লণ্ডনের চিঠি
সাগর রহমান ♦
গুগল ইমেইজে একটা কার্টুন পাওয়া যায়। বনের ভেতরে চেয়ার টেবিল পেতে একজন পরীক্ষক বসে আছেন। তার সামনে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে একদল নানান জাতের পশু-পাখি। বানর, পেঙ্গুইন, হাতি, গো-ফিস, সিলমাছ, কুকুর। পরীক্ষক বলছেন, “ফর এ ফেয়ার সিলেকশান, এভরিবডি হ্যাজ টু টেইক সেইম এক্জাম।” তা কি সেই ‘এক্জাম’ পরীক্ষক জানাচ্ছেন, পশু-পাখীদের ঠিক পেছনে যে বড় গাছটি দেখা যাচ্ছে সবাইকে একে একে সেই গাছে উঠতে হবে। এমন পরীক্ষা-পদ্ধতিকে কি আপনার কাছে ‘ফেয়ার’ মনে হচ্ছে? হচ্ছে না তো! আপনার মতের সাথে আমি পুরোপুরি একমত। এক সাইজের জুতোর মধ্যে সবার পা ঢুকিয়ে ‘সেরা গঠনের পা’ নির্বাচনের মধ্যে আর যাই থাকুক, ফেয়ারনেস নেই। বনের ছবিটাকে টেনে আনুন এবার মনুষ্য সমাজে। এবং চারপাশে তাকিয়ে বলুন, আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতি, জ্ঞানের মাপকাঠি মাপার পদ্ধতি, এবং শিখন-পদ্ধতিতে কি সেই কার্টুনটির মতোই তথাকথিত ‘সুবিচার’ করা হচ্ছে বলে ভাবছি না?
আমরা যারা গুগল-সার্চের আগে স্কুলে পড়েছি, তাদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে আমাদের নিত্য সঙ্গী ছিল টেবিলের উপর থাকা অভিধান। কোন ইংরেজি শব্দ বুঝতে পারছি না তো উল্টো শুরু করতে হতো সেই ডাবল-থানইটের চেয়েও ভারী বইটি। বেশ কয়েক পৃষ্ঠা খুঁজে তবে হয়তো পাওয়া যেতো সেই শব্দটির মানে। তাও ততটুকুই বোঝা যাওয়ার সুযোগ থাকতো যতটুকু লেখা থাকতো ঐ শব্দটিকে ঘিরে ঐ বইয়ে। আর কোন ‘টার্মস’ বুঝতে হলে, উফ, ব্যাপারটা ভাবতেও কেমন হাঁফ ধরে যাচ্ছে। আমরা যারা মফস্বলে ছিলাম, তাদের কথা না হয় বাদই দিলাম, ক‘জন শহুরে ছেলে-মেয়েই বা অবাধ বিচরণ করার সুযোগ ছিল নানাবিধ বইয়ের রাজ্যে যেখানে মনের কৌতুহল নিবৃত্তির সুযোগ পাওয়া যেতো। এবং যদিবা কোনো বই-পত্র পাওয়া যেতো, সেই বইয়ের লেখকের সীমাবদ্ধতায় আটকে যেতে হতো আমাদের জানা এবং বোঝার পরিধি। এবারে চিন্তা করুন এখনকার ছাত্র-ছাত্রীদের জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়াটি।
অভিধান এখনো বাজারে পাওয়া যায়, এবং বিক্রিও হয় বটে, পাওয়া যায় বাংলা-পিডিয়া এবং বিশ্ব-পিডিয়াও। কিন্তু অস্বীকার করার কোনো উপায় কি আছে যে একটা সামান্য গুগল সার্চ অন্য অনেক বইয়ের তুলনায় অনেক দ্রুত এবং অনেক ধরনের উত্তর হাজির করে দিতে পারে আমাদের সামনে! আপনার ঘরে যদি আমাজনের এলেক্সা ডিভাইসটি থাকে, কিংবা ব্যবহার করেন সিরি‘র মতো ভয়েস এসিটেন্স, তবে তো খোঁজাখুঁজির বালাইও থাকে না। একটু গলা তুললেই উত্তর এসে হাজির হয় ‘গায়েবি জায়গা’ হতে। আমার বলার কথাটি হচ্ছে, এবং যে কথাটি আপনারা সবাই জানেন, তা হচ্ছে, আমরা ঢুকে পড়েছি ডিজিটাল-সুপারহাইওয়েতে। এই ডিজিটাল যুগের সুযোগ-সুবিধা ব্যবহারের দিক থেকে বাংলাদেশের মানুষের অংশগ্রহণ এবং উৎসাহ আর্শ্চযজনকরকম! কিন্তু, আক্ষেপটি হচ্ছে, সবক্ষেত্রে ডিজিটাল হলেও আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে ডিজিটাল-যুগের সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার এবং এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা নিদারুণ রকম এনালগ।
শতাব্দীর ধরে শিক্ষার্থীদের শিখন-পদ্ধতি নিয়ে যত প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব আছে, সেগুলো শক্ত-কাঠামো খানিকটা নড়বড়ে হয়ে পড়েছে এই নব-প্রযুক্তির যুগে। বিহেভিয়ারিজম, কগনিটিভিজম, কন্সট্রাকটিভিজ এমন সব পথিকৃত থিউরিগুলো যুগ যুগ ধরে সারা পৃথিবীর শিক্ষার্থীদের শিখন-পদ্ধতির রূপরেখা তৈরিতে সাহায্য করেছে, এবং প্রতিনিয়ত করছে এতে কোন সন্দেহ নেই। এসব তত্ত্বের গূঢ় কথাটি না আলোচনা করেও এদের মধ্যে একটি সাদৃশ্য দেখাতে চাই আমি। এই সবগুলো তত্ত্বের মূল ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে উপদেশমূলক বা নির্দেশনামূলক শিক্ষা-পরিবেশের উপরে, যেখানে শিক্ষার্থীরা শিখে মূলত শিক্ষকের নিবিড় তত্ত্বাবধান, উৎসাহ, উদ্দীপনা ও প্রযত্নে। সমস্যা হলো, নতুন শতাব্দীতে এসে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর বেড়া ভাঙতে শুরু করেছে হুড়মুড় করে। জ্ঞান এখন সর্বত্র। ২০০৪ সালে এ বিষয়টিকে উপজীব্য করে কানাডার একজন গবেষক, জর্জ সাইমন্স, ‘কানেক্টিভিজম: এ লার্নি থিউরি ফর ডিজিটাল এইজ‘ নামে একটি অল্প কয়েক পাতার প্রবন্ধ লিখেন। তিনি বলছেন, জ্ঞান যেহেতু এখন সর্বত্র, তার মানে শিক্ষকের পরিচিতি এবং ভ‚মিকাটাও বদলাতে বাধ্য। এ যুগে শিক্ষক হতে পারেন অমানুষও (ভুল বোঝার আগেই পরিষ্কার করে দেই, মানুষের গুণগত অর্থে ‘অমানুষ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি, প্রাণহীনতা বোঝাতে মানে যন্ত্রকে বোঝাতে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে)। ফলে এ যুগের শিক্ষার্থীদেরকে কোন কিছু সম্পর্কে ‘জ্ঞান’দেবার চেয়েও জরুরী হচ্ছে সেই উদ্দিষ্ট ‘জ্ঞান’টি কোথায় আছে সেটা শেখানো, সেই উৎস থেকে তথ্য নিয়ে, সেইসব তথ্য যাচাই-বাছাই করার ক্ষমতা শেখানোটা জরুরী, সেই যাচাই-বাছাই করা তথ্য-উপাত্ত থেকে জ্ঞানকে ছেঁকে নিয়ে সেটাকে প্রয়োজন মতো কাজে লাগানোটা জরুরী। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে সেই বহুল-কথিত চীনা প্রবাদটির কথা: কাউকে একটি মাছ দিয়ে সাহায্য করার চেয়ে মাছ ধরাটা শিখিয়ে দেয়া অনেক মূল্যবান।
ডিজিটাল যুগে শিক্ষা-ব্যবস্থার মূল লক্ষ্যটিকে তাই একটু সরিয়ে ছড়িয়ে দিতে হবে। আমাদের বোঝার সময় এসেছে, শিক্ষা আসলে কোনো গন্তব্য নয়, শিক্ষা হচ্ছে ভ্রমণ। ১৯৮২ সালে আমেরিকান লেখক এবং দার্শনিক বাকমিস্টার ফুলার ‘ক্রিটিক্যাল পাথ’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। তাতে তিনি গ্রাফ এঁকে দেখিয়েছেন, ১৯০০ সাল পর্যন্ত গড়ে প্রতি একশো বছরে কোন বিষয়ে পৃথিবীর যে সামষ্টিক জ্ঞান, তা দ্বিগুণ পরিমাণ হয়ে যেতো। কিন্তু বর্তমানে জ্ঞানের দ্বিগুণ পরিমাণ হতে সময় লাগে মাত্র আঠারো বছর! সহজ কথায়, আপনি যদি আঠারো বছর আগে কোনো একটা বিষয়ে মাস্টার হয়ে থাকেন, তখন আপনি ঐ বিষয়ে যা জানতেন, গত আঠারো বছরে সেই বিষয়ের জ্ঞান বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আপনি যদি নিজেকে প্রতিনিয়ত আপডেট না করে থাকেন, তবে এই আঠারো বছর পরে ঐ বিষয়ে আপনি বড়জোর একজন নবীশ শিক্ষার্থী!
