গাজীউল হাসান খান ♦
যার নিজের ঘরে স্ত্রী ছাড়া আপন বলতে তেমন কেউ ছিল না, তিনিই বাংলাদেশী অধ্যুষিত পূর্ব লণ্ডনের ঘরে ঘরে শিশুদের মধ্যে মাতৃভাষা বাংলাসহ শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে কিংবা তার আগে ও পরে লণ্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস বারা কাউন্সিলে লেবার পার্টির শক্তিশালী অবস্থান থাকলেও নবাগত বাংলাদেশী সম্প্রদায়ের তেমন কোনো প্রভাব বা কদর ছিল না। কর্মসংস্থান, বাসস্থান কিংবা শিশুদের শিক্ষা-দীক্ষার ক্ষেত্রে তারা চরমভাবে অবহেলিত ছিল বললেই চলে। তেমন একটি অবস্থার অবসান এবং তার একটি সার্বিক সমাধানের জন্য পূর্ব লণ্ডনে যে ক’জন বাংলাদেশী (প্রবাসী) বিনা দ্বিধা ও নির্ভয়ে এগিয়ে এসেছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন স্বল্পভাষী ও নিভৃতচারি বাঙালি শিক্ষক মোহাম্মদ নুরুল হক সাহেব। তখন নবাগত বাংলাদেশী সম্প্রদায়ের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে অন্যান্যদের মধ্যে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের ভেতরে ও বাইরে কাজ করেছিলেন ব্যারিস্টার জিয়া উদ্দিন ও ব্যারিস্টার শাহজাহানের মতো কয়েকজন বলিষ্ঠ সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তাদের সাথে ছিলেন তখনকার তরুণ প্রজন্মের অগ্রদূত রাজন জালাল উদ্দিন থেকে শুরু করে সিরাজুল হক সিরাজসহ অনেকে। তা ছাড়াও সে সার্বিক প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে মাথার ওপরে ছিলেন বিশিষ্ট সমাজসেবী মরহুম তোসাদ্দুক আহমদ এবং ফকরুদ্দিন আহমদের কর্ম তৎপরতা, পদচারণা ও দিকনিদের্শনা। উল্লেখিত প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে পেশাগত দিক থেকে একজন বাঙালি শিক্ষক ও সমাজসেবী জনাব নুরুল হক সার্বক্ষণিকভাবে পূর্ব লণ্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটসে বসবাস করতেন। তখন পর্যন্ত নি:সন্তান এবং পূর্ব লণ্ডনে বিচরণশীল এক ছিপছিপে লম্বা তরুণ শিক্ষক ও সমাজকর্মীটি বাংলাদেশীদের ঘরে ঘরে গিয়ে তাদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতেন, তাদের আবাসিক অবস্থা, শিশুদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে নিয়মিত মতবিনিময় করতেন।
পূর্ব লণ্ডনের এ অঞ্চলটিজুড়ে তখনও ছিল প্রবাসী বাংলাদেশীদের বসবাসের একটি অন্যতম প্রধান স্থান। তাদের অধিকাংশই ছিলেন বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল থেকে আগত সাধারণ মানুষ। শিক্ষা-দীক্ষা কিংবা পেশাগত অবস্থান তখন ছিল অত্যন্ত পিছিয়ে। সে কারণে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ও সামাজিক অবস্থান ছিল অত্যন্ত নড়বড়ে। তদুপরি বর্ণবাদীদের সীমাহীন অপতৎপরতা ও লাগাতার অথচ বিচ্ছিন্ন আক্রমণে তখনকার সংখ্যালঘু বাংলাদেশীদের জীবন-জীবিকা হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। সামাজিক কিংবা আইনী নিরাপত্তার অভাবে তারা অত্যন্ত কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। চাকরি-বাকরি কিংবা কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে স্থানীয় কাউন্সিলের দিক থেকে তারা তেমন কোনো সহায়তা পেত না। টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে লেবার পার্টির ব্যাপক প্রভাব প্রতিপত্তি থাকলেও সামাজিক পরিমণ্ডলে বিরাজমান বর্ণবিদ্বেদেষের কারণে বাংলাদেশীরা বা ভারতীয় রেস্টুরেন্ট এবং পোষাক শিল্পে কিছু কিছু মানুষের কর্মসংস্থান হতো, তা-ও আবার অত্যন্ত অনিয়মিতভবে। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত রাজনৈতিক চক্র কিংবা সমাজসেবকদের কাছেও সে পরিস্থিতিটি ছিল অত্যন্ত কঠিন ও অনতিক্রম্য। তবে তারা তাতে হাল ছেড়ে দিয়ে পিছু হটে যাননি। অত্যন্ত ধৈর্য, সহনশীলতা ও দীর্ঘ পরিকল্পনা নিয়ে সে অবস্থাতেও যে ক’জন বাংলাদেশী সমাজসেবক টিকেছিলেন এবং সামনে এগিয়ে গিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে একজন অগ্রদূত ছিলেন শিক্ষক নুরুল হক সাহেব। তিনি সিলেটের অধিবাসী ছিলেন না। তবুও নোয়াখালী থেকে আগত এ নিরহংকার, সহজ-সরল মানুষটি নির্দ্বিধায় মিশে গিয়েছিলেন বাংলাদেশ থেকে আগত সকল সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সাথে। একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রাম ও জীবনাচরণের মধ্যে।
নুরুল হক সাহেব তার তারুণ্যের সকল উদ্যম ও উৎসাহ নিয়ে পূর্ব লণ্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটসে বসবাকারি প্রায় সকল বহিরাগত বাংলাদেশীদের ঘরে ঘরে যেতেন। সদাবিনয়ী নিরহংকার মানুষটি বয়স নির্বিশেষে তাদের সুখ-দু:খ এবং সকল সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতেন। পেশাগত ক্ষেত্রে কিংবা আবাসিক সমস্যা ও তাদের সন্তানদের স্বাস্থ্যসেবা এবং এমনকি শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে মতবিনিময় করতেন। কাউন্সিল থেকে স্বাস্থ্য বিভাগ এবং গৃহায়ন থেকে শিক্ষাবিভাগে ব্যক্তিগতভাবে নিজে যেতেন বিভিন্ন দেন-দরবার করতে। শীত-গ্রীষ্ম বারো মাস এক হাতে এক কালো ছাতা এবং অপর হতে বিভিন্ন দরখাস্তভর্তি একটি ফাইল নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়াতেন দিনমান। সেভাবেই তার অনুভুতি বা উপলব্ধি ঘটলো যে স্থানীয়ভাবে রাজনৈতিক শক্তি সঞ্চয় ছাড়া নবাগত অথচ অধিকার বঞ্চিত বাংলাদেশীদের সমস্যার পরিকল্পিতভবে কোনো সমাধান আসবে না। তৎকালীন বাংলদেশী কমিউনিটি নেতা এবং সমাজসেবকদের পরামর্শে তিনি টাওয়ার হ্যামলেটসসহ পূর্ব লণ্ডনভিত্তিক লেবার পার্টির নেতাদের সাথে যোগাযোগ শুরু করেছিলেন। তিনি টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অর্থ্যাত কাউন্সিল নির্বাচনে বাংলাদেশীদের সংখ্যানুপাতিক অংশগ্রহণ কিংবা প্রতিনিধিত্ব দাবী করে বসলেন। তাতে টাওয়ার হ্যামলেটস-বেথনালগ্রীন এলাকার তৎকালীন সংসদ সদস্য মরহুম পিটা শোর ছাড়া আর তেমন বিশেষ কারো সমর্থন পাননি তখন। শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে বাংলাদেশী কমিউনিটি নেতাদের পরামর্শ ও তরুণ সমাজকর্মীদের সমর্থন নিয়ে সম্ভবত আশির দশকের গোড়ার দিকে স্থানীয় কাউন্সিল নির্বাচনে একজন কাউন্সিলর পদে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছিলেন তিনি। এ বিষয়টি বিরাট কিছু না হলেও সেই থেকে পূর্ব লণ্ডনে বাংলাদেশেীদের উত্থান ও অগ্রগতি শুরু হয়েছিল।
সংক্ষিপ্ত পরিসরে এ নিভৃতচারি এবং নীরব যোদ্ধার মৃত্যুতে তাঁর মহান স্মৃতির প্রতি জানাই অকৃত্রিম শ্রদ্ধা। তাঁর স্মৃতি আমাদের প্রবাসী বাংলদেশীদের মধ্যে অমর হয়ে থাকুক। তাঁর অসামান্য ত্যাগ এবং অবদান আমাদের বাংলাদেশী সম্প্রদায়ের সকল অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আলোকবর্তিকা হয়ে পথ দেখাক, সেটিই কামনা করছি।
ঢাকা, ১৫ই ফেব্রুয়ারী ২০২৪
লেখক: বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক