তাইসির মাহমুদ ♦
লণ্ডন, শনিবার, ৭ জানুয়ারি ২০২৩:
অজয় দা। বিশিষ্ট সাংবাদিক অজয় কুমার পাল। তিনি আর আমাদের মধ্যে নেই। ৪ জানুয়ারি (২০২৩) বুধবার স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন রয়েল লণ্ডন হাসপাতালে। তিন দিনের মাথায় ৭ জানুয়ারি শনিবার পাড়ি জমালেন পরপারে। ভাবতে পারিনি দাদা এতো তাড়াতাড়ি বিদায় নেবেন। হাসপাতালে দেখতে যাবো ভাবছিলাম, কিন্তু শেষ দেখাটা হলো না। হঠাৎ মৃত্যুর সংবাদ শুনে মর্মাহত হলাম।
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে অজয়দার সঙ্গে পরিচয়। পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সিলেটের আরো এক কীর্তিমান সাংবাদিক প্রয়াত মোহাম্মদ আব্দুল বাসিত। সম্পর্কে তিনি ছিলেন আমার মামা। অজয় দা তখন দৈনিক বাংলাবাজারের সিলেট ব্যুরো চীফ। শহরের তালতলায় অফিস। সহকারি ব্যুরো প্রধান হিসেবে কাজ করতেন সিনিয়র সাংবাদিক আ.ফ.ম সাঈদ। সাংবাদিক আব্দুল বাসিত তখন দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকার শেষের পাতায় ‘টক ফ্রম দ্যা জঙ্গল’ শিরোনামে নিয়মিত একটি কলাম লিখতেন। মাঝে মধ্যে বাংলাবাজার অফিসে যেতেন। একদিন বাসিত মামা আমাকে সঙ্গে নিয়ে অজয় দার অফিসে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বললেন, “অজয়, আমার ভাগনা। লেখালেখির চেষ্টা করে। খেয়াল রেখো।”
সেই থেকে অজয় দা ভাগনার মতোই স্নেহ করতেন। সবসময় লিখতে উৎসাহ দিতেন। বিশিষ্ট সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরী সম্পাদিত দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকা তখন সিলেটে খুবই জনপ্রিয়। প্রতি শুক্রবার ’সিলেট বাজার’ নামে চারপাতার একটি রঙিন ক্রোড়পত্র প্রকাশ হতো। ওই পাতায় সিলেটের নবীণ লেখক-সাংবাদিকদের লেখা ছাপা হতো। অজয় দা এই পাতার জন্য বিষয় নির্ধারণ করে লেখা দিতে বলতেন। কীভাবে লেখাটি সুন্দর করতে হবে, কোথা থেকে ছবি যোগাড় করতে হবে বলে দিতেন।
একবার জাফলং পাথর কোয়ারি নিয়ে একটি ফিচার লিখে অজয় দার হাতে দিয়ে এলাম। পরদিন অজয়দা ফোন করে বললেন- “তাইসির, খুবই সুন্দর ফিচার লিখেছো, আতার (ফটো সাংবাদিক আতাউর রহমান আতা) অফিসে গিয়ে দেখো জাফলংয়ের একটি ছবি পাও কি-না। তাঁকে বললে সে দিবে, তাঁর কাছে আছে। এরপর আতা ভাইর কাছ থেকে একটি ফটো যোগাড় করে দিলাম। তিনদিন পর শুক্রবারের ’সিলেটবাজার’ বিভাগে অর্ধপাতাজুড়ে জাফলং নিয়ে লেখা চমৎকার ফিচার ছাপা হলো।
একদিন আমি ও সাংবাদিক চৌধুরী আমিরুল হোসাইন (সিলেটবাণীর তৎকালিন বার্তা সম্পদক) কবি দিলওয়ারের বাসায় তাঁকে দেখতে গেলাম। কারণ আগেরদিন স্থানীয় পত্রিকায় একটি নিউজ ছাপা হয়েছে, “কবি দিলওয়ারের দিনকাল ভালো যাচ্ছে না।” ফিরে এসে অজয় দাকে না জানিয়েই ‘একান্ত আলাপচারিতায় কবি দিলওয়ার’ শিরোনামে একটি সাক্ষাৎকার লিখে বাংলাবাজার পত্রিকায় পাঠিয়ে দিলাম। দুই তিনদিন পরই লেখাটি আমার ও কবি দিলওয়ারের ছবিসহ পুরো পাতাজুড়ে ছাপা হলো। ছাপা হওয়ার একদিন পর অজয়দার সাথে দেখা হলে বললেন, তোমার নেয়া সাক্ষাৎকার পড়লাম। খুব সুন্দর লিখেছো।
একদিন একটি বিষয় দেখে আমি অভিভূত হলাম। তালতলায় বাংলাবাজারের সিলেট অফিসে বসে চা খাচ্ছি। শুনলাম, অজয় দা তাঁর অফিসের পিয়নকে বলছেন, “সোহেল (সম্ভবত) আমাকে একটু সহযোগিতা করো। তোমার দিদির বাজার শেষ হয়ে গেছে। তুমি একটু বাজারটা করে দাওনা?” পকেট থেকে টাকা বের করে দিলে সোহেল চলে গেলেন। কোনো অফিসের বস পিয়নকে বলেন “আমাকে একটু সহযোগিতা” করো- এটা দাদার কাছ থেকেই প্রথম শুনলাম।
দাদা খুবই বড় মনের মানুষ ছিলেন। জুনিয়র সাংবাদিকদের খুব স্নেহ করতেন। সবসময় উৎসাহ অনুপ্রেরণা দিতেন। ব্যক্তিত্ববান ও নিরহংকার ছিলেন। হামবড়া ভাব ছিলো না। দলমত নির্বিশেষে সকলের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিলো।
২০০৩ সালে আমি লণ্ডন চলে এলাম। দাদাও কিছুদিন পর চলে এলেন। ২০০৮ সালে তিনি একবার লণ্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের নির্বাচনে নির্বাহী সদস্য পদে প্রার্থী হলেন। আমি তখন বাংলাদেশে সপরিবারে বেড়াতে গিয়েছি। দাদা লণ্ডন থেকে আমাকে ফোন দিয়ে বললেন- তাইসির, আমাকে তো সকলে জোর করে নির্বাচনে প্রার্থী করে দিয়েছেন। তোমার ভোট দরকার। বললাম, দাদা আপনাকে ভোট চাইতে হবে না। আমার ভোট আপনি পাবেন। নির্বাচনের তারিখের আগেই লণ্ডন ফিরে আসি। দাদাকে ভোট দিই। তিনি নির্বাহী সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর আমি যতবারই নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছি, দাদাকে ফোন দিয়ে বলেছি, আপনার ভোট চাই। দাদার উত্তর, ভোট চাইতে হবে না। তুমি না বললেও আমি ভোট দেবো। বললেন, আমার কি মনে নেই, আমি যখন নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলাম, তুমি তখন বাংলাদেশে ছিলে। আমি ভোট চাইতে ফোন দিয়েছিলাম। তুমি বলেছিলে, ভোট চাইতে হবে না। সুতরাং তুমি যতবার নির্বাচনে দাঁড়াবে আমার ভোট তুমি পাবে। তুমি ভোট চাও অথবা না-ই চাও।
২০০৬ সালে আমার বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক হলে বিয়ে উপলক্ষে “আয়না যুগল” নামে একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নিলেন বন্ধু-সহকর্মীরা। দাদা একদিন সাপ্তাহিক নতুন দিন অফিসে এলেন। বললাম, দাদা আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। বললেন, কনগ্রেচুলেশন্স। বললাম, শুধু কনগ্রেচুলেশন বললেই হবে না। লেখা দিতে হবে। একটি স্মারক বেরুবে। বললেন, এক পিস সাদা কাগজ দাও। আমি এখনই লিখে দিয়ে দিই। সাথে সাথে কাগজ-কলম নিয়ে টেবিলে বসে পড়লেন। মিনিট দশেকের মধ্যেই লেখা শেষ করে কাগজ-কপিটি আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, নাও একটি ছড়া লিখে দিলাম। ছড়ার শিরোনাম ছিলো ‘বিয়ের ছড়া’। পড়ে দেখি চমৎকার ছড়া লিখেছেন দাদা। এ ধরনের কত স্মৃতি আজও অম্লান। অজয় দার সেই ছড়াটি এখানে তুলে দিলাম।
বিয়ে মানেই ইয়ে
অজয় পাল
বিয়ে মানেই ইয়ে
অন্য রকম অনুভূতি
বিয়ে মানেই বুকের মাঝে
উথালপাতাল মধুমতি।
বিয়ে মানেই দুই জীবনের
একটি ধারা
বিয়ে মানেই আর কিছু নয়
আত্মহারা।
বিয়ের পিঁড়ি
জীবন সিঁড়ি
অতিক্রমের ধাপ
সুখ-দুঃখের
মিশেল সেথায়
নেইকো অনুতাপ।
অজয় দা শুধু সাংবাদিকই ছিলেন না, ছিলেন একজন শক্তিমান ছড়াকার ও বাংলাদেশ বেতারের নিবন্ধিত গীতিকার। দাদার মৃত্যুতে শোকাহত। গভীর শোক-শ্রদ্ধা তাঁর বিদেহী আত্মার প্রতি। সাংবাদিকতা জীবনের শুরুতে দাদার স্নেহ ও উৎসাহ এবং শেষদিন পর্যন্ত তাঁর অনুপ্রেরণার কথা কোনোদিন ভুলবো না।
লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক দেশ এবং জেনারেল সেক্রেটারি, লণ্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব।