সাগর রহমান ♦
আমার ক্লাসে সম্প্রতি পাকিস্তান থেকে আসা একটি ছেলে এসে ভর্তি হয়েছে। এদেশে যেহেতু বয়স অনুযায়ী ক্লাস নির্ধারিত হয়, বেচারা পাকিস্তানের হিসেব অনুযায়ী সবেমাত্র ক্লাস দশম শ্রেণীতে পড়ার কথা, এখানে এসে সরাসরি তাকে জিসিএসসির পরীক্ষার্থীদের সাথে যোগ দিতে হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে যা হয়, যে কোনো ছাত্র-ছাত্রীকেই প্রথমদিকে ভাষার সমস্যায় পড়তে হয়। এ ধরনের শিক্ষার্থীদেরকে এদেশে ইএএল (ইংলিশ এজ এন এডিশানাল লেংগুয়েজ) হিসেবে ধরা হয়। অতীতে ইএএল শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিটি স্কুলে টিচিং এসিস্ট্যান্ট-এর সাহায্য দেওয়া হতো। কিন্তু দুনিয়ার আর সবকিছুর মতোই এখানে অর্থনৈতিক সংকটের ছোঁয়া লেগেছে। খুব তীব্র সমস্যায় না পড়লে সাধারণত কোন ইএএল শিক্ষার্থীকে এখন আর কোনো টিচিং এসিস্ট্যান্ট দেওয়া হয় না। এসব ক্ষেত্রে শিক্ষকদেরকেই সারাবছর ধরে নানান ধরনের ট্রেনিং দিয়ে, নানান কলা-কৌশল শিখিয়ে নেওয়ার পাঁয়তারা চলে যাতে এ বিষয়ে কোনো খরচ করতে না হয়!
তো, আলি, ছেলেটির নাম, পাকিস্তানে ইংরেজি মাধ্যমে পড়া-শোনা করেছে বলে মোটামুটি কথা-বার্তা চালিয়ে যেতে পারলেও স্বভাবতই এখনও ক্লাসে একঘরে। ওর সহপাঠিদের মধ্যে আরো দুয়েকজন যাদের মাতৃভাষা উর্দু কিংবা হিন্দি, তাদের সাথেই ওর সবসময়কার সেঁটে থাকা। এদিকে বেশিরভাগ শিক্ষকই যেহেতু ব্রিটিশ, আলি বেচারাদের ব্রিটিশ উচ্চারণের ভয়ে খুব একটা কাছ ঘেঁষে না, খুব দরকার না হলে শিক্ষকদের চোখ এড়িয়ে চলে, এবং সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকে কখন না আবার তাকে কোনো শিক্ষক পড়া ধরে বসে! খুব সম্ভবত আমার এশিয়ান চেহারা দেখে সেই প্রথম থেকেই আলি বেশ উৎসাহিত হয়ে আমার সাথে কথা-বার্তা বলার চেষ্টা চালাতে লাগলো। প্রথমেই জেনে নিলো আমি কোন দেশের। বাংলাদেশ বলাতে সে খানিকটা অবাক হয়ে বলল, বাংলাদেশ? আমি ভেবেছিলাম আপনি পাকিস্তানি। এমনটা ভাবার কারণ হিসেবে সে বললো আমার চুলের ধরন পাকিস্তানিদের মতো! আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম, এবং পাকিস্তানিদের চুলের ধরন ভাবার চেষ্টা করেও তেমন কিছু মনে করতে পারলাম না। তারপর সে চেষ্টা করলো দুয়েকটা হিন্দি (কিংবা উর্দুও হতে পারে, কোনো এক বিচিত্র কারণে পাকিস্তানি এবং ভারতীয় সবাই ধরে নিয়েছে বাংলাদেশের সবাই হিন্দি জানে) কথা বলে আমার সাথে ঘনিষ্ঠ হবার। আমি যেহেতু উর্দূ, হিন্দি – কোনোটাই জানি না, তারচেয়ে বড় কথা, ক্লাসে অন্য ভাষা বলার প্রশ্নই আসে না, সুতরাং, তাকে আমার অন্য ভাষা ব্যবহারের অপারগতা ও অনিচ্ছার কথা জানিয়ে বললাম, আমার ইংরেজিও অনেকটা তোমার মতো। সুতরাং, ভুল-শুদ্ধ – যাই হোক না কেন, তুমি যা যা বলতে চাও, বলতে পারো। আমি যেহেতু কম্পিউটার সায়েন্স পড়াই, ভুল ইংরেজির জন্য কোনো নাম্বার কাটবো না। বলে হাসলাম। আলিও হাসল।
সেই থেকে আমি ক্লাসে আসলেই আলি স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠে। অন্যান্য ক্লাসে যেখানে সে কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হবার ভয়ে নিজেকে অনেকটা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে, আমার ক্লাসে সে বরং খানিকটা প্রগলভ হয়ে ওঠে, খুব সম্ভবত অন্য পিরিয়ডগুলোতে নিজের অবদমিত স্বাভাবিক বালকসুলভতা এতক্ষণে বেরিয়ে আসার সুযোগ পায়। আমি তাকে আস্বস্ত করেছি যে, ওর সমস্যাগুলো, আমি নিজেও যখন এদেশে স্টুডেন্ট হিসেবে এসেছি- প্রতি পদে পদে সম্মুখীন হয়েছি। আমি তাকে বলেছি যে, ব্রিটিশদের মতো ওর শব্দ উচ্চারণ হতে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। প্রতিটি ভাষার মতোই ইংরেজি ভাষারও অনেকগুলো প্রচলিত উচ্চারণ (আঞ্চলিক) উচ্চারণ আছে।
সম্পূর্ণ ভিন্ন গোলার্ধের হওয়ার কারণে এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ভাষা গোষ্ঠির ভিন্ন একটা ভাষায় আমাদের আজন্ম অভ্যস্ততা ও উচ্চারণ বলে ব্রিটিশ উচ্চারণ আমাদের মুখ থেকে বের করার কোনো কষ্ট-প্রচেষ্টার বিন্দুমাত্র দরকার নেই, বরং এই যে আমরা নিজের মাতৃভাষার বাইরেও অন্য আরেকটি ভাষায় কথা বলতে পারি, তাতেই আমাদের গর্বিত হওয়া উচিত। এখানকার খুব সংখ্যক ব্রিটিশই ইংরেজির বাইরে অন্য কোনো ভাষায় যোগাযোগ করতে পারে। সুতরাং, শুরু থেকেই আলি আমার অনেকটা ন্যাওটা। কম্পিউটার সায়েন্সের বাইরে মাঝে মাঝে আমার কাছে অন্য বিষয়ের সমস্যা নিয়েও পরামর্শ চাইতে আসে। বিষয় হিসেবে অংক যেহেতু কোনো মুখ নিঃসৃত ভাষার উপরে নির্ভর করে না, দেখা যাচ্ছে আলি শুরু থেকেই অংক বিষয়ে বেশ ভালো করছে। কেবল আলি নয়, আমি ব্যক্তিগত পর্যায়েও অনেককেই চিনি, বিশেষত গত কিছু বছরে ইতালি অভিবাসী ছিলেন- এমন বাঙালিদের অসংখ্য পরিবার ইংল্যান্ডে চলে এসেছেন- তাদের বেশিরভাগ ছেলে-মেয়েরাই এদেশের স্কুলে প্রধানত ভাষার সমস্যায় ভোগে, কিন্তু অংক বা এ জাতীয় বিষয়ে মোটামুটি শুরু থেকেই ভাল করতে পারে। তবে এসব বাচ্চাদের জন্য ভাষার সমস্যাটা কেবল শুরুর কয়েকটা বছর, তারপর প্রায় সবাই-ই দ্রুত ইংরেজি ভাষা শেখে ফেলে, এবং অচিরেই আর সব সহপাঠিদের সাথে অকৃত্রিম মিশে যেতে পারে।
আলিদের গ্রুপের সাথে সেদিন আমাদের শিক্ষাসফর ছিল। অন্য সহপাঠিদের বাদ দিয়ে সারাটাক্ষণ ছেলেটা আমার আশে-পাশে। তাদের বাড়ি ছিল খাইবার-পাশে, সেখানে প্রকৃতি যে কত সুন্দর, আবহাওয়া যে কত ভাল লাগতো, কত কত বন্ধু-বান্ধব ছিল তার – সেসব বলতে লাগলো। তার কাছেই প্রথম জানলাম, পাকিস্তানের খাইবার পাস অঞ্চলে শীত কালে তুষারপাত হয়! এমন অনেক বিষয়-আশয় পেরিয়ে অচিরেই সে আলোচনা ক্রিকেটে নিয়ে ফেলল। কোনো একসময় আমি ক্রিকেটের দারুণ ভক্ত ছিলাম। কিন্তু সেটা অন্তত পাঁচ-ছয় বছর আগের কথা। বর্তমান সময়ের ক্রিকেট বিষয়ে আমার জ্ঞান পত্রিকার খেলার খবর পাঠের বেশি নয়। কিন্তু ক্রিকেটে আলির উৎসাহ সীমাহীন। অচিরেই বুঝলাম, কম্পিউটার সায়েন্সের আমি ওর শিক্ষক হলেও, ক্রিকেট বিষয়ে আমি ওর বড়জোর নিচু ক্লাসের ছাত্র হবার যোগ্যতা রাখি। সারাবিশ্বের ক্রিকেটারদের খবর, পরিসংখ্যান আলির নখদর্পণে। উৎসাহের আতিশয্যে আলোচনার মাঝে মাঝে ইংরেজি জ্ঞানের অভাব সে পুষিয়ে নিচ্ছিল উর্দূ শব্দ দিয়ে। সে জানালো, তার ইচ্ছে ভবিষ্যতে ক্যারিয়ার হিসেবে প্রফেশনাল ক্রিকেট বেছে নেবে। খানিকক্ষণ কথার বলার পর সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, স্যার, তামিম ইকবালের কী হয়েছে? আমি বললাম, কেন? কিছু হয়েছে নাকি? উত্তরে আলি জানালো, সে তামিমের ব্যাটিংয়ের খুব বড় ভক্ত। কিন্তু বিশ্বকাপে তামিম ইকবালকে না দেখে খুব হতাশ হয়েছে, বিস্মিতও হয়েছে। সেজন্যই জানতে চাচ্ছে, তামিমের কী হয়েছে?
মজার ব্যাপার হলো, তার প্রশ্ন শুনে মনে হলো, তাইতো! আমাদের প্রধানতম ব্যাটসম্যান তামিমের আসলেই কী হয়েছিল বিশ্বকাপে – এ সংক্রান্ত পত্রিকার মারফতে কী কী খবর পড়েছিলাম বটে, কিন্তু সে অর্থে এর কোনো সদুত্তরতো আমার একদমই জানা নেই! আলি অবশ্য আমার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করলো না, হড়বড় করে সাকিবের প্রতি তার ভালো লাগা, মোস্তাফিজের বোলিং যে তাকে মুগ্ধ করে, বাংলাদেশ দলের উঠতি আরো অনেক তারকার খেলা তাকে বাংলাদেশের দলের প্রতি মুগ্ধ করে চলেছে – সেসব বলে গেল। তার কথা শুনতে শুনতে আমি খানিকটা নষ্টালজিক হয়ে গেলাম। আমি যদিও দল হিসেবে পাকিস্তানী ক্রিকেট টিমকে কখনো সাপোর্ট করতে পারিনি, তবে এতো অস্বীকার করার উপায় নেই যে এক সময় পাকিস্তানী কত কত খেলোয়াড় আমাদেরকে তাদের অমিত প্রতিভায় মুগ্ধ করতো: ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইফনুস, সাইদ আনোয়ার, ইনজামা-উল-হক, সাইদ আফ্রিদি, শোয়েব আখতার – আমাদের বড় হয়ে ওঠার বেলায় ক্রিকেটপ্রীতিকে উস্কে দিতো! তখন হয়তো পাকিস্তানের কোনো বালক কিংবা বালিকা বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কোনো একজন খেলোয়াড়ের নামও ঠিক মতো জানতো না, মুগ্ধ দর্শক হয়ে থাকা তো দূরের কথা! সময়টা কি দারুণভাবেই না বদলে গেছে। আমাদের ক্রিকেট দল তাদের প্রাপ্য সুযোগ কাজে লাগিয়ে বর্হিবিশ্বের ক্রিকেট প্রেমীদের মনে জায়গা করে নিয়েছে।
পাকিস্তান ক্রিকেটে যে দলাদলি সংক্রান্ত জটিলতার কারণে প্রায়ই নানান সমস্যায় পতিত হয় আলি আমাকে সে সম্পর্কিত কিছু খবর দিয়ে, এবং সম্প্রতিক ক্রিকেট বিশ্বে বাংলাদেশের সম্ভাবনা সংক্রান্ত একটা ছোট্ট বয়ান দিয়ে যে কথাটা দিয়ে উপসংহার টানলো, তা হচ্ছে: স্যার, আপনাদের ওখানেও কি আমাদের পাকিস্তান দলের মতো ‘দলবাজি‘ আছে?
আমি তড়িত ভাবার চেষ্টা করলাম। মনে পড়লো, সোশ্যাল মিডিয়ার খবরাখবর, কিংবা পত্রিকার প্রতিবেদনের নিচে ছাপানো আম-জনতার মতামত পড়লে তো মনে হয় – আছে। কিন্তু প্রধান মিডিয়ায় এমন ধরনের কিছু দেখেছি বলে খুব একটা মনে করতে পারলাম না। অতএব, আমি নিজেকে প্রবোধ দিতে দিতে যে উত্তরটি আমি নিজে বিশ্বাস করতে চাই, সেটাই খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে দিলাম, নাহ, নেই। আলি আমার কথা বিশ্বাস করলো কি-না, জানি না, তবে সেটা মুখে প্রকাশ করলো না। মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, তাহলেই ভালো স্যার। দলবাজি না থাকলেই দেখবেন আপনাদের বাংলাদেশের ক্রিকেট দল অচিরেই অনেক ভালো করবে।
লণ্ডন, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
লেখক: কথা সাহিত্যিক