আমাদের অলিখিত চুক্তি
সাগর রহমান ♦
আপনার এবং আমার মধ্যে কথা হবে বলে কথা হয়েছে। তাই আপনি যখন কথা বলেন, তখন আমি আপনার কথা শুনতে চাই। আমার চোখ আপনার চোখে, শব্দ উচ্চারণের সাথে সাথে আপনার চোখের মণির আকার ক্ষণে ক্ষণে বদলাচ্ছে, এই সজীব হয়ে জ¦লে উঠছে, এই হতাশায় নিভু নিভু হয়ে যাচ্ছে – আমি যখন আপনার কথা শুনি, আমি তখন আপনার চোখের দিকে তাকিয়ে আমার মনোযোগ নিবিষ্ট করতে চাই। আপনি যখন কথা বলেন, আপনার সাথে সাথে কথা বলে ওঠে কত কত কথা! আপনার অতীত কল-কল করে ওঠে আপনার উচ্চারণে, আপনার বিচিত্র জীবন-অভিজ্ঞতা প্রাণ পেয়ে শব্দের ফাঁক-ফোঁকরে ঝংকৃত হয়ে ওঠে। আপনার ভুলগুলো, আপনার শুদ্ধগুলো, আপনার দ্বিধা এবং দ্বন্দ্বগুলো, আপনার ভালোলাগা এবং মন্দলাগাগুলো ঝরে ঝরে পড়ে আপনার শব্দচয়নে, আমি সেই শব্দগুলো শুনতে শুনতে আপনার আপনার ভুল এবং শুদ্ধ এবং দ্বিধা এবং দ্বন্দ্ব এবং ভালোলাগা এবং মন্দলাগাগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে চাই। আমি যখন আপনার কথা শুনি, তখন আমার সমস্ত মনোযোগ আপনার মুখের পেশিতে, শিরার স্পন্দনে।
আমার পকেটে একটি যন্ত্র আছে। থেকে থেকে যন্ত্রটিতে নানান শব্দ হয়, নানান বার্তা উপস্থিত হয়। যন্ত্রটি টিপলেই পুরো দুনিয়া আমার চোখের ভেতরে ঢুকতে থাকে গল গল করে। আমার অসংখ্য বন্ধুর অসংখ্য বার্তা, অসংখ্য ছবি, অসংখ্য জীবনোপলদ্ধি ঐ যন্ত্রের ভেতর দিয়ে আমার সাথে সম্মিলিত হতে অস্থির অপেক্ষা করে আছে। কত কত বিনোদনের উপাদান আমাকে আন্দোলিত করার জন্য মুখিয়ে আছে ঐ সাত ইঞ্চি যন্ত্রটিতে। যন্ত্রটি আমার পকেটে থেকে থেকে একটু পর পর সাড়া-শব্দ করছে। কিন্তু আমি যখন আপনার কথা শুনি, তখন ঐ যন্ত্রটি আমি খুব বাধ্য না হলে বের করি না। আমার আঙুল নিশপিশ করছে, আমার মন বলছে না-জানি কত কত মজার বার্তা, ভিডিও, অডিওর স্রোত পেরিয়ে যাচ্ছে আমাকে ফেলে। কিন্তু আমি শান্ত থাকি। আমি যন্ত্রটিকে যথাস্থানে রেখে দিয়ে আপনার কথা শুনি। আমি বিশ্বাস করি, আপনি যখন আমার সাথে কথা বলছেন, এবং আমি আপনার কথা শুনবো বলে আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, আমাদের কথা হবে বলে যেহেতু আমাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে একটি অনুক্ত চুক্তি, অতএব আপনার কথা শুনতে শুনতে আমি আমার মনোযোগ আর কিছুতে দিতে পারি না, এটা আমার ভদ্রতায় বাধে, এটা মানুষে-মানুষের যে অলিখিত বন্ধন, তাকে অপমান করে। আপনি আমাকে কিছু বলছেন, আর আমি অন্যমনস্ক ‘হুঁ হাঁ’ করতে করতে আমার পকেটের যন্ত্রটি বের করে তার গায়ে বুড়ো আঙুলের অস্থির ঠোকাঠুকি করছি – এ ব্যাপারটা আমার কাছে খুব অশ্লীল মনে হয়, মনে হয় খুব অভদ্র, এবং প্রায় বর্বর একটি কাজ।
অতএব, আমি যখন আপনার কথা শুনি, তখন কেবল আপনার কথা শুনি, খুব দরকারি না হলে আর অন্য কিছু করি না। তখন যদি কেউ আমার যন্ত্রে ঢুকে পড়তে চায়, আমি খুব দরকার মনে না করলে তাকে ঢুকে পড়তে দিই না, যদি একান্তই ঢুকে পড়তে দেই, তবে তার প্রয়োজনটি সংক্ষেপে শুনে নিয়ে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে বলি যে তার সাথে আমি অন্য সময় যোগাযোগ করবো, এখন আমার সাথে একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ বসে আছেন, তার কথা শুনছি আমি। আমি আশা করি, আপনিও যখন আমার কথা শুনবেন, আপনিও এই মৌলিক নীতিটি মেনে চলবেন। আমিও আশা করি, আমার কথা শুনতে শুনতে আপনি হুট করে আপনার পকেটের যন্ত্রটি বের করে, যন্ত্রটির গায়ে বুড়ো আঙুলের অস্থির ঠোকাঠুকি করতে করতে অন্য মনস্ক ‘হুঁ হাঁ’ শব্দের অর্থহীন সংগত করবেন না। আমি জানি, আমি ছাড়াও আপনার অন্তত আরো চারহাজার নয়শত নিরানব্বইজন বন্ধু আছে।
কিন্তু আমরা যখন একসাথে কফি খেতে বসেছি, তখন এই দুজনের টেবিলে আপনার হাজার হাজার অনুপস্থিত বন্ধুদের টেনে এনে ভীড় বাড়াবেন না। আমি বলছি না যে আপনার ঐ অনুপস্থিত বন্ধুরা, কিংবা তাদের বার্তাটি, কিংবা তাদের ‘স্ট্যাটাসগুলো গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমি চাই আপনি সেগুলো গুরুত্বের সাথেই দেখুন। তবে আমার ক্ষুদ্র চাওয়াটি হচ্ছে- ওগুলোকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে আপনার সামনে উপস্থিত আমাকে অগুরুত্বপূর্ণ করে ফেলবেন না। আমি আশা করি কেউ আমাদের কথা বলার সময়টাতে আপনার সাথে অদরকারী আলোচনা শুরু করার জন্য আপনার পকেটের যন্ত্রে ঢুঁ মারতে শুরু করলে আপনি তাকে সম্মানের সাথে বলবেন যে তার সাথে আপনি অন্য সময়ে কথা বলবেন, এখন আপনি একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষের সাথে বসে আছেন। জি¦, আপনি আমার কাছে একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, না হলে আমি আপনার সাথে সময় কাটাতাম না। আমি চাই, আপনিও আমাকে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ বলে বিবেচনা করবেন যেহেতু আপনি আমার সাথে সময় কাটাতে রাজি হয়েছেন। আমরা হয়তো খুব অগুরুত্বপূর্ণ কিছু নিয়েই সময় কাটাচ্ছি, হয়তো দু পেয়ালা কফি হাতে চুপ করে বাইরের দিকে চেয়ে মুখোমুখি বসেই আছি, তবু আমি বিশ্বাস করি আমাদের এই চুপ করে থাকাটার গুরুত্ব আপনার এবং আমার অনুপস্থিত বন্ধুদের সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করে যাওয়া শত শত স্ট্যাটাসগুলো পাঠের চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যখন একসাথে সময় কাটানোতে সম্মত হয়েছি, তখন এই অলিখিত চুক্তিটিতে আপনি এবং আমি অলিখিত সই করেই সম্মত হয়েছি।
আমি সেই চুক্তি ভঙ্গ করতে চাই না। আমি চাই আপনিও চাইবেন না। আপনার এবং আমার পকেটে থাকা যন্ত্রটি বিংশ শতাব্দীর একটি অন্যতম আবিষ্কার। যন্ত্রটির নাম মোবাইল ফোন। ওটি খুব দরকারী জিনিস। যখন তখন ওটাতে অঙুলি চালানোর জন্য ওর জন্ম হয়নি। ওকে অদরকারী বানাবেন না। আপনি কি জানেন, উননব্বই ভাগ আমেরিকান তাদের সামাজিক মেলামেশার মাঝখানেই পকেটের ফোন-যন্ত্রটি বের করে বসে থাকে। আপনি কি এও জানেন যে ঐ উননব্বই ভাগের মধ্যে বিরাশি ভাগই স্বীকার করেছে যে এর ফলে তাদের আলোচনা, কথা-বার্তা, সামাজিক মেলামেশাটি ঠিক যতটুকু সুন্দর হতে পারতো, হতে পারতো আরো হৃদ্যতায় পূর্ণ, তা হয় না। আপনি এর কারণও নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। আমরা যখন মিলিত হই মুখোমুখি, কথা বলি, দরকারি-অদরকারি আলোচনায় মাতি, তর্কে উত্তপ্ত হই, কথা বলতে বলতে চোখে চোখ রাখি, পরস্পরের গলার স্বরের উঠানামা শুনি, উপলদ্ধি করি পরস্পরের অস্তিত্ব, তখন?- এর মধ্যেই আমাদের সম্পর্কটি গাঢ়তর হয়, আমাদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা জন্ম নেয়, জন্ম নেয় আমাদের জোট, ভ্রাতৃত্ব, বন্ধন। আমেরিকানদের সম্পর্কে ঐ তথ্যটি আমি ‘রিক্লেইমিং কনভারশেসান’ বইয়ের লেখিকা এবং গবেষক শেরি টার্কেল-এর লেখা থেকে পেয়েছি। এমন কোনো গবেষণা আমাদের দেশে হয়েছে কিনা আমি জানি না, তাই বাধ্য হয়েই আমেরিকান জনগণের উপরে করা জরিপটি ব্যবহার করেছি আমি। এবং বলতে চাইছি যে, এটা আমার পণ যে আমি ঐ উননব্বই ভাগ আমেরিকানের মতো হবো না। আমি চাই আপনিও তেমন পণ করুন। কেননা, আমার সাথে কথা বলতে বলতে আপনি যখন ফোন ব্যবহার করতে শুরু করেন, আপনার বুড়ো আঙুলটি যখন মৃগী রোগীদের প্রত্যঙ্গের মতো অনিয়ন্ত্রিত উপর-নিচ করতে থাকে আপনার ফোনের স্ক্রিনে, তখন আপনি আমাকে এই অনুচ্চারিত বার্তটি দেন যে, আপনার স্ক্রিন এবং স্ক্রিনে ভেসে থাকা ভার্চুয়াল জগত, সেই জগতের বাসিন্দারা সামনে উপস্থিত আমার চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এটি আমার কাছে তাই খুব আপত্তিকর। আমি আপনাকে ঐ বার্তাটি দিতে চাই না বলে আমি অমন কাণ্ড করি না। দয়া করে আপনিও করবেন না। আমি মনেপ্রাণে পিটার গুবারের এই কথাটি বিশ্বাস করি: Nothing replaces being in the same room.Face_to_face–breathing and feeling each other’s micro_expressions. আমি চাই আপনিও কথাটি বিশ্বাস করুন। কেননা, কথাটি সত্যি। এবং দিনে দিনে আমরা যত মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছি যন্ত্রের, কথাটি হয়ে পড়েছে আরো সত্যিতর।
লণ্ডন, ৫ অক্টোবর, ২০২৩
লেখক: কথাসাহিত্যিক