নজরুল ইসলাম বাসন ♦
আশির দশকের মাঝামাঝি আমি যখন লণ্ডনের সাপ্তাহিক সুরমা’ পত্রিকায় যোগ দেই তখন ইস্ট লণ্ডনের বাংলাদেশী কমিউনিটি ছিল আলোকোজ্জ্বল একটি কমিউনিটি। শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতিতে ছিল নিবেদিতপ্রাণ মানুষের সক্রিয় অবস্থান। কমিউনিটি সংগঠনগুলি ছিল প্রাণবন্ত। এমনকি সিলেটের প্রতিটি উপজেলাভিত্তিক সংগঠনগুলো সে সময় এডুকেশন ট্রাস্ট গড়ে তোলে। এসব এডুকেশন ট্রাস্টে কোটি কোটি টাকা ফিক্সড ডিপোজিটে জমা আছে। শুধু দেশের শিক্ষা নয়, ইস্ট লণ্ডনে বয়স্ক শিক্ষা, ইংরেজী ও বাংলা শিক্ষা দেয়ার জন্য কমিউনিটি স্কুল গড়ে তুলেন নিবেদিতপ্রাণ কিছু মানুষ। এদের মধ্যে অগ্রসারির ব্যক্তি ছিলেন সদ্যপ্রয়াত মুহম্মদ নুরুল হক ও স্ত্রী আনোয়ারা হক। তাদের প্রচেষ্টায় গড়ে উঠে ইস্ট এণ্ড কমিউনিটি স্কুল।
স্বনামধন্য এই কমিউনিটি স্কুলে বাংলা, ইংরেজী ও অংক শিখে অনেকে মূলধারার স্কুলে গিয়ে ভাল রেজাল্ট করেছেন। ইস্ট কমিউনিটি স্কুলে লেখাপড়া করে পরে অনেকে মূলস্রোতের স্কুলে গিয়ে অনেকে ভাল রেজাল্ট করায় কমিউনিটিতে ধীরে ধীরে শিক্ষার হার বাড়তে থাকে। কমিউনিটি এডুকেশন ডেভেলপমেন্টে জনাব হক এবং তাঁর স্ত্রী মিসেস হক যে ভূমিকা রেখেছেন তা আজকের দুনিয়ায় বিরল।
বর্ণবাদী জাতীয় এবং লকেল গভর্ণমেন্ট ছিল কমিউনিটি শিক্ষার ঘোর বিরোধী। তাছাড়া কমিউনিটি-বিরোধী একটি চক্র সব সময় ছিল আজও আছে। মুহম্মদ নুরুল হক এই চক্রের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য কাউন্সিল নির্বাচনে লেবার পার্টি থেকে মনোনয়ন চাইলেন। কিন্তু তাকে মনোনয়ন দিল না লেবার পার্টি। সাহস করে তিনি স্বতন্ত্র দাঁড়ালেন। কমিউনিটি তাকে বিজয়ী করে কাউন্সিলে পাঠাল। বাঙালীর বোধোদয় হল যে লেবার পার্টি ও বর্ণবাদমুক্ত নয়। মুহম্মদ নুরুল হক শেখালেন কমিউনিটির উপর ভরসা করতে। কৌশলি লেবার পার্টি বাঙালীকে হাত করার জন্য কিছু কাউন্সিলার পদে মনোনয়ন দিতে শুরু করল। দেখাদেখি চরম বর্ণবাদী লিবারেল পার্টিও বাঙালীদের মনোনয়ন দিতে শুরু করল।
১৯৯৪ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে লেবার, লিবারেল, রেসপেক্ট, টাওয়ার হ্যামলেটস ফার্স্ট যে রাজনীতি করেছে তা মূলস্রোতের রাজনীতির বিপরীতে স্থানীয় রাজনীতির এক নোংরা খেলায় পরিণত হয়েছিল। ২০১০ থেকে ২০১৫ ছিল মেয়র লুৎফুর রহমানের প্রথম পর্ব। সাত বছরের পুঞ্জীভূত ক্ষোভে আর অসন্তোষের বহির্প্রকাশ ঘটিয়ে আদালতের রায়কে পাল্টে দিয়ে জনতা রায় দেয় লুৎফুর রহমানের পক্ষে। আর ২০২২ সালে মেয়র লুৎফুর রহমানের এই বিপুল বিজয়ের মধ্যদিয়ে টাওয়ার হ্যামলেটসের রাজনীতি আরেক রূপ নেয়। বিশেষ এক নির্বাচনী আদালতের রায়ে নির্বাচিত মেয়র পদ থেকে অপসারিত লুৎফুর রহমানকে মেয়র পদে বসায় তার কমিউনিটি। এ যেন মুহম্মদ নুরুল হকের পথে হাঁটা। নুরুল হক যদি লেবার পার্টিকে চ্যালেঞ্জ না করতেন তাহলে লেবার পার্টি হয়তো তার বর্ণবাদী অবস্থানেই থেকে যেতো।
টাওয়ার হ্যামলেটসে দুটি নির্বাচনী এলাকার এখন দুজন এমপিই বাঙালী। এরাও বাঙালী ভোটের সহযোগিতায় পাশ করেন। অনেক কাউন্সিলার ও এমপি এ কথা স্বীকার করতে চান না যে বাঙালী ভোট ছাড়া তাদের পায়ের তলায় মাটি সরে যেতে সময় লাগবে না। বাঙালী ভোটের শক্তিকে প্রথম কাজে লাগিয়েছিলেন মুহম্মদ নুরুল হক। আগেই বলেছি, তিনি ছিলেন শিক্ষাঙ্গনের কারিগর। টাওয়ার হ্যামলেটসের কমিউনিটি এডুকেশনের উন্নয়নে তিনি যে ভূমিকা রেখে গেছেন তা আজকের মিডিয়ার দিকপালরা জানার চেষ্টাও করবেন কীনা তা জানি না। কারণ, সময় এখন তেলা মাথায় তেল দেয়ার।
পত্রিকা সম্পাদকের অনুরোধে হক ভাইকে নিয়ে সংক্ষিপ্ত এই লেখাটি সিলেটে বসে মোবাইলে লিখছি আর মনে পড়ছে- হক ভাইকে কোনদিন আগে সালাম দিতে পারিনি। তিনি সাপ্তাহিক সুরমায় এক সময় শিক্ষাবিষয়ক লেখা দিতেন। নিয়মিত পত্রিকা কিনতেন। নুরুল হক ভাইয়ের রূহের মাগফেরাত কামনা করি ও তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি জানাই সমবেদনা।
সিলেট, ১৫ই ফেব্রুয়ারী ২০২৪
লেখক: সাপ্তাহিক সুরমার সাবেক সম্পাদক এবং লণ্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। সাবেক মিডিয়া এণ্ড পাবলিক রিলেশন্স অফিসার, টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল, লণ্ডন