অর্থাৎ, সময়ের সাথে সাথে নব-আবিষ্কৃত যে জ্ঞান, আজকের শিক্ষার্থীকে সেই জ্ঞান আহরণের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত রাখাটাও কোনো কিছু শিখিয়ে দেবার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমাদের ঐ ধারণা থেকে বেরিয়ে আসার সময় এসেছে যে শিক্ষার্থীদের মাথাটি একটি পাত্র। ওদেরকে শিক্ষিত করে তোলা মানে ঐ পাত্রটিকে পূর্ণ করে দেবার ইরাদা করা নয়! এসময়কার শিক্ষার্থীকে শেখাতে হবে যে জ্ঞান আহরণ করার জন্য যুক্ত থাকতে হবে জ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দুগুলো সাথে, যে কেন্দ্রবিন্দু কোনো বিচ্ছিন্ন বিন্দু নয়, বরং প্রত্যেকের কাছে একটি একটি কেন্দ্র বিন্দু, সেগুলোর সাথে নিরবিচ্ছিন্ন সংযুক্ত থাকা, প্রয়োজনীয় জ্ঞানটি কোথায় পাওয়া যাবে, কীভাবে পাওয়া যাবে তার খোঁজটি জানা থাকটাও কোন কিছু জানার মতোই অত্যাবশ্যক।
বিষয়টি হচ্ছে, বর্তমানে যা জানি, তার চেয়েও আগামী দিনের জানাটির জন্য আমার জ্ঞানপাত্রটি প্রস্তুত করে রাখতে হবে। আমাদের সমগ্র দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় কুয়োর ব্যাঙ বানানোর যে ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে, তার সাথে ডিজিটাল যুগের দিকে আমাদের যে সামগ্রিক অগ্রগতি, তার বিস্তর ব্যবধানটিকে কমিয়ে আনার তেমন কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। আমাদের সামগ্রিক শিক্ষা-ব্যবস্থা এখনো আবর্তিত হয় শিক্ষকদেরকে কেন্দ্র করে। ব্যবস্থাটি ভুল। শিক্ষা-ব্যবস্থা তৈরি হবে শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক, সেখানে শিক্ষকের ভূমিকা প্রতিটি শিক্ষার্থীর ধরন-ধারণ অনুযায়ী তার পাঠদান পদ্ধতিকে পুনর্বিন্যাস করা।
এ লেখাটি শুরু হয়েছিল যে কার্টুনটির উদ্ধৃতি দিয়ে, প্রসঙ্গটি আবারো টেনে মনে করিয়ে দিতে চাই যে, রহিম এবং করিম দুইজনেই শিক্ষার্থী বটে, তবে দুজন দুটি সত্তা, তাদের সক্ষমতা, চিন্তা-চেতনা, বোধ, সামাজিক ও মানসিক ও শারিরীক বেড়ে ওঠা সবকিছু আলাদা। আমি শিক্ষক, দেশ গড়ার কারিগর, যদি একটি সফল এবং যুগোপযোগী জাতি গড়তে চাই, তবে রহিম এবং করিমকে আমার জ্ঞানে জ্ঞানী করে তোলার মানসিকতাটা ছাড়তে হবে।
লণ্ডন, ১৩ অক্টোবর, ২০২৩
লেখক: কথা সাহিত্যিক