হিমাংশু গোস্বামী ♦
লণ্ডন, ১৩ জানুয়ারী ২০২৩:
আজ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে অজয় পালের কথা বলতে হচ্ছে। ভাবিনি এতো তাড়াতাড়ি এভাবে তার কথা লিখতে হবে। সে আমার প্রাণের বন্ধু ছিলো। বয়সে আমার ছোট হলেও আমাদের দুজনের মধ্যে ছিলো হৃদয়ের অটুট বন্ধন।
তার সাথে আমার পরিচয় ১৯৬৯ সাল থেকে। তখন দেশ গণআন্দোলনে উত্তাল। চারদিকে মিছিল মিটিং শ্লোগান। অজয় তখন প্রতিবাদী পোস্টার লিফলেট লিখতো, সাথে গান কবিতা ছড়া। ৭৯/৭০ সালে আমরা যখন প্রতিবাদী গান গাইতাম তখন সে-ও আমাদের সঙ্গী। সিলেটের তৎকালীন দুটি সংগঠন একটা হলো সমস্বর আরেকটি হলো ”কলম তুলি কণ্ঠ”। অজয় এবং আমরা “কলম তুলি কণ্ঠ”তে একসাথে কাজ করেছি, সাথে ছিলো নাট্যকার বিদ্যুৎ কর, বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী হিমাংশু বিশ্বাস, সুবীর নন্দী, দুলাল ভৌমিক, অমিতাভ শ্যাম, সে হচ্ছে আমাদের সুজয় শ্যাম এর ছোটভাই।
আমাদের আরেফ বন্ধু ছিলো খুব প্রতিভাবান তার নাম হলো সুপ্রিয় সিনহা, সে সিনেমা পাগল ছিলো, সিনেমা করার জন্য পশ্চিম বাংলায় চলে গেলো সেখানে অনেক বড় বড় পরিচালকের সাথে সহকারী হিসাবে কাজ করেছে। সুপ্রিয় সিনহা এবং বিদ্যুৎ কর সুবীর নন্দী অকালে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। আরও অনেকেই ছিলো। আমরা রেজিস্টারী মাঠে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করতাম, অজয়সহ লেখক-সাংস্কৃতিক কর্মীরা আমাদেরকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতো। সেসময় আমরা সঙ্গীতশিল্পী এবং নাট্যশিল্পীদের মধ্যে একটা সমন্বয় ছিলো। আমরা যা করতাম সবাই মিলে করতাম। নাটকগুলোতে আমরা লাইভ মিউজিক দিতাম। সেসব দিনে আমরা পরস্পরের সাথে ভালোমন্দ শেয়ার করতাম, অজয়ও আমাদের সব কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকতো।
এর মধ্যে চলে আসলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আমরা সবাই চলে গেলাম সীমান্তের ওপারে। ২৪ মার্চ পর্যন্ত সিলেটে ছিলাম সবাই। ২৪ তারিখ আমরা গিয়েছিলাম বিশ্বনাথে একটা নাটক করতে, আমার গ্রামের বাড়ির পাশে মিয়ার বাজারে আমরা নাটক করি, আমাদের বন্ধু বিশিষ্ট নাট্যজন প্রয়াত নিজামউদ্দিন লস্কর ময়নাসহ অনেকেই ছিলাম সেদিন। অজয়ও ছিলো আমাদের সাথে।
সেখান থেকেই আমরা খবর পেলাম ঢাকায় গোলাগুলি শুরু হয়ে গেছে। আমরা অনেক কষ্ট করে হেঁটে সিলেটে আসলাম। এরপর অনেকেই ভারতে চলে যাই। যুদ্ধকালীন ৯ মাস আমি করিমগঞ্জ ও শিলচরে ছিলাম। ফরিদ গাজী সাহেবের তত্ত্বাবধানে, হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য ও বাবুলদা সেখানে আমাদেরকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ত্বরান্বিত করতে “বাংলাদেশ গণমুক্তি শিল্পী গোষ্ঠী” গঠন করেন। যুদ্ধ শেষে যখন দেশে আসলাম তখন নতুন উদ্যমে আমরা আবার কাজ শুরু করলাম। তখন অজয় পালের সাথে সম্পর্ক আরও গাঢ় হয়, প্রতিদিন আমাদের দেখা হতো। অজয়দের বাসা ছিলো সিলেট শহরের দাড়িয়াপাড়ায়। সেখানে একটা সংগঠন ছিলো চৈতালি সংঘ নামে। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল সাংস্কৃতিক কর্মীরা আড্ডা দিতেন এখানে। তখন আমাদের সাথে ফজল মাহমুদও ছিলেন। অজয় তখন গান কবিতা লেখার সাথে সাংবাদিকতায় বেশী সময় দিতে শুরু করে। দিনে দিনে তার সাথে আমার হৃদ্যতা বাড়তে থাকে।
সে তখন থেকেই বেতারের নিবন্ধিত গীতিকার। সাথে রেডিওতে গীতিনাট্য, গীতি আলেখ্য সে লিখতো। আমরা শিল্পীরা তার গান গাইতাম। এক সময় সে কিছুদিনের জন্য ঢাকায় চলে যায় এবং বিশিষ্ট সঙ্গীত পরিচালক সুজয় শ্যামের সাথে থাকতো। তখন বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্য ও অনেক গান লিখে।
তখন সিলেটের খ্যাতিমান কণ্ঠ শিল্পী বিদিত লাল দাশের নেতৃত্বে আমরা একটি দল গঠন করি। সেটি অনেক নাম করেছিলো। পটলদার সাথে সেই দলে ছিলাম আমি আকরামুল ইসলাম, একে আনামসহ আরও কয়েকজন। সেসময় ঢাকায় আমরা যেসব অনুষ্ঠান করতাম সেই অনুষ্ঠানের সার্বিক সহযোগিতায় অজয় ও আমাদের সাথে থাকতো। সেসময় আমরা একসাথে অনেক কাজ করেছি।
পরবর্তীতে আমি লণ্ডনে চলে আসি ৭৮-এর দিকে। আসার পর নিয়মিত তার সাথে যোগাযোগ হতো। এখানে এশিয়ান মিউজিক কম্পিটিশনে আমি যখন প্রথম হয়ে গোল্ড মেডেল পেলাম এই খবরে অজয় খুব খুশী হয়েছিলো এবং সে এই খবরটি দেশের জাতীয় সংবাদপত্র সহ রেডিও টেলিভিশনে প্রচার করে এবং আমার সম্পর্কে লেখালেখি করে। পরবর্তীতে ৮৪ সালের দিকে সে-ও লণ্ডনে চলে আসে, তখন সাপ্তাহিক সুরমায় সে কাজ করতো। আমাদের ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়ে তখন। আমি সেসময় ইনার লণ্ডন অথরিটিতে মিউজিক টিচার হিসাবে কাজ করি, এই সুবাদে তার বেশ কিছু দেশের গান, ছড়াগান আমি এখানকার স্কুলগুলোতে ছেলে মেয়েদেরকে শিখিয়েছি। গান রচনায় সে খুবই দক্ষ ছিলো। সাংবাদিক হিসাবে তার খ্যাতি থাকলেও গীতিকবি হিসাবেও সে অনন্য। তার লেখা অনেক দেশের গান আধুনিক গান আমাদের সঙ্গীতকে সমৃদ্ধ করবে এবং অমর হয়ে থাকবে।
৮০ দশকে কয়েক বছর এখানে থেকে সে দেশে চলে গিয়েছিলো। আবার ২০০৫ সাল থেকে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য সপরিবারে সে লণ্ডনে চলে আসে। তখন থেকে পারিবারিক ভাবে আমরা আরও ঘনিষ্ঠ হই। সুখে দুঃখে বিগত দিনগুলোতে আমরা পাশাপাশি ছিলাম। তার সহধর্মিনী দীপা পাল একজন অসাধারণ মহিলা। আমরা যারা শিল্পী সাহিত্যিক তারা সবসময় সংসারের প্রতি উদাসীন, আমি আমার কথাই বলি, আমার সহধর্মিণীর সহযোগিতা না থাকলে এদেশে আমি এই অবস্থানে পৌছাতে পারতাম না, ঠিক তেমনি অজয়ের স্ত্রী দীপাও অজয়কে সবসময় অনুপ্রাণিত করেছে। এখানে অনেক সমস্যায় জর্জরিত থেকেও সে সংসারের হাল ধরেছে। অজয় গত বিশ বছর লণ্ডনে ছিলো, সে যেহেতু সাংবাদিক তাই অন্য কোনো কাজ তার দ্বারা করা এতো সহজ ছিলোনা, এজন্য তাকে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়েছে। তবে দুঃখের বিষয়- লণ্ডনে অনেকগুলো কাগজ এবং টেলিভিশন থাকা সত্ত্বেও অজয় পালের মতো একজন প্রথিতযশা সাংবাদিককে আমরা কোথাও স্থান দিতে পারিনি। দিতে পারলে হয়তো তার লেখনির মাধ্যমে কমিউনিটি অনেক লাভবান হতো।
অজয় মানুষকে ভালোবাসতো দেশকে ভালোবাসতো, ভালোবাসতো জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে। সে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দেশের স্বাধীনতা নিয়ে অনেক গান লিখেছে, আমি তার বহু গান গেয়েছি। একটা গান আছে একুশে এবং আরেকটি ৭ মার্চ নিয়ে। ৭ মার্চের গানটি অসাধারণ। করোনা মহামারী নিয়ে লিখা তার আরেকটি অসাধারণ গান ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। অজয়ের সাথের স্মৃতিগুলো আমার জীবনের পরম সম্পদ। আমি থাকে ভুলবোনা কোনদিন। তার গান ও কবিতাসহ সকল রচনার মাধ্যমে অজয় আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবে চিরকাল। তার আত্মার শান্তি কামনা করি।
লেখক: বিলেতবাসী বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী