মোহাম্মদ বেলাল আহমদ ♦
লণ্ডন, ১১ জানুয়ারী ২০২৩:
হঠাৎ করে চলে গেলেন অজয় পাল! আমাদের অজয় দা। ভাবতে খুবই কষ্ট হচ্ছে তার স্মৃতিকথা নিয়ে আর কোন কথা হবে না। সাম্প্রতিক সময়ে একান্ত এবং নিবিড় সাংবাদিকতা জীবনের স্মৃতিচারণ শুরু করেছিলেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সাংবাদিকতার পাশাপাশি সামাজিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন অজয় দা। একজন মাঠের সাংবাদিক হিশেবে দীর্ঘ পাঁচ দশকের তীক্ষ¦ পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন এই সময়টার সাক্ষী হয়েই ফুটে উঠতে থাকে তাঁর এসব স্মৃতিচারণমূলক লেখা।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে একজন কলমসৈনিক হিশেবে হাজারো মুক্তিকামী বাঙালিকে প্রেরণা যুগিয়েছেন তখন। বাঙালির সর্বোত্তম অর্জন তার স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধে অবদানকে কখনো জাহির করতে চাইতেন না। দুই বছর আগে হঠাৎ করে ছোটভাই স্বপন পালকে হারিয়ে একেবারে শোকবিহবল হয়ে পড়েন। অনেকটা স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে টুকরো টুকরো স্মৃতি লিখতে থাকেন। অনুপম বর্ণনা আর তথ্যউপাত্তসমৃদ্ধ তাঁর এসব স্মৃতিকথায় ইতিহাসের নানা অনুষঙ্গ ওঠে আসে।
৮০’র দশকের মাঝামাঝি সময়ে সাপ্তাহিক সুরমায় থাকাকালীন তাকে দেশে ফিরতে হয়। দেশে ফিরে গিয়ে সিলেটের স্থানীয় ও জাতীয় সংবাদপত্রের সাথে নিজেকে আবারো সম্পৃক্ত করেন। প্রবল নিষ্ঠা, অসামান্য পর্যবেক্ষণ শক্তি, কর্তব্যচেতনা ও প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে তাঁর নিরন্তর ভাবনা শুধু সিলেটেই নয়, জাতীয় গণমাধ্যমে তাকে একজন প্রভাব বিস্তারকারি ব্যক্তিত্বে পরিণত করে। দুই দশক পর অজয় দা আবারো বিলেত আসেন স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য। ব্যক্তিগতভাবে অজয় দার সাথে আমার সংযোগ এবং সম্পর্কের সূত্রপাত তখন থেকেই। ২০০৮ সালে লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের নির্বাহী কমিটির একজন সক্রিয় কর্মনিষ্ঠ সহকর্মী হিসাবে খুব কাছে থেকে তাকে দেখার সুযোগ হয়। অত্যন্ত সংবেদনশীল কাজ পাগল এই মানুষটাকে তখন সংগঠনের সৌহার্দ্য ও ঐক্য বজায় রাখতে বিশেষ ভূমিকায় দেখেছি।
বছর দুয়েক আগে আমার মায়ের ইন্তেকালের পর ফোন করেছেন সান্তনা দিতে। প্রবাসী হবার একটা বড় বিড়ম্বনা যে স্বজন হারানোর সময় পাশে থাকতে না পারা সেটি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তিনিও তাঁর মায়ের শেষ বিদায়ে সামনে হাজির থাকতে পারেননি এই দুঃখবোধ শেয়ার করতে গিয়ে চাপাকান্না ঝরে পড়ে তাঁর কণ্ঠে।
তাঁর স্মৃতিকথার টুকরো টুকরো লেখাগুলো আমাকে ভীষণভাবে টানতো। নানা বিষয়ে সংশয়, বিতর্ক ও বিভ্রান্তি নিরসনেও তার লেখাগুলো নিয়ামক ভূমিকা রাখতো।
সমাজ-বাস্তবতা তুলে ধরে লেখা এসব টুকরো টুকরো স্মৃতিকথা (ক্ষেত্রবিশেষে অপ্রিয়) ‘সাপ্তাহিক পত্রিকা’য় নিয়মিত প্রকাশের অনুরোধ করলে তিনি সানন্দে রাজী হন। বলেন, ‘আমি তো পত্রিকা পরিবারেরই একজন। আরো কয়েক কিস্তি তৈরী করেই পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশের জন্য?পাঠানো শুরু করবো।’ তা আর হলো না, কোনোদিন হবে না।
শুধু স্মৃতিকথাই নয়। প্রবাসে থেকেও ‘সারদা স্মৃতিভবন মিলনায়তন’ খুলে দেয়ার জন্য সাম্প্রতিক আন্দোলনেও তাকে ভূমিকা রাখতে দেখেছি। ‘আইলোরে নয়া দামান’ গানটির সুরকার ও গীতিকারবিতর্কে তাঁর ভূমিকা ছিলো প্রশংসনীয়।
প্রায়শই বলতেন, সততা আজ একেবারে উবে গেছে। নৈতিক মূল্যবোধ আজ পেশীশক্তি আর অর্থের নিগড়ে দলিত। সমাজে মূল্যবোধ তৈরীর অনুশীলন অনুপস্থিত।
ভীষণ মন খারাপ হচ্ছে এই ভেবে যে, তাঁর স্মৃতিকথা কিংবা সমাজের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে তাঁর সাথে আর কথা হবে না। স্থান-কালের সন্নিপাতে সৃজনশীল মূল্যবোধসম্পন্ন এক বিশেষ প্রতিভা অজয় দার সাংবাদিকতার মানদণ্ডের অনুসরণ আজ খুবই জরুরী। একই সাথে জরুরী তাঁর বহুমুখী সৃজনশীল কর্মযজ্ঞ- কবিতা, গান ও লেখনী বাঁচিয়ে?রাখা। অনন্ত যাত্রায় ভালো থাকবেন অজয় দা, অশেষ শ্রদ্ধা।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, সাপ্তাহিক পত্রিকা