিলাম। তিনি জোরে জোরে পড়তে লাগলেন।
ফুস মন্তর ফুস
সাহেব নিলেন আমার থেকে
হাজার টাকা ঘুষ।
সেই টাকাতে খাচ্ছে সাহেব
মোরগ খাসির জোশ
ফুস মন্তর ফুস।
সবাই জানে সাহেব ভালো
নেই কোনো তার দোষ
ফুস মন্তর ফুস।
শেষ হতেই কবি দিলওয়ার বললেন – বাহ বাহ চমৎকার। পরের সপ্তাহে সমাচারে ছড়াটি বক্স করে ছাপা হয়েছিলো। এর পর থেকে দেখা হলেই অজয় দা ছড়া দেবার জন্য তাগাদা দিতেন।
অজয় পাল সাংবাদিক হিসেবে খ্যাতি লাভ করলেও তিনি খুব ভালো ছড়া লিখতেন, গান লিখতেন কবিতা ও লিখেছেন কিছু। তবে নিজের লেখার চেয়ে লেখক সৃষ্টিতে তার আনন্দ ছিলো বেশী। বিশেষ করে নতুন লেখিয়েদেরকে উৎসাহ দিতেন তিনি। কারও লেখায় কোনো ভুলত্রুটি থাকলে সংশোধন করে দিতেন। লেখালেখির বিষয়ে তার সাহচর্যে আমার মতো অনেকেই উপকৃত হয়েছে।
বয়সে তিনি আমাদের অনেক বড় হওয়া সত্ত্বেও আমাদের কথাবার্তা হতো বন্ধুর মতো, কারণ তিনি মনের ঔদার্য দিয়ে বয়সের দূরত্ব দূর করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আশির দশকের মাঝমাঝি সময়ে তিনি লণ্ডনে চলে আসায় আমাদের সোনালী দিনগুলোতে তার সান্নিধ্য থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছিলাম।
সাংবাদিকতায় তিনি ছিলেন সিলেটের মোনাজাত উদ্দীন। তার সংবাদ এবং প্রতিবেদনে উঠে এসেছে অসহায় মানুষের দুর্দশার চিত্র। অতঃপর সমাধান। তিনি নিবিষ্ট মনে জীবনকে এঁকেছেন সংবাদপত্রের পাতায়। একটি প্রতিবেদনেই শেষ নয়! বরং সংবাদের পিঠে সংবাদ। কখনো সরেজমিন প্রতিবেদন, কখনো ধারাবাহিক প্রতিবেদন- নানা নামে নানা ছন্দে সমস্তই সংবাদ উপস্থাপন।
খবরকে সকল পর্যায়ের পাঠকের জন্য বোধগম্য করে তোলার নিপুণ কৌশলটি জানতেন অজয় পাল। তিনি চোখ দিয়ে কেবল দেখতেন না, অনুধাবন করতেন মন দিয়ে। যার ফলে সংবাদ হয়ে উঠত একান্তই পাঠকের নিজস্ব। যেসব জনপদের খবর কখনও শহুরে মানুষের কানে পৌছত না, সেইসব অবহেলিত মানুষের হাহাকার তিনি শহরে পৌঁছে দিয়েছেন তার মর্মভেদী আহ্বানে। খবরের অন্তরালে যে সব খবর লুকিয়ে থাকে তিনি ছিলেন সেই সব তথ্যানুসন্ধানের নেপথ্যের মানুষ।
সত্তরের দশকে সাংবাদিকতা শুরু করার সময় থেকেই থেকেই খবর-পাগল এই মানুষটি যত বৈরী পরিবেশই হোক না কেন, নিরন্তর খবরের পেছনে ছুটেছেন। যতোদিন সাংবাদিকতা করেছেন কোনো প্রতিবন্ধকতা তাঁর গতি কখনো রুখতে পারেনি। আশির দশক থেকে তাঁর সঙ্গে সার্বক্ষণিক ছিলেন সিলেটের বরেণ্য চিত্রগ্রাহক আতাউর রহমান (আতা)। অজয় দার রিপোর্ট আর আতাউর রহমানের ছবি মানেই ছিল অনুপম যুগলবন্দী উপস্থাপনা। সেই সময় থেকেই তাঁর বিরামহীন পথচলা ছিলো ২০০৫ সালে লণ্ডনে আসার আগ পর্যন্ত। গত কয়েক বছর পত্রপত্রিকায় নিয়মিত না লিখলেও জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি লেখালেখি ছাড়েননি। যেকোনো মাধ্যমেই হোক, লিখছেন।
সাংবাদিকতায় ৫০ বছরের এই দীর্ঘ পরিক্রমায় সিলেটের স্থানীয় ও জাতীয় এবং প্রবাস থেকে প্রকাশিত অগণন সংবাদপত্রে কাজ করার গৌরব অর্জন করেন। জাতীয় দৈনিকের মধ্যে বাংলার বাণী, দৈনিক সংবাদ, দেশবাংলা ও বাংলাবাজার পত্রিকা ছাড়াও সিলেটের স্থানীয় দৈনিক সিলেট বাণী পত্রিকায়ও কাজ করেন কিছুদিন। আর সাপ্তাহিকের মধ্যে যুগভেরী, সিলেট সমাচার, দেশবার্তা ও সিলেটধ্বনি পত্রিকায় কর্মরত ছিলেন বহুদিন।
শুরুর দিকে সুনামগঞ্জ থেকে প্রকাশিত সূর্যের দেশ পত্রিকায় কিছুদিন সিলেট প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেন। যুক্ত ছিলেন লণ্ডন থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সুরমা, জাগরণ, পত্রিকা, দেশবার্তা, পূর্বদেশ ও কানাডা থেকে প্রকাশিত বাংলা নিউজ পত্রিকার সঙ্গে। ২০০৮ সালে লণ্ডন থেকে প্রকাশিত মাসিক হৃদয়ে বাংলাদেশ ম্যাগাজিনের ছিলেন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক।
অজয় দা গত প্রায় দুই দশক লণ্ডনে বসবাস করেছেন। কিন্তু এক সময়ের এই দাপুটে সাংবাদিক এখনকার কোনো কাগজের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না। মূলত এই কমিউনিটিতে তার কোনো মূল্যায়নই হয়নি। তাকে নিয়ে এখন অনেকেই লিখছেন আরও হয়তো লিখবেন। এইসব লেখায় সকলেই বিশেষণের পর বিশেষণ দিয়ে অজয় পালকে নিজেদের মতো উপস্থাপন করবেন। আবার অনেকে হয়তো লিখবেন সামাজিক কর্তব্যবোধের তাড়নায়। কিন্তু জীবিত অজয় পালকে নিয়ে আমরা ক’জন লিখেছি? দেশে-বিদেশে আমরা কি তার কর্মের স্বীকৃতি দিতে পেরেছি! তাঁর জীবন এবং কর্ম সম্পর্কে আমরা কতোটুকু জানি কজন তার রচনা পড়েছি? এটাই প্রশ্ন।
আমার কাছে সাংবাদিক ছাড়াও তার আসল পরিচয় তিনি একজন কবি। তিনি ছন্দ ও আঙ্গিক নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নীরিক্ষা করেছেন। শব্দ প্রয়োগে তিনি খুব সচেতন ছিলেন। ছন্দের উপর তার ছিলো দারুণ দখল। মানব মনের চিরন্তন আবেগ,মানুষের মনের ব্যথা-বেদনা, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার শক্তিমান রূপকার ছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত দেশ প্রেমিক। দেশের মানুষের একান্ত সান্নিধ্যে থেকে তিনি উচ্চারণ করেছেন ছন্দের মাধুর্য দিয়ে দেশের গান। তার গীতিকাব্যগুলো মাটি আর মানুষের কথা বলে। গানের শব্দমালা থেকে উৎসারিত মাটির সোঁদা গন্ধ তাই পাঠক এবং শ্রোতাকে মুগ্ধ করে। বাংলাদেশ বেতার এবং টেলিভিশনে অজয় পালের অজস্র গান রয়েছে। অজয় পালের অসংখ্য গান গীত হয়েছে সুবীর নন্দী, বিদিত লাল দাশ, সুজয় শ্যাম, হিমাংশু গোস্বামী, আকরামুল ইসলাম, শাম্মী আখতার, একে আনাম, হিমাংশু বিশ্বাসসহ বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলার অনেক বরেণ্য শিল্পীদের কণ্ঠে। এগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা যদি আমরা করতে পারি তাহলে তার প্রতিভাকে এবং তাকে যথাযথ সম্মান জানানো হবে বলে আমার বিশ্বাস। শুধু গান কবিতা সাংবাদিকতা নয়, তিনি এতো সুন্দর করে বিভিন্ন বিষয়ের উপর ধারা বর্ণনা লিখতেন, যা মানুষের হৃদয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করতো।
গত দুই দশকে লণ্ডনে প্রিয় অজয় দার সাথে রয়েছে অসংখ্য স্মৃতি। কয়েক বছর তার সাথে নিয়মিত দেখা না হলেও ফোনালাপ হতো মাঝেমধ্যে। পত্রিকায় অথবা ফেইসবুকে আমার কোনো লেখা তার ভালো লাগলে ফোন করতেন। পছন্দ না হলে ঠিক করার পরামর্শ দিতেন। নিজে কোনো নতুন লেখা লিখলে পাঠিয়ে মতামত চাইতেন। কিছু দিন আগে দুই বাংলা নিয়ে একটি চমৎকার গান লিখেছিলেন। আমাকে মেসেঞ্জারে পাঠিয়ে বললেন শুনে মতামত দিও। আমি সময় করে গানটি শুনতে পারিনি, কয়েকদিন পর ফোন করে বললেন গানটি কেমন হয়েছে বলতে। বললাম দাদা আপনি তো আমার গুরু, তাই আমি কী মতামত দেবো! হেসে বললেন, তুমি “গুরু মারা শিষ্য” খুব ভালো গান লিখো তাই তোমার মতামত জানতে চাই। এই ছিলেন অজয় দা, আমার প্রেরণার উৎস। তাঁর সাথে শেষ কথা হয়েছিলো অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে, এবার আমাদের বইমেলার উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। মেলায় না আসতে পেরে আফসোস করেছিলেন। দীর্ঘ আলাপচারিতায় অনেক কথা বলেছিলেন, গত কিছুদিন থেকে ফেইসবুকে তার সাংবাদিকতা জীবনের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে নিয়মিত লিখতেন। এসব নিয়ে কথা প্রসঙ্গে সিলেটের সাহিত্য এবং সংস্কৃতিজগতের অনেক অজানা তথ্য দিয়েছেন।
বলছিলেন শীঘ্রই দেখা হবে। কিন্তু তা আর হলোনা। তিনি আমাকে মেসেঞ্জারে নিয়মিত বিভিন্ন বিষয় শেয়ার করতেন, কলও করতেন মেসেঞ্জারে। কিন্ত আমার নিয়মিত মেসেঞ্জার দেখা হতোনা তাই তার পাঠানো বার্তাগুলো দেরীতে দেখতাম। তাঁর অসুস্থতার খবর জেনে মেসেঞ্জারে খবর নিতে গিয়ে দেখি গত এক মাসে অজয়দার সাতটি মিস কল। প্রচণ্ড বিষাদে মনটা ছেয়ে?গেলো। অপরাধী মনে হলো নিজেকে। আহা-রে অজয় দা, কী জানি কি বলতে চেয়েছিলেন। শেষ কথাগুলো আর শোনা হলোনা।
সিলেটে দেখা অজয় পাল আর লণ্ডনের অজয় পালের মধ্যে কাজের অনেক তফাৎ থাকলেও ব্যক্তি বৈশিষ্ট্য ছিলো সমান। প্রিয়জনদের প্রতি তার আন্তরিকতা আর ভালোবাসার কখনই কোন কমতি ছিলোনা। আমাদের সেই ভালোবাসার মানুষ আজন্ম নিসর্গের প্রেমিক, এখন অনন্ত আহবানে অন্য এক নিসর্গের বাসিন্দা, আমাদের ভুবনে, আনন্দ-বেদনায়, কোলাহলে, সিলেটে অথবা ইস্টএণ্ডের অলিতে গলিতে আমরা আর তাকে দেখবোনা ঠিকই। কিন্তু আমাদের হৃদয়ে তার মমতার ছাপ রয়ে যাবে আজীবন। তাঁর স্মৃতি, তার অকৃত্রিম মমতার আনন্দ আমার হৃদয়ে প্রতিনিয়ত আলোকিত বিতরণ করবে। প্রিয়জনদের প্রাণে প্রাণে থাকবেন অম্লান-চির ভাস্বর, সুপ্রিয় অজয় পাল। তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।
লেখক: কবি, ছড়াকার ও সংস্কৃতিকর্মী