লন্ডনের চিঠি
সাগর রহমান ♦
বাসে বসে আাছি। প্রচণ্ড ভীড় রাস্তা। হর্ণ এবং রিকশা যোগ করে দিলে ছবিটা ঢাকার রাজপথের মতো মনে হতে বাধ্য। বিশেষত বিকেলের এ সময়টাতে বাস এবং রাস্তা – দুটোই বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমাদের এই বাসটাতে যদিও যাত্রির ভীড় খুব একটা নেই। পেছনের দিকের সিটগুলো সব ভর্তি হয়ে গেছে। সামনের দিকে ‘প্রায়োরিটি সিট’গুলোর অর্ধেকটা এখনো ফাঁকা। কয়েকজন যাত্রী দাঁড়িয়ে আছেন ইতঃস্তত। আমার হাতে ধরা খবরের কাগজটিতে ভয়ংকর সব খবরে ভর্তি। গত কিছুদিন ধরেই খবরের কাগজ হাতে নেওয়া যাচ্ছে না। বহু বছর আগে, সেই যখন ইরাকে মার্কিন হামলা হয়েছিল, তখন একটা কবিতা লিখেছিলাম। দীর্ঘ, শ্লোগানমুখর অকবিতাই অবশ্য। কয়েক লাইন পর পর জিজ্ঞাসা: “বন্ধু, আমাকে বলো – এখন কোন্ শতক চলছে পৃথিবীর।” এমন অবলীলায় একটা দেশ আরেক দেশের উপর হামলা করতে পারে, ছুঁতো পেলেই আকাশ থেকে বোমা বর্ষণ করে নির্বিচারে হত্যা করতে শত শত সাধারণ মানুষদের, মানুষের বাস্তুভিটায় মুহূর্তে হয়ে উঠতে পারে ভগ্ন সমাধি – ব্যাপারটা আমার কাছে বরাবরের মতোই অবিশ্বাস্য মনে হয়। মনুষ্য সভ্যতার এত এত উন্নতির পরও এই জঘন্য বর্বরতা ঘটে যাচ্ছে এ দেশে ও দেশে, কিছুদিন পর পর, এই তথাকথিত আধুনিক শতকে এসেও – এই কথাটিই নানান উপমা আর উৎপ্রেক্ষায় বলার ব্যর্থ চেষ্টা ছিল কবিতাটিতে। অবন্তী (পৃথিবী) নামক প্রেমিকার কাছে আশ্রয় চাচ্ছে এমন যুদ্ধ-বিগ্রহে উৎকণ্ঠিত, ক্লান্ত, হতাশাগ্রস্ত প্রেমিক। অবন্তীর মুখে সে শুনতে চাইছে: “আমাকে বলো – যুদ্ধ মানুষের ব্যাধি, কিন্তু এই ব্যাধি দুরারোগ্য নয়”। খবরের কাগজের ভয়ংকর সব যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষের ছবি দেখতে দেখতে নিজের কবিতাটি মনে পড়ছিল। এবং ধীরে ধীরে মনে বাসা বাঁধছিল – যুদ্ধ মানুষের ব্যাধি অবশ্যই, কিন্তু হয়তো এ ব্যাধি ‘দুরারোগ্য‘ই।
যুদ্ধের খবরের চেয়েও আরো একটা ব্যাপার গত কিছুদিন ধরে আমার মনোঃপীড়ার কারণ হয়ে আছে। জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, মানবাধিকার এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চায় এ মূহূর্তে চালকের আসনে বসে আছে পশ্চিমা বিশ্ব। তাদের গণতন্ত্র আমাদেরকে মুগ্ধ করে, তাদের রাজনীতি, শিক্ষা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অভ্যাস আমাদের কাছে ‘অন্ধ’ অনুকরণযোগ্য মনে হয়। কিন্তু সব কিছু ছাড়িয়ে যেই বিষয়টা চলে আসে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ও যুদ্ধ-বিগ্রহ প্রশ্নে, যেই কথা উঠে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মৃত্যুক্ষয়ী সমস্যায়, তখন কী ভীষণ নির্লজ্জের মতো পশ্চিমা বিশ্ব এক যোগে ইসরায়েলের পক্ষে দাঁড়িয়ে যায়! সব রকমের যুক্তি-বুদ্ধি-মানবিকতার প্রশ্ন শিকেয় তুলে ইসরায়েলকে এক চেটিয়া সমর্থন জানানোর যে বিদঘুটে রাজনীতি – তা যে কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া বেদনাদায়ক। এ মুহূর্তে ঠিক এ কাজটিই করছে আমেরিকা এবং যুক্তরাজ্য। ইসরায়েলের আত্মরক্ষার কথায় কবন্ধের মতো সমর্থন জানিয়ে হাজার হাজার ফিলিস্তিনবাসীর করুণ মৃত্যুর বিষয়ে এমন নিশ্চুপতা পশ্চিমা বিশ্বের দ্বিচারিতার নির্লজ্জ উদাহরণ হয়ে থাকছে বছরের পর বছর। এর সাথে এক যোগে তাল মিলিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমা মিডিয়াগুলোও। আমার হাতে ধরা কাগজটির কথাই যদি ধরি। প্রথম পৃষ্ঠার অর্ধেকটা জুড়ে যুদ্ধ বিধ্বস্ত ফিলিস্তিনের গাজা শহরের একটি ছবি। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, বোমায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া শহরের একাংশ। রঙিন ছবি, অথচ এক বিন্দু রঙ নেই ঐ ছবিতে। কেবলি বিবর্ণ ধ্বংসের হা করা হাহাকার। আকাশটা পর্যন্ত সাদা-কালোর ধোঁয়ায় ধূসরিত। ছবিতে একটা মানুষ। স্তুপীকৃত ইট-সুড়কির ভেতরে কিছু একটা খুঁজছে। কী খুঁজছে কে জানে! ছবির ক্যাপশানে লেখা: ইজরায়েলের বোমা হামলায় ধ্বংস হওয়া গাজার একাংশ। খবরটা দেখে মনে হলো- যাক, এতদিনে তবে এদের টনক নড়েছে। গাজাবাসীর দৃষ্টিকোণ ধরার চেষ্টা করা হয়েছে খবরটাতে। বিস্তারিত খবরের জন্য যেতে বলা হলো ভেতরের সাত নম্বর পৃষ্ঠায়। গেলাম। গিয়ে দেখি এ পাতা ও পাতা মিলিয়ে অনেকগুলো যুদ্ধের খবর। কিন্তু কী সেই খবরের নমুনা? পৃষ্ঠার উপরের অর্ধেকটা জুড়ে বিশাল ফিচার। ইউক্রেনে বসবাস করা একটি ইজরায়েলি পরিবার রাশিয়ার পুতিনের বোমার হাত থেকে রক্ষা পেতে ফিরে এসেছিল ইজরায়েলে। কিন্তু ফেরার কয়েকদিনের মাথায় হামাসের হামলায় তাদের বাড়ি-ঘর ধ্বংস হয়ে গেছে। অবশ্য ঐ পরিবারের কারো কোনো ক্ষতি হয়নি। তাদের একটাই আফসোস: পুতিনের হাত থেকে বাঁচতে নিজ দেশে ফিরে এসেও তারা সেই যুদ্ধের কবলেই পড়েছে। পরিবারটির একটি ছবি ছাপা হয়েছে। স্বামী, স্ত্রী, তিন সন্তান। সবার হাসিমুখ। আরেকটি ফিচার: অবিলম্বে হামাসের হাতে বন্দী থাকা সব বন্দীদের ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী। আরেকটি খবর: গাজায় হাসপাতালে যে বোমা বর্ষণ হয়েছে, তা ইজরায়েল নয়, বরং হামাসই ঘটিয়েছে যাতে বিশ্বের সহানুভূতি আদায় করতে পারে, ইজরায়েল এমন অমানবিক আঘাত করতেই পারে না বলে দ্ব্যর্থহীন মন্তব্য করেছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। আমি একের পর এক খবরগুলো দেখতে দেখতে আশ্চর্য হয়ে ভাবলাম, প্রথম পৃষ্ঠার ছবিটি কি তবে কেবল যুদ্ধের খবর হিসেবে দেখতে ‘সুন্দর’ বলেই দেওয়া! একটি খবরের বিষয়বস্তুতেও গাজায় যে এ শতাব্দীর সবচেয়ে মানবিক সংকটটি চলছে, চলছে যুগের পর যুগ – তার কোনো খবরই নেই।
আমি নিজ দেশের রাজনীতির ব্যাপার-স্যাপারই বুঝি না। বিশ্ব-রাজনীতির কথাতো বলাই বাহুল্য। এ ব্যাপারে চিরকালীন অনাগ্রহের কারণে রাজনীতির জ্ঞান আমার শূণ্যের কোঠাতেই রয়ে গেলো। ইজরায়েল ফিলিস্তিনের যে দ্বন্দ্ব, বছরের পর বছর ধরে চলে আসা যে মরণক্ষয়ী অমানবিক লড়াইটা লেগে আছে ঐ অঞ্চলে – সে খবর শুনতে শুনতেই তো বড় হয়েছি আমরা। ভাবতে কী অবাক লাগে, একটি দেশের প্রজন্মের পর প্রজন্ম নিজ দেশের যুদ্ধের মধ্যেই জন্ম নেয়, সেই অন্যায় অসম যুদ্ধের ভেতরেই বেড়ে ওঠে, তার সুদূর পরাহত মীমাংসার স্বপ্ন দেখতে দেখতেই মৃত্যুবরণ করে। আর দশকের পর দশক পশ্চিমা বিশ্ব মোড়লরা – যাদের দায়ে উদ্ভুত এই রক্তক্ষয়ী অদ্ভুত পরিস্থিতিটি, নিজেদের দায় এড়িয়ে এ যুদ্ধটিকে জিইয়ে রাখছে, সমর্থন জানিয়ে আসছে ভুল জায়গায় স্রেফ নিজেদের স্থূল স্বার্থে, বিচার-বুদ্ধির কথা ভুলে! আল জাজিরার একটি রিপোর্টে দেখলাম এক প্রতিবেদক দেখিয়েছেন কীভাবে আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বের একটা বড় অংশের রাজনীতির অন্যতম অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা করে ইজরায়েলের টাকা।
হাতে ধরা পত্রিকাটা ভাঁজ করে পাশে সরিয়ে রাখতে রাখতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আমি হয়তো ভুলই ভাবছি। পশ্চিমা সৎ (?) রাজনীতিবিদদের চরিত্রে কালিমা লেপনের অহেতুক চেষ্টা করছি। আমেরিকার রাজনীতিবিদ সাইমন ক্যামেরন বলেছিলেন: An honest politician is one who when he is bought will stay bought. বলাবাহুল্য তবে, বেচা-বিক্রির রাজনীতিতে ইনারা আসলে সৎ-ই আছেন। সমস্যা আমার মতো আম-জনতার, যারা ন্যায়বিচার খুঁজছে আঠা লাগিয়ে রাখা দাঁড়িপাল্লার কাছে।
হঠাৎ বাসের সামনের দিকে থেকে এক ভদ্রমহিলার কণ্ঠস্বর শোনা গেল। পর পর একটা প্রশ্ন করেই যাচ্ছে: হ্যালো, হাউ আর ইউ? আমাদের দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের ইংরেজি উচ্চারণ। তাকিয়ে দেখি রঙিন সালোয়ার কামিজ পরা একজন মহিলা। বোধহয় ভারতীয় হবেন। উচ্চারণ এবং সাজ-গোজ তা-ই বলে। মধ্যবয়স্ক। খুব সুন্দর করে সেজেছেন। মাথার সিঁথিতে সিঁদুর জ্বলছে। বসেছেন সামনের দিকের ড্রাইভারের সিটের প্রায় পাশেই। ওখানটাতে যাত্রী ঢোকার দরজা। যে যাত্রীই ঢোকেন, ভদ্রমহিলা হাসিমুখে জিজ্ঞেস করেন, হ্যালো হাউ আর ইউ? বেশ কৌতূহলের সাথে বিষয়টা দেখতে লাগলাম। এবং অতি অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, একটি মানুষও তার এই সহজ প্রশ্নটির উত্তর দিতে আগ্রহী হলো না। বেশিরভাগ মানুষের কানেই ইয়ারফোন গোঁজা। কেউ গান শুনছে, কেউ কথা বলছে ফোনে। কিন্তু যাদের কানে ইয়ারফোন নেই, তারাও দিব্যি ভদ্রমহিলার প্রশ্নটি এড়িয়ে বাসে ঢুকে পড়ছে। কারণ, আমার মতোই সবাই খুব সহজে বুঝতে পারছে, ভদ্রমহিলা আমাদের বিচারে ‘ছিটগ্রস্ত’। ছিটগ্রস্ত না হলে কি আর কেউ নিজ চরকায় তেল না দিয়ে, নিজ ফোন স্ক্রিনে ডুবে না থেকে অচেনা অজানা মানুষকে ‘কেমন আছে’ প্রশ্নটি করে যায়! এই দেশে এই একটা ব্যাপার, ছিটগ্রস্ত বুঝে ফেললে সবাই নিমেষে তাকে এমনভাবে এড়িয়ে চলতে শুরু করে, যেন তার অস্তিত্বই নেই। এখানেও তাই হচ্ছে। বেশিরভাগই তার দিকে স্রেফ ফিরেও তাকাচ্ছে না।
ভদ্রমহিলা কিন্তু নাছোড়বান্দা। কেউ উত্তর দিচ্ছে না, তবু হাসিমুখে প্রশ্নটি করেই যাচ্ছেন। আমি তাকিয়েই থাকলাম ওদিকে, দেখি কে প্রথম ঐ ভদ্রমহিলার প্রশ্নটির উত্তর দেয়। অবশেষে যে এ প্রশ্নটির উত্তর দিলো, সে অতি অল্পবয়সী একটি বাচ্চা। বাসে উঠেছে মায়ের হাত ধরে। মহিলার প্রশ্নটি শুনেই রিনরিনে গলায় উত্তর: আই এম ফাইন, থ্যাংক কিউ। মুখে হাসি। মেয়ের মা বাসের টিকেট রিডারে কার্ড ছোঁয়াতে ব্যস্ত ছিলেন। মেয়েকে ছিটগ্রস্ত অপরিচিত মানুষের সাথে কথা বলতে দেখে প্রায় হ্যাঁচকা টান দিয়ে ভেতরের দিকে ঢুকে গেলেন। স্পষ্ট দেখলাম, ছোট্ট মেয়েটির মুখে নিমেষে কেমন দ্বিধা এবং বেদনায় ভরে গেলো। আমার স্টপেজ এসে পড়েছে। নেমে গেলাম। নামতে নামতেও ভদ্রমহিলার কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছিলাম, মিষ্টি হেসে একের পর এক মানুষকে জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছেন, হ্যালো, হাউ আর ইউ? সমস্যা হলো, প্রশ্নটির আমার ভেতরেও ঢুকে পড়েছে। কারো সাথে দেখা হলেই চোখের গভীরে তাকিয়ে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে, ইচ্ছে করছে আপনাকে জিজ্ঞেস করি, আচ্ছা, কেমন আছেন, বলুন তো?
লণ্ডন, ২৬ অক্টোবর, ২০২৩
লেখক: কথা সাহিত্যিক