গাজীউল হাসান খান ♦
আপাতদৃষ্টিতে অনিশ্চিত মনে হলেও একটি নতুন রাজনৈতিক জীবন হাতে পেয়েছেন ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের ধূর্ত ও কপট প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। সেটি তাঁর সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য, এখনই তা বলা না গেলেও এটি নিশ্চিত যে তিনি ইতিহাসের এক নিদারুণ অন্তিম দৃশ্যে অবতীর্ণ হয়েছেন। কারণ তাঁর বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির মামলা এবং দেশের (ইসরায়েল) আইন ও বিচার বিভাগের কণ্ঠরোধ করার অভিযোগে চলমান গণ-আন্দোলনে নেতানিয়াহুর ক্ষমতা হারানোর আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, কিন্তু সেটি না হয়ে হলো তার বিপরীত। ফিলিস্তিনের মুক্তির পরিবর্তে তার অবরুদ্ধ বাসিন্দাদের নিজ নিজ বাসগৃহ থেকে উচ্ছেদ ও ইহুদিদের জন্য নিত্যনতুন বসতি নির্মাণ এবং সর্বোপরি মুসলিম বিশ্বের কাছে পবিত্রতম আল-আকসা মসজিদের লাগাতার মর্যাদাহানির কারণে গাজাসহ সমগ্র ফিলিস্তিনের মানুষ ফুঁসে উঠেছিল।
এরই বহিঃপ্রকাশ হিসেবে গাজার মানুষের নেতৃত্বে থাকা হামাসের সংগ্রামী অংশ গত ৭ অক্টোবর এক অভূতপূর্ব আক্রমণের সূচনা করে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের অভ্যন্তরে। এতে শুধু মধ্যপ্রাচ্যের আরবরাই নয়, হকচকিত হয়ে পড়ে বিশ্ববাসী। এ ঘটনার আকস্মিকতায় ইসরায়েলের নাগরিকরাসহ বিশ্ববাসী বিহবল হয়ে পড়লেও দিশা হারাননি কৌশলী রাজনীতিক নেতানিয়াহু। তিনি তাৎক্ষণিকভাবেই এক অমানবিক বৃহত্তর এজেণ্ডা নিয়ে মাঠে নেমে পড়েন।
তাঁর সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য হচ্ছে গাজা উপত্যকা থেকে শুধু হামাসকে নিশ্চিহ্ন করাই নয়, সমগ্র ফিলিস্তিনের নাম-নিশানা মুছে দিয়ে ইসরায়েলের নেতৃত্বে এক নতুন মধ্যপ্রাচ্য গড়ে তোলা। তাই তিনি হামাসের অভিযানকে কেন্দ্র করে প্রথমেই ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ইসরায়েলে জরুরি অবস্থা জারি করেছেন।
গাজা উপত্যকার শাসকদল হামাসের সাম্প্রতিক অভিযানের কারণে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, তিনি গাজাকে সম্পূর্ণভাবে গুঁড়িয়ে দেবেন। মিশিয়ে দেবেন মাটির সঙ্গে, মরুভূমিতে পরিণত করবেন এই জনপদ।
তাই তিনি ‘অপারেশন আয়রন সোর্ড’ নামে এক সামরিক অভিযানের সূচনা করেছেন। শুধু গাজা নগরীর সুউচ্চ অট্টালিকার ওপরেই নয়, জঙ্গিবিমান থেকে উপর্যুপরি হামলা অব্যাহত রেখেছেন ঘন জনবসতিপূর্ণ এলাকায়, যা থেকে মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং এমনকি চিকিৎসাকেন্দ্রও বাদ পড়েনি। নেতানিয়াহুর ঘোষণা অনুযায়ী গাজায় হামাসসহ কোনো ফিলিস্তিনি আর বসবাস করতে পারবে না। তাদের নিশ্চিহ্ন করা হবে। এর বিকল্প হিসেবে তিনি গাজাবাসীকে প্রতিবেশী মিসরের রাফা সীমান্ত দিয়ে সে দেশে আশ্রয় নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
নেতানিয়াহুর অঘোষিত পরিকল্পনা অনুযায়ী ভবিষ্যতে গাজা উপত্যকায় ইহুদিদের জন্য নতুন বসতি স্থাপন করে ইহুদিবাদী ইসরায়েল রাষ্ট্রকে সুরক্ষিত করা হবে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে তাঁর ইহুদি বসতি বিস্তারের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। এতে ফিলিস্তিনি আরবদের উচ্ছেদ করে বসবাসের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে বহিরাগত ইহুদিদের। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্সসহ কোনো বড় শক্তিধর রাষ্ট্র এ পর্যন্ত তাঁর বিরোধিতা করে কোনো বক্তব্য দেয়নি।
ইহুদিবাদীদের অন্যায়ের প্রশ্রয় দিতে দিতে সে সমস্যা এখন সশস্ত্র সংঘর্ষে পরিণত হয়েছে। ইসরায়েলের বর্তমান নেতৃবৃন্দ, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুসহ কট্টরপন্থীরা দুটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভিত্তিতে এ সমস্যার সমাধানে বিশ্বাসী নন। তাঁদের মতে, সমগ্র ফিলিস্তিন ভূখণ্ড ইসরায়েল রাষ্ট্রের অংশে পরিণত করা হবে। এতে কোনো আরব যদি সেখানে থাকতে না চায়, তাহলে বৃহত্তর ইসরায়েল থেকে চলে যেতে হবে। তাঁদের মতে, সমগ্র ফিলিস্তিনই প্রাচীন ইহুদি রাষ্ট্রের (ইসরায়েল ও জুডা) অংশ।
এত দিন বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র কিংবা যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি এ কথাগুলো শুনেও না শোনার ভান করেছে। কিন্তু গত ৭ অক্টোবর অনন্যোপায় হয়ে গাজা উপত্যকার সংগ্রামী শাসকদল হামাসের সামরিক অংশ যখন ইসরায়েলের অভ্যন্তরে এক অভূতপূর্ব অভিযান শুরু করেছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলো প্রতিযোগিতামূলকভাবে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের সমর্থনে আবার মাঠে নেমেছে। তাদের দেখাদেখি শুধু ইউরোপের নয়, এশিয়ার কিছু দেশও মূল সমস্যার সমাধান না চেয়ে হামাসের আক্রমণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। অথচ অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য কিংবা ফ্রান্স ও জার্মানি থেকে বিতাড়িত কিংবা তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো থেকে আগত ইহুদিদের কেউ আশ্রয় দেয়নি। ফিলিস্তিনের আরবরাই প্রথমে বিতাড়িত ইহুদিদের আশ্রয় দিয়েছিল। তার পরই নবগঠিত জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে একটি স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কথা ছিল যে আরব ভূখণ্ডে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন নামক দুটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করা হবে।
সেদিন চারদিকে আরব রাষ্ট্রবেষ্টিত একটি ভূখণ্ডে ইসরায়েল নামক একটি রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্তকে ফিলিস্তিনিরা মেনে নিতে পারেনি। কারণ জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রে বসবাসকারী ইহুদিদের (সংখ্যাগরিষ্ঠ) চরিত্র সম্পর্কে ফিলিস্তিনিরা যথেষ্ট ওয়াকিফহাল ছিল। তাদের (ফিলিস্তিনি) সেদিনকার সন্দেহ কিংবা ইহুদিভীতি নেহাত অমূলক ছিল না। কারণ আশ্রয়প্রাপ্ত ইহুদিবাদী ইসরায়েলের সরকারই এখন ফিলিস্তিনি আরবদের নিজ ভূখণ্ড থেকে বের করে দেওয়ার এক গভীর নীলনকশা প্রণয়ন করছে।
ইহুদিবাদী নেতা ডেভিড বেন গুরিয়নের নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে একতরফাভাবে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়া হয়। তাকে কেন্দ্র করে সে বছরই ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জর্দান, মিসর, সিরিয়া ও ইরাক অত্যন্ত অসংঘটিত হলেও তারা সে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে আরবদের সংঘর্ষ তখন থেকেই চলতে থাকে। এর মধ্যে ১৯৬৭ সালে সংঘটিত ছয় দিনের একতরফা যুদ্ধে ইহুদিবাদী ইসরায়েল জাতিসংঘ নির্ধারিত ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড দখল করে নেয়। কিন্তু ১৯৭৩ সালে মিসর ইসরায়েলের কাছ থেকে তাদের হারানো সিনাইসহ বিভিন্ন অঞ্চল পুনর্দখল করে নেয়। ১৯৪৮ সালে সংঘটিত প্রথম যুদ্ধটি ছাড়াও ইহুদিবাদী ইসরায়েল আরবদের সঙ্গে ১৯৮২ ও ২০০৬ সালে লেবানন যুদ্ধ নামে দুটি এবং ২০১২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়ে গাজায় যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। তা ছাড়া ১৯৪৮ সালে জেরুজালেম এবং ১৯৪৯ সালে ফিলিস্তিন নামে আরো দুটি বড় সংঘর্ষ বেধেছিল। স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকেই ইহুদিবাদী ইসরায়েলিরা প্রতিবেশী আরবদের শান্তিতে থাকতে দেয়নি। শুরু থেকেই এক বিশাল চক্রান্তের রাজনীতি শুরু করেছিল তারা।
এরই মধ্যে জাতিসংঘ নির্ধারিত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের ৬০ শতাংশ তারা অবৈধ বসতি নির্মাণ কিংবা বিভিন্ন কৌশলে দখল করে নেয়। এতে পাঁচ লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি নিজেদের বসতভিটা হারিয়ে এখন বিভিন্ন প্রতিবেশী রাষ্ট্রের শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর মধ্যেও ১৯৯৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রসিদ্ধ ক্যাম্প ডেভিডে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের তত্ত¡াবধানে দুই বিবদমান পক্ষের মধ্যে এই দীর্ঘ চলমান বিরোধ নি?ত্তির জন্য আলোচনা হয়েছে এবং অসলো একর্ড নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। সেই চুক্তিকে ভিত্তি করেই আজকের ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
অনেক বিশ্লেষকের মতে, জাতিসংঘের ১৯৪৭ সালের ঘোষণা মোতাবেক ফিলিস্তিন কেন ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের মতো নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করল না?
তা ছাড়া প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের মধ্যস্থতায় ২০০০ সালে অনুষ্ঠিত ক্যাম্প ডেভিড শীর্ষ সম্মেলনে সব কিছুতে এগিয়ে গিয়েও শেষ পর্যন্ত ফিলিস্তিনি নেতা ও কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাত কেন চূড়ান্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেন না? তখন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন লেবার দলীয় নেতা ইহুদ বারাক। বারাক ফিলিস্তিনের সঙ্গে শান্তিচুক্তিতে যথেষ্ট আগ্রহী হলেও ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড নিয়ে বিরোধ ও ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের স্বদেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বিধি-নিষেধ কিংবা আপত্তিকে কেন্দ্র করে ইয়াসির আরাফাত যথারীতি আবার পশ্চিম তীরে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, সেই শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর কিংবা তার ভিত্তিতে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ঘোষণা হবে নেহাতই একটি বিশ্বাসঘাতকতার শামিল।
ইসরায়েলে বারাক-পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন লিকুদ পার্টির নেতা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ইসরায়েলের ‘কৌশলী শয়তান’ নামে পরিচিত এই নেতা ক্ষমতাসীন হয়ে তাঁর গোপন কর্মসূচি বাস্তবায়নে ব্রতী হয়েছিলেন। তিনি ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে শান্তি আলোচনার পথ সম্পূর্ণভাবে পরিহার করে ক্রমে ক্রমে সমগ্র ফিলিস্তিনকে গ্রাস করে এক বৃহৎ ও শক্তিশালী ইহুদিবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র থেকে ফিলিস্তিন নামক ভূখণ্ডে নামটি কিংবা পৃথক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে মুছে দেওয়ার কর্মসূচি হাতে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। এবং তাতে ঘোষিত কিংবা অঘোষিতভাবে সমর্থন জুগিয়ে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো নেতারা। এখনো যুক্তরাষ্ট্রের সার্বিক সহযোগিতায়ই টিকে আছে ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েল। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে অবরুদ্ধ হামাসের সশস্ত্র বাহিনী। বাংলাদেশ ৯ মাসব্যাপী সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। সে ক্ষেত্রে একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে আমি কিভাবে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাসংগ্রামকে অগ্রাহ্য করি।
১৩ অক্টোবর, ২০২৩
লেখক: বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক