কে এম আবুতাহের চৌধুরী ♦
ব্রিটেনে বাংলাদেশী কমিউনিটির নেতা, বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন ইউকের সাবেক প্রেসিডেন্ট জনাব শফিকুর রহমান চৌধুরী দীর্ঘদিন প্রতীক্ষার পর আবার এমপি হয়েছেন। বাংলাদেশ সরকারের প্রবাস বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন। এটা তাঁর ছবরের ফসল। প্রবাসের সুখ-শান্তি ত্যাগ করে বাংলাদেশে তিনি জনকল্যাণের জন্য রাজনীতি করছেন। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ও অনেক সংকট বুদ্ধিমত্তার সাথে মোকাবিলা করে তিনি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব লাভ করেছেন। শফিকুর রহমান চৌধুরীকে আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি। কারণ তিনি জীবনের অধিকাংশ সময় প্রবাসে কাটিয়েছেন। এখনও বিলেতে তাঁর পরিবার পরিজন সবাই রয়েছেন। তাঁর পিতা হাজী আব্দুল মতলিব চৌধুরী ও ভাইয়েরা ব্রিটেনের কমিউনিটির উন্নয়নে ও মুক্তিযুদ্ধে অনেক অবদান রেখেছেন। আলহাজ্ব শফিকুর রহমান চৌধুরী বিলেতে বাংলাদেশী কমিউনিটির সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, সমস্যা ও সফলতা সব কিছু সম্পর্কে তিনি অবহিত। আমরা এক সাথে সিলেট বিভাগ আন্দোলন, প্রবাসীদের ভোটাধিকার আন্দোলন, ঢাকা এয়ারপোর্টে সৈয়দ সুরত মিয়া হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য আন্দোলন, বাংলা টাউন রক্ষার আন্দোলন ও যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশী কমিউনিটির সমস্যা নিয়ে আন্দোলন ও মিটিং মিছিল করেছি। আমরা এমপি, মেয়র বা মন্ত্রীর হওয়ার জন্য কোন আন্দোলন করিনি। আমি এখনও অধিকার আদায়ের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি।
অতীতে সিলেট অঞ্চল থেকে অনেকেই মন্ত্রী হয়েছিলেন। অনেক মন্ত্রী উন্নয়নমূলক কাজ আজো মানুষের মুখে মুখে। মানুষ তাঁর কর্ম দিয়েই বেঁচে থাকে যুগের পর যুগ। সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান, যোগাযোগ মন্ত্রী মাহবুব আলী খান, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, অর্থমন্ত্রী এএসএম কিবরিয়া ও পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নানকে সবাই শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছে। অনেক মন্ত্রী সুযোগ পেয়েও কিছুই করেননি। এবারতো সিলেট বিভাগে মন্ত্রীর সংখ্যা হাতে গোনা। মাত্র দু’জন। এটা সিলেট অঞ্চলের মানুষের প্রতি অবিচার বলে মনে করি। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশী বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করছেন। কিন্তু প্রবাসী বাংলাদেশীরা প্রতিনিয়ত নির্যাতন ও হয়রানীর শিকার। কোন সরকারই প্রবাসীদের সঠিক মূল্যায়ন করেনি। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের আজ পর্যন্ত স্বীকৃতি দেয়নি।
প্রবাসীদের কল্যাণে কিছু কাজ করার জন্য আমাদের আন্দোলনের সাথী শফিকুর রহমান চৌধুরী ও বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আমি নিম্নলিখিত দাবীসমূহ জানাচ্ছি-
১) ওসমানী বিমানবন্দর এখনও পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক হয়নি। বিমান ছাড়া অন্য কোন এয়ারলাইন্সকে নামতে না দিয়ে বিমান একচেটিয়া ব্যবসা করছে। যুক্তরাজ্য থেকে ১১০০/ ১২০০শ’ পাউণ্ড ভাড়া দিয়ে দেশে যেতে প্রবাসীরা হিমশিম খাচ্ছেন। পুরো পরিবার নিয়ে কেউ বাংলাদেশে যেতে পারছে না। তাই সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরে বিদেশী সকল এয়ারলাইন্সকে নামার সুযোগ করে দিতে হবে।
২) প্রবাসীদের জায়গা সম্পত্তি বেহাত হচ্ছে। সন্ত্রাসী ও লোভী আত্মীয়স্বজনরা বাসা-বাড়ী জোরপূর্বক দখল করে নিয়ে যাচ্ছে। বিদেশ থেকে গিয়ে সম্পত্তি উদ্ধার করা বড়ই কষ্টের ব্যাপার। তাই প্রবাসী অভিযোগ সেলকে সক্রিয় করে তোলা, পুলিশের সাহায্য নিশ্চিত করা ও আইনী সহায়তা প্রবাসীদের দেওয়ার ব্যবস্থা এবং প্রবাসীদের সহায় সম্পত্তি উদ্ধারে স্বতন্ত্র বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন করতে হবে।
৩) ব্রিটেন থেকে বাংলাদেশী পাসপোর্ট তৈরী বা নবায়নের জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্টের দরকার হয়। এ রিপোর্ট প্রদান করতে মোটা অংকের ঘুষ দাবী করার অভিযোগ রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে। পুলিশ রিপোর্ট দেওয়ার পরও পাসপোর্ট প্রদানে অহেতুক বিলম্ব করা হয়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ হাই কমিশনে বার বার তাগাদা দিয়ে কোন ফল পাওয়া যায় না। বাংলাদেশী পাসপোর্ট রিনিউ করতে পুলিশ ভেরিফিকেশন বাতিল করতে হবে।
৪) বাংলাদেশ হাই কমিশনগুলোতে সেবার মান অনেক নীচে। প্রবাসীরা সেবা নিতে গিয়ে?অনেক হয়রানীর সম্মুখীন হন। ব্রিটিশ বাংলাদেশীদের পাসপোর্টে জন্মস্থান সিলেট বা বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার নাম উল্লেখ থাকার পরও পাওয়ার অব এটর্নি প্রদানে ব্রিটিশ পাসপোর্টকে আইডি হিসাবে গ্রহণ করা হয় না। যার ফলে প্রবাসীদের জায়গা বিক্রি বা হস্তান্তর করার জন্য পাওয়ার অব এটর্নি দেওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশী পাসপোর্ট পেতে এক বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এ ব্যাপারে হাই কমিশনে গেলে বলা হয়, পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্ট পাওয়া যায়নি অথবা হাই কমিশন কিছুই জানে না। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৫) দীর্ঘ সংগ্রাম ও আন্দোলনের পর ব্রিটিশ বাংলাদেশীদের হাইকমিশনের মাধ্যমে এনআইডি কার্ড প্রদানের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে প্রক্রিয়াটি জটিল বলে মনে হচ্ছে। এটাকে সহজ করতে হবে। বাংলাদেশে গিয়ে এনআইডি কার্ডের জন্য দরখাস্ত করার এক বছর হওয়ার পরও অনেকেই জাতীয় পরিচয়পত্র পাচ্ছেন না। এ ব্যাপারে তদন্ত করতে হবে।
৬) প্রবাসীদের লাশ যাতে বিনা ভাড়ায় বাংলাদেশে বিমান বহন করতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।
৭) প্রবাসীরা বাংলাদেশে গিয়ে কোন মিথ্যা মামলা বা নির্যাতনের শিকার হলে দোষীদের দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রবাসীদের আইনগত সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
৮) বিমানবন্দরগুলোতে কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন বিভাগে দুর্নীতি ও প্রবাসীদের ওপর হয়রানী বন্ধ করতে হবে। ৯) প্রবাসীদের বিনিয়োগের পূর্ণ নিরাপত্তা প্রদান ও চাঁদাবাজদের মাস্তানী বন্ধ করতে হবে।
১০) বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে প্রবাসীদের জন্য এমপি পদে সংরক্ষিত আসন রাখতে হবে।
১১) প্রতিটি নির্বাচনে হাই কমিশনের মাধ্যমে পোস্টাল ভোটের ব্যবস্থা করতে হবে।
১২) যুক্তরাজ্য প্রবাসী সৈয়দ সুরত মিয়া হত্যা মামলা পুনরুজ্জীবিত করে হত্যাকারীদের শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
প্রবাসী বাংলাদেশীরা জাতীর সম্পদ। তাদেরকে যথাযথ মূল্যায়ন করলে বাংলাদেশের আরো অগ্রগতি হবে। এ ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রবাস মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি। বাংলাদেশ সরকারকে মনে রাখতে হবে যে, প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়ে প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখছেন। প্রবাসী বাংলাদেশীরা ৪/৫ সপ্তাহের জন্য দেশে যান। তারা শান্তি, নিরাপত্তা ও মর্যাদার সাথে সেই সময়টুকু কাটাতে চান। প্রবাসীদের যতই সম্মান দেওয়া হবে ততই দেশ লাভবান হবে। এ ব্যাপারে প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরীকে সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার অনুরোধ করছি।
লণ্ডন, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
লেখক: সাংবাদিক ও কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব