ইব্রাহীম চৌধুরী ♦
নিউ ইয়র্ক, ১১ জানুয়ারী ২০২৩:
অজয় পাল চলে গেছেন। সবাই যেখানে যায়। সেখানেই গেছেন। যাওয়ার সময় কাউকে কি কিছু বলে গেলেন?
আমাকে কল দিয়েছেন। বিদায়ও নিয়েছেন। অজয় পাল কি জানতে পেরেছিলেন, তাঁর সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। মানুষ কি টের পায়? দিন ফুরিয়ে আসার কথা। না বলা কথা বলে যাওয়ার কথা। প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির হাহাকার কি মানুষ কাউকে জানিয়ে যেতে চায়? জীবনের সব অভিমান, সব অপ্রাপ্তি ধারণ করেই কি জীবন একসময় থেমে যায়! একদম অনিচ্ছায়, অপ্রস্তুতিতে! সবই যেন প্রাকৃতিক। আমরাই এসবের যোগসূত্র সৃষ্টি করি!
শাস্ত্রতো ভিন্ন কথা বলে। যারা ব্যাখ্যা করেন, তাঁরাও ঘুরপাক খান। প্রকৃতিও যে এক ঘুরপাকের খেলা। এমন ঘুরপাকের কবলে পড়েই গেয়ে উঠতে ইচ্ছে হয়, ‘খেলিছ এ বিশ্বলয়ে বিরাট শিশু আনমনে…।।
একদিন এমন চলে যাওয়া নিয়ে অবশ্য অনেকবারই কথা হয়েছে অজয় পালের সাথে। নিশীথ রাতের আড্ডায়, তপ্ত রোদের দুপুরে, খিদে-লাগা পেটের হাহাকারে। এসবতো বোহেমিয়ান কালের অকথিত অধ্যায়!
চমৎকার হাতের লিখা ছিল অজয় পালের। তখনতো আমরা হাত দিয়েই লিখতাম। কতো দ্রুত সময় চলে গেলো। কলম নামের অপরিহার্য অনুষঙ্গ যাদুঘরের দিকে দ্রুত যাত্রার জন্য উবার ডেকে বসে আছে। এসময় যদি বলা হয়, অজয় পাল এক অনুকরণীয় ‘কলম যোদ্ধা’ ছিলেন। তা কি ঠিক হবে? না ’আঙ্গুল যোদ্ধা’ বলতে হবে!
মফস্বল শহর থেকে কে কার আগে ঢাকায় রিপোর্ট পাঠাবেন, তাঁর প্রতিযোগিতা ছিল। একই ডেস্কে বসে, একই আড্ডায় বসে নিউজ লিখতাম। একজনের লেখা আরেকজন আড়াল করে রাখতে হয়। চেহারা দেখে অনুমান করে নিতে হতো, কতোটা এক্সক্লুসিভ অন্যজনের হাতে- এ নিয়ে পারস্পরিক উত্তেজনার সময় তখন আমাদের।
ধূমায়িত সিগারেটের প্রতি যৌবনের ভালোবাসা জানাতে অজয় পালের পায়চারি বাড়ে। অজয় পালের ভরাট কণ্ঠ।
: খোকন, স্কুপ নিউজ। কালকের পত্রিকায় ‘তিন কলাম’ যাবে তোমার নিউজটি। প্রথম পাতায়। কতো সময় আর লুকিয়ে রাখবে!
প্রসঙ্গ পাল্টাই।
: কী হবে দাদা এতো সিরিয়াস হয়ে! আপনি, আমি মারা গেলে নিজের পত্রিকাটিও এক কলামের বেশি নিউজ করবে না। তাও ছাপবে ৭-এর পাতায়। ‘পাত্রী চাই’ বিজ্ঞাপন চলে আসলে পরের দিন ছাপা হবে বলে বাদ পড়বে। পরের দিন কেউ আর মনেই রাখবে না।
হো হো করে হাসতেন অজয় পাল। অজয় পাল একজন খাঁটি সাংবাদিক ছিলেন। ছিলেন মাঠের রিপোর্টার। বাংলাদেশের পতাকার জন্মের সমবয়স ছিল তাঁর সাংবাদিকতার। জানিনা ঢাকার কোন কোন পত্রিকায় অজয় পালের মৃত্যু সংবাদ এক কলামেই ছাপা হয়েছে। একসময় দেশের সবচেয়ে দাপুটে রিপোর্টারদের একজন অজয় পাল। তাঁর মৃত্যুতে কারো কিছু হয়তো যায় আসে না।
কথাটি লিখতে গিয়ে সিঁথিতে সিঁদুর লাগানো নববধূ বৌদির কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে, ছোট বেলায় খুব দুষ্টুমি করা তাঁর দুই ছেলের কথা। যারা স্বজন হারায়, তাঁরাই ধারণ করে এ হারানোর বেদনা। যারা বন্ধু হারায়, তাঁদের বুকেও হাহাকার উঠে। অজয় পাল অগ্রজ হলেও বন্ধু ছিলেন। বেদনার হাহাকারে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাচ্ছি।
রাজনীতি থেকে সাংবাদিকতায় আশির দশকের শেষ দিকে সক্রিয় হই। তখন কাউকে পরোয়া না করার সময় আমাদের। দেশের সাংবাদিকতায় পরিবর্তনের বাঁক। অজয় পালকে শুধু পরোয়াই নয়, সমীহ করতাম।
অনেক কিছুই ঘটছিল তখন। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, ঘাতক দালালদের বিরুদ্ধে আন্দোলন। রাজনীতি ও সমাজের নানা অস্থিরতা। মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, রাজাকার দালালদের বিরুদ্ধে দুই কলম লিখলে তখন কোন কোন পক্ষের ব্যাপক মাইণ্ড করার সময়টি। অজয় পাল সেই বৈরী সময়ে আমাদের উজ্জ্বল সতীর্থ হয়ে উঠেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময়টিতে রিপোর্ট করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকার দাপুটে সাংবাদিক ছিলেন। লেখার দক্ষতা, দ্রুত নিউজ করা সহ সদর অন্দরের লোকজনের সাথে সংযোগ রাখার বিরল যোগ্যতা ছিল তাঁর। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে স্পীকার, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীপাড়ার লোকজনের সাথে অজয় পালের সংযোগ দেখেছি কাছে থেকে। এমন বহু রিপোর্ট, সাক্ষাৎকার, স্কুপ নিউজ করার নানা রোমাঞ্চে ভরা ছিল অজয় দার সাথে আমার দিনকাল। অগ্রজপ্রতীম অজয় পালকে নিয়ে অনেক বেশি বলতে পারবেন দুই অগ্রজপ্রতীম তবারক হোসেইন এবং মাহবুবুর রহমান।
সমীহ করতাম তাঁর লেখার দক্ষতার জন্য। গল্পকার হতে পারতেন। ঝরঝরে গদ্য। সহজ করে উপস্থাপনার বিরল গুণ ছিল। রেডিওতে তালিকাভুক্ত গীতিকার ছিলেন। নাটক করেছেন, লিখেছেন। একজন আপাদমস্তক সাংবাদিক ছিলেন। দেশে সাংবাদিকতা করে আয়ের উপর নির্ভর করে সংসার চালাতেন। চালচলনে চৌকস থাকতেন। দেখে ধারনা করা যেতো না অর্থকষ্টের বিষয়টি। সংযোগ ব্যবহার করে বৈষয়িক হওয়ার সুযোগ গ্রহণ করেননি। বহু রাজনীতিবিদদের বিবৃতি লিখে দিয়েছেন। আমার সামনেই বহু লিফলেট আর আন্দোলন সংগ্রামের ইশতেহার লিখতে হয়েছে অজয় পালকে।
আমার বিয়ের কার্ড ছাপা হবে।
: অজয় দা, একটা দাওয়াত কার্ডের মুসাবিদা করে দেন।
: খোকন, এ কাজ তোমার চেয়ে কেউ ভালো পারবে বলে আমার জানা নেই!
: দাদা, নিজের কাজ বলে লজ্জ্বা লাগছে। বিয়ে করা একটা লজ্জ্বা শরমের কাজ। লিখে দিলেন অজয় পাল।
: দাদা, কিছুটা কঠিন হয় গেলো মনে হয়!’
: তুমি নিজে কঠিন লিখে থাকো! তাছাড়া কার্ড এমন করলে সুবিধা, লোকজন কম আসবে। খাবার বাঁচবে।
কার্ড লিখে দিলেও আমার বিয়ের অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত ছিলেন অজয় পাল! তাঁর হাতে নাকি উপহার ক্রয় করার কোন টাকা ছিলো না। এ নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল।
অজয় পাল মারা গেছেন। এ সংবাদে ২৭ বছর পর কার্ডটি হাতে নিলাম। আজকাল এমনিতেই কান্না আসে। কান্না আসার জন্য অজয় পালের মারা যাওয়ার দরকার হয় না। গড়িয়ে পড়া বেদনার অশ্রু অজয় পালকে ভালোবাসা জানায়।
যারা দেশ দশের খবর বিলিয়ে নিজের জীবন বিলিয়ে যায়, তাঁদের খবর কেউ রাখে না! অজয় পালের খবরও কেউ রাখেনি। দেশে থাকা অবস্থায় অর্থ কষ্ট করেছেন। লণ্ডনে যাওয়ার পরের অবস্থা জানিনা। নিজের প্রতি অবিচারও করেছেন। এ নিয়ে কথা হয়েছে। একান্তে। একাগ্রতায়।
অজয় পাল স্ট্রোক করে হাসপাতালে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে কল দিয়েছিলেন। ওয়াশিংটন ব্রিজ পাড়ি দিতে দিতে আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই ‘সরি’ বলে বিদায় নিয়েছেন। অন্তিম বিদায়! কী কথা হয়েছিল, এ লেখায় প্রসঙ্গটির আর অবতারণা করছি না। প্রিয়ভাজন দিলু নাসের জানালেন, তাঁকেও নাকি একের পর এক কল দিয়েছিলেন অজয় পাল! বিশেষ কিছু বলার ছিলো তাঁর? শেষ কথা! আমার কাছে ‘সরি’ বলে লাইন কেটে দিলেন। স্বার্থপর সময়ে দাঁড়িয়ে অজয় পাল পাল্টা আমাকে ‘সরি’ বলার কোন সুযোগই দেননি। এক বিশাল হৃদয়ের প্রতিভাবান সাংবাদিককে আমরা হারিয়েছি। সমাজ বা রাষ্ট্রের নজর থেকে বঞ্চিত থেকেছেন। তাঁর কর্মের কথা অন্য কেউ মনে রাখলেও কর্মসহযোগিদের বেদনার তীব্রতায় অজয় পালের নাম উচ্চারিত হবে। তাঁর স্মৃতির প্রতি এ অভাজনের শ্রদ্ধা!