হামিদ মোহাম্মদ ♦
লণ্ডন, ১২ জানুয়ারী ২০২৩:
‘আমড়া গাছে তিন উকিলের বাসা’ অজয় পালের একটি সংবাদ শিরোনাম। প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৮ সালে ‘সিলেট সমাচার’ পত্রিকায়। সংবাদটির শিরোনাম দেখেই যে কোন পাঠক বুঝতে পারবেন, অজয় পাল কতটুকু রসবোধসম্পন্ন সাংবাদিক ছিলেন।
সিলেট প্রেসক্লাবের পাশের গলির মুখে একটি আমড়া গাছ। সেই আমড়া গাছে পেরেক ঠুকে তিনটি সাইনবোর্ড। তিন উকিল তাদের বৃত্তান্ত দিয়ে সাইনবোর্ড টাঙিয়েছেন। এই সাইনবোর্ড অজয় পালের দৃষ্টি এড়ায়নি। সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকায় নিউজ। এ নিয়ে ঐ উকিলদের সাথে সংবাদ প্রকাশের পর বাকবিতণ্ডা হয়। স্বভাবসুলভ কৌতুকপূর্ণ হাস্যরসে তাদের ক্ষোভ তিনি তখন উড়িয়ে দেন। আরেকটি সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘বিড়াল কি আগে জানতো?’। ঈদগাহ এলাকায় এক বাসার পাকঘরে বিড়াল ঢুকে পাতিল উল্টে রান্নাকরা মাছ খেয়ে ফেলে। এই বিড়ালটি আবার পাশের বাসায় বেশি আনাগোনা করতো। ভুক্তভোগী ব্যক্তি দায়ী করলেন বিড়ালটি পাশের বাসার পালিত। সুতরাং, আর যায় কই? যেই ভাবা সেই ঝগড়া শুরু, পরে মারামারি। বিষয়টি থানা হাজত আদালত পর্যন্ত গড়ায়। কাহিনিটি শুনে অজয়দা ‘বিড়াল কি আগে জানতো’ শিরোনামে নিউজ করলেন রসিয়ে রসিয়ে বর্ণনা দিয়ে। পাঠকরা পড়ে মজা পায়।
অজয় দা সিরিয়াস কোন ঘটনা বা জটিল বিষয় নিয়ে যেভাবে নিউজ করতেন, যা রুদ্ধশ্বাসে পড়তে হতো পাঠককে। এমনি প্রাঞ্জল ভাষায় সংবাদ লেখার একটি ফর্ম দাঁড় করিয়েছিলেন সিলেটে তিনি। সংবাদ লেখায় আমাদের হাতে খড়ি হয়েছে অজয়দার ছায়ায়ই।
১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে আমি যখন যুগভেরীতে কাজ শুরু করি তখন অজয়দা যুগভেরী ছেড়ে দিয়েছেন। তবে দৈনিক সংবাদ-এর জেলা প্রতিনিধি ছিলেন তিনি। এখনকার মত জাতীয় দৈনিকের প্রতিনিধিদের সে সময় অফিস ছিল না। ঘরে বসে বা প্রেসক্লাব অফিসে কিংবা জরুরী নিউজ টেলিফোন অফিসে গিয়ে ট্রাংককলে বা ফোনে প্রেরণ করা হতো। অজয় পাল ঘটে যাওয়া কোন ঘটনার কোন নিউজ কোনদিন মিস করতেন না, সকালে ঢাকা থেকে দৈনিক পত্রিকা এলেই সংবাদ পত্রিকার পাতা খুলে প্রতিদিন অজয় দার লেখা নিউজ বা প্রতিবেদন পাঠক আলাদা স্বাদে পেতেনই। আমরাও মুখিয়ে থাকতাম, অজয়দার ভিন্ন ধারার প্রতিবেদন পড়ার জন্য।
অজয় পাল যুগভেরী ছেড়ে কিছুদিন ‘সাপ্তাহিক দেশবার্তা’র কাষ্টঘর অফিসে কাজ করেছেন, এর পর সাপ্তাহিক সমাচার প্রকাশিত হলে যোগ দেন নতুন এই পত্রিকাটিতে। স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে কখনো সহকারি সম্পাদক, কখনো বার্তা সম্পাদক পদেই তিনি কাজ করেছেন। সিলেট শহরে সাংবাদিক হিসাবে অজয় পাল সুধীমহলে আদৃত ছিলেন তার সততা ও নিষ্ঠার জন্য। হলুদ সাংবাদিকতার স্থান ছিল না তার কাজের মধ্যে। আমরা দেখেছি, যেখানে প্রশাসনের তাবেদার হিসাবে অনেকেই নানা সুবিধা নিয়েছেন, অজয় পাল সেখানে ভিন্ন। বরং প্রশসানের রোষানলে পড়ে কারাবরণ করেছেন। সমাজে ব্যক্তিগত অবস্থান, সামাজিক মর্যাদা, সাংবাদিকতার পেশাদারিত্ব সব কিছুই তিনি নিয়েছিলেন চ্যালেঞ্জ হিসাবে।
যুগভেরীতে ‘শাপলার মেলা’ নামে শিশুপাতাটি চালু করেছিলেন অজয়পাল। ছিলেন যুগভেরীর সহকারি সম্পাদক। তাকে ঘিরেই গড়ে ওঠেছিল ‘শাপলারমেলা’ শিশুকিশোর সংগঠন। প্রতিমাসে বসতো তরুণ লেখকদের লেখাপাঠের আসর। পঠিত ভাল লেখাগুলো পত্রিকায় প্রকাশ করা হতো। নতুনদের জন্য ছিল তা উত্তেজনাপূর্ণ। অজয় পাল যুগভেরী ছাড়ার পর মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান তা অব্যাহত রাখেন। যুগভেরীতে আমি যোগ দিয়ে শাপলারমেলার দায়িত্ব নিই। দীর্ঘ দিন শাপলারমেলা চালু ছিল। অজয়পাল সৃষ্ট শাপলার মেলা সিলেটে অনেক প্রতিশ্রুতিশীল কবি ও লেখকের জন্ম দিয়েছে। লেখালেখি, সাংবাদিকতা, সাংস্কৃতিক কাজে সিলেটে একটি বলয় সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন অজয় পাল। দুহাতে গান ও সৃজনশীল ছড়া লিখেছেন, রেডিওতে সংবাদ পাঠ করেছেন, নাটক করেছেন। কী-ই না করেছেন অজয় পাল। কিন্তু স্ট্যান্টবাজির সাংবাদিকতা বা রাজধানি কেন্দ্রিক সাংবাদিকতায় ঝাঁপ দেননি তিনি। লন্ডনে এসেও সাংবাদিকতায় যুক্ত থাকেন। এখানেও নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলেন অজয় পাল। সিলেটের উজ্জ্বল সেই দিনগুলোতে তার গুণমুগ্ধ ছিলাম আমরা এক ঝাঁক তরুণ। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা কখনো কমতি হয়নি। বিলাতের বাঙালি সমাজেও অকুণ্ঠ ভালোবাসা কুড়িয়েছেন তিনি। মধুর সম্পর্ক ছিল সকলের সাথে। সেই অকৃত্রিম ভালোবাসার মানুষটি ভালোবাসার সম্পর্ক ছিন্ন করে সহসা পরপারে পাড়ি দিলেন। অমোঘ মরণ ছাড়লো না তাকে। অজয়দা, তুমি যেখানেই থাকো, ভালোবাসা ছিন্ন হবে না কোনদিন। যদি পুর্নজন্ম সত্য হয়, সাংবাদিক হয়ে এসো। স্মিত হাসি মুখের অজয় পালকে সাংবাদিক হিসাবেই পুনরায় দেখতে চাই আমাদের দুঃখদিনের সাথী, হে সারথি বন্ধু।
লেখক: কবি, সাংবাদিক