মাসুদ রানা ♦
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার যুদ্ধ-কালে বাংলাদেশ রিপাবলিকের জন্ম হয়েছিলো রাষ্ট্রপতিক সরকার গঠনের মাধ্যমে, যার প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
আমি বহু বছর ধরে বলছি, বাংলাদেশের উচিত হবে পুনরায় রাষ্ট্রপতিক সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া। এ-বিষয়ে আমি সুনির্দিষ্টভাবে দশ-দফা প্রস্তাব করেছি।
যারা আমার লেখা নিজ আগ্রহে পত্রিকান্তরে প্রকাশ করে থাকেন, তাদেরকে আমি অনুরোধ করছিঃ আমার প্রস্তাবিত ‘দশ-দফা’ প্রকাশ করুন, যাতে এ-নিয়ে রাজনৈতিক আলোচনা ও বিতর্ক হতে পারে।
নির্বাহী ক্ষমতার নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি, দ্বিকক্ষের পার্লামেণ্ট, নির্দলীয় নির্বাচিত উচ্চকক্ষ, এমপিদের মন্ত্রী হওয়ার নিষিদ্ধতা, অসন্তুষ্ট হলে ভৌটারদের দ্বারা এমপিদের রিকল বা প্রত্যাহার করা, বিচার বিভাগের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা, আইনের লঙ্ঘনে কিংবা দুর্নীতিতে রাষ্ট্রপতিকে পদচ্যুত করার পার্লামেণ্টীয় ক্ষমতা, দুই মেয়াদের বেশি কারও রাষ্ট্রপতি হওয়ার বিধান-সহ সমগ্র প্রস্তাবটি গণ-মাধ্যমে এক মাস ধরে আলোচিত হোক!
আমি আরও প্রস্তাব করছি, সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তন প্রস্তাবের ওপর একটি রেফারেণ্ডাম বা গণভৌট হোক। বাংলাদেশের জনগণ যদি প্রস্তাবিত এই পরিবর্তন সমর্থন করে, তা কার্যকর হোক। আমি মনে করি, বাংলাদেশ রিপাবলিক পরিচালনায় যদি এক্সিকিউটিভ প্রেসিডেন্সি, লেজিসল্যাটিভ পার্লামেণ্ট, ও স্বাধীন জুডিশিয়ারি মধ্য একটি ’ব্যালেন্স অফ পাওয়ার’ প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাতে দেশ ও রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসিত হবে। আর, যদি তাই হয়, সেটি হবে বস্তুতঃ ইতিহাসে বাংলাদেশের সেকেণ্ড রিপাবলিক।
উল্লেখ্য, আমরা যে বর্তমানে ফ্রান্সে যে রাষ্ট্রটি দেখছি, সেটি হচ্ছে ফিফথ রিপাবলিক। মনে রাখতে হবে, একটি দেশের একটি জাতি সময়ের প্রয়োজন বিভিন্ন প্রকারের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে। আমি আহবান করছি, নীচের দশ-দফাকে ভিত্তি করে চলুন বাংলাদেশের সেকেণ্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা করি!
প্রস্তাবিত দশ-দফা:
(১) রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা, যেখানে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন সারাদেশের প্রাপ্তবয়স্ক সকল নাগরিকের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভৌটে। তিনি নির্বাচিত হবেন পাঁচ বছরের জন্যে এবং কোনো ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না।
(২) পার্লামেণ্ট হবে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট, যার নিম্নকক্ষ হবে জনসংখ্যানুপাতিক ও দলীয়, এবং উচ্চকক্ষ হবে উপজেলা ভিত্তিক ও নির্দলীয়। পার্লামেণ্টের কাজ হবে আইন তৈরি করা, সরকার গঠন করা নয়।
(৩) সরকার গঠন করবেন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি, যেখানে তিনি পার্লামেণ্টের নির্বাচিত কোনো সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারবেন না। পার্লামেণ্টের সদস্যগণ সতর্ক নজর রাখবেন সরকারের প্রতিটি বিভাগের ওপর, যাতে তারা আইনের ভেতরে রাষ্ট্র পরিচালনা করে। (৪) বিচার বিভাগ হবে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও বিকেন্দ্রিক, যার কাজ হবে আইনের শাসন নিশ্চিত করা এবং আইনের লঙ্ঘনে অনুরুদ্ধ বা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তার বিচার করে প্রতিবিধান করা।
(৫) পার্লামেণ্টের আইনানুসারে স্থানীয়ভাবে বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, উন্নয়ন, জনকল্যাণ ও নিরাপত্তা-সহ মৌলিক পরিষেবার জবাবদিহি-সহ পরিকল্পনা ও প্রদানের ক্ষমতা ন্যস্ত করে গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
(৬) পার্লামেণ্টের নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্যে রাজনৈতিক দলের গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র থাকতে হবে এবং এর সদস্যদের গঠনতান্ত্রিক অধিকার আইনের দ্বারা সংরক্ষিত থাকবে, যার লঙ্ঘন হলে তারা আইনের আশ্রয় নিতে পারবেন, যাতে কোনো দল একনায়কতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে না পারে।
(৭) নির্বাচিত পার্লামেণ্ট সদস্যদেরকে তাঁদের নির্বাচনী এলাকায় নিয়মিত সার্জারিতে বসে জনগণের অভাব-অভিযোগের কথা শুনতে হবে, যাতে তারা পার্লামাণ্টের অধিবেশনে গিয়ে সেকথা তুলে ধরতে পারেন।
(৮) পার্লামেণ্টের কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধি তাঁর এলাকার জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে ব্যর্থ বলে বিবেচিত হলে, উপযুক্ত কারণ ও প্রমাণ দেখিয়ে তাঁকে “রিকল” বা প্রত্যাহারের জন্যে ১০% ভৌটার সম্মিলিতভাবে নির্বাচন কমিশনের কাছে আবেদন করতে পারবেন।
(৯) নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন পরিচালনা করবে এবং কোনো প্রতিনিধির বিরুদ্ধে “রিকল” আবেদন পেলে, তার যৌক্তিকতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ার সাপেক্ষে সেই প্রতিনিধিকে অনুপযুক্ত ঘোষণা করে পুনঃনির্বাচনের ব্যবস্থা করবে।
(১০) রাষ্ট্রপতি সংবিধানের প্রতি অবিশ্বস্ত হলে, আইনের পরিপন্থী চললে কিংবা অনৈতিক কর্মে লিপ্ত হলে তাঁর বিরুদ্ধে পার্লামেণ্টের যে-কোনো কক্ষে অনাস্থা প্রস্তাব আনা যাবে, যদি কোনো একটি কক্ষের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য তাতে সম্মতি দেন। কিন্তু তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করতে হলে প্রধান বিচারপতির সভাপতিত্বে পার্লামেণ্টের উভয় কক্ষের যৌথ অধিবেশনে উপস্থিত দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন প্রয়োজন হবে।
বৃহস্পতিবার, ২৭ জুলাই ২০২৩ ।। নিউবারী পার্ক, এসেক্স, ইংল্যাণ্ড