সাগর রহমান ♦
ইউরোপসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ এই মুহূর্তে তাপপ্রবাহে ভুগছে। অবশ্য ‘ভুগছে’ বললে বেশ মোলায়েমই শোনায়, ওয়ার্ম ওয়েদার এট্রিবিউশান ইনিশিয়েটিভ একে বলছে ‘হিট হেল’। অবস্থা যা চলছে, তাতে ‘হেল’ কিংবা নরক-ই আসলে মানানসই শব্দ। গ্রিস, ইটালি, জার্মানি, পর্তুগাল, ক্রোয়েশিয়া, তুরস্ক, বুলগেরিয়া, কসোভো, নরওয়ে, সুইডেন, আলজেরিয়া, কানাডার পূর্বাঞ্চল, সাইবেরিয়ার কিছু অংশ, জাপান এবং কাস্পিয়ান সাগরের কয়েকটি উপকূলীয় এলাকাসহ আরো কিছু দেশের কিছু কিছু অংশ আক্ষরিক অর্থেই জ্বলে যাচ্ছে। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, যুক্তরাজ্যে, বিশেষত লণ্ডনে বেশ শীত-শীত অনুভূত হচ্ছে। রাতে ঘুমুতে গেলে কোনো-কোনোদিন রীতিমত কাঁথা-কম্বলের খোঁজ করতে হয়। এখানকার প্রচলিত কৌতুকটি হচ্ছে: ইউরোপ যখন পুড়ছে, যুক্তরাজ্যের আবহাওয়া এমন শীতল কেন? উত্তর: বেক্সিটের কল্যাণে। বছরের এ সময়টায় এদিকে বহু কাঙিক্ষত গ্রীষ্মকাল। লোকজন পরিবার-পরিজন নিয়ে নানান দেশে বেড়াতে যান। যুক্তরাজ্যে মানুষ কাতারে কাতারে পর্যটনে বের হন ট্রাভেলিং ব্যাগ হাতে করে। কিন্তু আশেপাশের দেশগুলোতে চলমান তাপপ্রবাহ এই গ্রীষ্মের বহু আয়োজন উল্টেপাল্টে দিচ্ছে। বেশ কয়েকটি দেশে ভয়াবহ দাবদাহের প্রভাবে দাবানল দেখা দিয়েছে। পত্রিকার পাতায় প্রাণ হাতে করে পালানো টুরিস্টদের ছবি ছাপা হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, নারী পুরুষ শিশু- যে যেভাবে ছিল, সেভাবেই রাস্তা ধরে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দৌড়াচ্ছে। ব্যাকগ্রাউণ্ডে দিগন্ত ছাপিয়ে উঠছে আগুনের গনগনে শিখা। জঙ্গল জ্বলছে, আগুনের লেলিহান শিখা গিলে খেতে আসছে আশে-পাশের নগর, হোটেল, রেস্তোরা। এ আগুন এমনই আকস্মিক এবং মূহূর্তে ভয়াবহ হয়ে উঠে যে বেশিরভাগ ট্যুরিস্টই হোটেলে তাদের যাবতীয় জিনিসপত্র রেখেই কোনোরকমে প্রাণ হাতে করে পালিয়েছেন। ছবিতে দেখলাম, অনেকে স্রেফ সুইমিং কস্টিউম পরেই দৌড়াচ্ছেন। তার মানে, সুইমিং পুল থেকে বেরিয়ে পোশাক পরার সময়-সুযোগটুকু পাননি। প্রচণ্ড দাবদাহের প্রত্যক্ষ ফলাফলে ফসল পুড়ে যাচ্ছে, খামারের পশু-প্রাণী মারা যাচ্ছে, দেখা দিচ্ছে ভয়াবহ পানির সংকট, এবং সর্বোপরি মারা গেছেন বেশ কিছু মানুষ।
জার্নাল নেচার মেডিসিনের এক সাম্প্রতিক গবেষণা ভীতি জাগানিয়া তথ্য প্রকাশ করেছে সপ্তাহ দুয়েক আগে। তাদের গবেষণা বলছে, গত বছর মে মাসের ৩০ থেকে সেপ্টেম্বরের ৪ তারিখ পর্যন্ত সময়ে অন্তত ৬১ হাজার ৬শত ৭২ জন মারা গেছেন তাপ-প্রবাহ বা অতিরিক্ত তাপমাত্রাজনিত রোগ থেকে। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ছিল ইটালি, প্রায় ১৮ হাজার, স্পেনে ১১ হাজার এবং জার্মানিতে ৮ হাজার। শুধু অতীতের তালিকা দিয়েই অবশ্য গবেষণাটি শেষ হয়নি, তারা ভবিষ্যতদ্বাণী করেছেন, বিশেষ কোনো পদক্ষেপ না নিলে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি সামারে ইউরোপ জুড়ে ৬৮ হাজারেরও বেশি মানুষ তাপ-জনিত কারণে মৃত্যুবরণ করবে, এবং ২০৪০ সালের মধ্যে সেটি গিয়ে দাঁড়াবে ৯৪ হাজারে! সত্যি কথাটি হচ্ছে, অবস্থা যে এমন দাঁড়াবে, সেটি আসলে অবাক হওয়ার মতো কোনো বিষয় নয়। বেশ কিছু বছর ধরেই পরিবেশ বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে আগাম সর্তকবার্তা দিয়েই আসছিলেন।
ইমপেরিয়েল কলেজের সিনিয়র লেকচারার ও পরিবেশবিজ্ঞানী ফ্রেডরিকো অটো‘র ভাষায়: “… এ অবস্থাটি আসলেই মোটেই সারপ্রাইজিং নয়। পৃথিবী জুড়েই জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার বন্ধ হয়নি, পরিবেশ ক্রম উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, এবং ফলশ্রুতিতে যত দিন যাচ্ছে, তত তাপপ্রবাহের সংখ্যা এবং ভয়াবহতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইট ইজ দ্যাট সিম্পল…”। চোখের সামনে এই যে ভয়াবহ দুর্যোগ ঘটে যাচ্ছে বছর বছর, প্রকৃতির খামখেয়ালিপনায় ছারখার হয়ে যাচ্ছে আমাদের চেনা পৃথিবী, তাতে আমাদের কারো ভ্রুক্ষেপ আছে বলে অবশ্য মনে হবার কোনো কারণ নেই। যদিও লিখলাম ‘প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা’, তবে ঠিক হয় যদি বলি ‘মানুষের খামখেয়ালিপনা’। যেভাবে এবং যে হারে আমরা পৃথিবীর ‘রিসোর্স’ ব্যবহার করে চলেছি, গবেষণা বলছে, এভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ আমাদের চাহিদার যোগান দিতে আড়াইটা পৃথিবী লাগবে! বর্তমান পৃথিবীর জল-স্থল-অন্তরীক্ষের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে মানুষের ক্ষতিকর প্রভাব পড়েনি। ১৩.৮ বিলিয়ন বছরের পুরনো মহাবিশ্বে পৃথিবীর জন্ম ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে আর মোটামুটি ২.৫ বিলিয়ন বছর আগে প্রাণের অস্তিত্ব জাগতে শুরু করে এই নীলগ্রহে। সেই হিসেবে পৃথিবীতে আধুনিক রুপের মানুষদের আগমন প্রায় নিকট অতীতের ঘটনা, মাত্র ২০০ হাজার থেকে ৭০০ হাজার বছরের মধ্যে। এই সময়কালের মধ্যে মানুষ যা আয়ত্ত করেছে, তা যেমন অকল্পনীয়, তেমনি পৃথিবীর যে পরিমাণ ক্ষতি করেছে নিজেদের স্বার্থের জন্য, তা তারচেয়েও অকল্পনীয়।
পৃথিবীর মোট ভূমির কমপক্ষে ৭০% নিজেদের মতো করে পাল্টে নিয়েছে মানুষ। জলভাগের পরিবেশ পাল্টে দিয়েছে ৬৬%। এই পাল্টে দেবার প্রেক্ষাপটে প্রায় কোনোক্ষেত্রেই ভাবা হয়নি সাস্টেনেবিলিটির বিষয়টি। পৃথিবীকে গ্লোবাল ভিলেজ তৈরি করা গেছে বটে, কিন্তু সেটি আদতে ফিরে আসছে বুমেরাং হয়ে। শিল্প-বিপ্লবের পর থেকে পৃথিবীজুড়ে বৈদেশিক বাণিজ্য বেড়েছে ৯০০%। আমাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের উপকরণ- সবই উড়ে আসে হাজার হাজার মাইলের ওপার থেকে। ব্যাপারটা এতটাই স্বাভাবিক ধরে নিয়েছি যে, এর প্রত্যক্ষ প্রভাবে, একেকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সুখ-সুবিধার জন্য কত শত টন বর্জ্য অপসারণ করছি প্রকৃতিতে, সেসব বাস্তবতা রয়ে যাচ্ছে আমাদের ঝাঁ চকচকে স্ক্রিনের আড়ালে। যেভাবে মানুষ এই পৃথিবীকে যথেচ্ছা ব্যবহার করে চলেছে, তাকে একমাত্র তুলনা করা চলে রাশিয়ান রোলেটের সাথে। আমাদের সম্মিলিত বন্দুকের নলটি তাক করা আছে এই পৃথিবীর দিকে, এবং একের এক ট্রিগার টিপে চলেছি ধ্বংসের, অথচ ভুলেই যেন গেছি- আমাদের বসবাসের জন্য আছে এই একটিই পৃথিবী। এলন মাস্ক যতই মঙ্গলে পাড়ি দেবার স্বপ্ন দেখাক আমাদের, দাবদাহে পোড়া জলে ডুবে যাওয়া বিষাক্ত বাতাসে ছেয়ে যাওয়া এই নীল গ্রহ ছেড়ে অন্য বিশ্বে পালিয়ে যাবার এখনো ঢের ঢের দেরি। সময় এসেছে কার্ল সাগানের কথাটি বাঁধাই করে রাস্তায় রাস্তায় ঝুলিয়ে দেবার: The Earth is the only world known so far to harbor life. There is nowhere else, at least in the near future, to which our species could migrate. Visti, yes, Settle, not yet. Like it or not, for the moment the Earth is where we make our stand.
জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহার কমানোর জন্য এদেশের সরকারের উপর চাপ দিতে নিয়মিত প্রতিবাদের আয়োজন করছে ‘জাস্ট স্টপ ওয়েল’। বর্তমান পৃথিবীকে সরাসরি ধ্বংসের দিকে তীব্র গতিতে ঠেলে দিচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার- এটি আর কেবল বৈজ্ঞানিক তথ্য হয়ে নেই, পৃথিবী জুড়ে যে তীব্র দাবদাহ, সেটি তার প্রমাণ হয়ে চোখ রাঙাচ্ছে এই মুহূর্তে। এ সংস্থাটি তাদের মেসেজটি কর্তৃপক্ষের কানে পৌঁছে দেবার জন্য বহুদিন ধরেই নানা ধরনের ‘অদ্ভুতুড়ে’ প্রতিবাদের ভাষা ব্যবহার করছে। কখনো মিউজিয়ামে ঢুকে বিখ্যাত কোনো ছবিতে কালি ঢেলে দিচ্ছে, কখনো মোটরওয়েতে ঢুকে সাইনবোর্ডের সাথে নিজেদেরকে বেঁধে রাখছে, কখনো উঁচু ভাস্কর্যে উঠে শ্লোগান দিচ্ছে, ব্যস্ততম নগরীর ব্যস্ততম রাস্তা আটকে বসে থাকছে কখনো কখনো। পত্রিকার পাতার পাঠক কলামে চোখ রাখলে বোঝা যায়, এদের পেছনে সাধারণ মানুষের জনসমর্থনও সেভাবে গড়ে ওঠেনি এখনো। তার চেয়েও ভয়াবহ কথা হচ্ছে, এদের কার্যক্রমের পেছনের কথাগুলো বুঝতে পারছে বলেও মনে হয় না। জাস্ট স্টপ ওয়েলে বেশিরভাগ প্রচার কার্যক্রমই অতি নিরীহ গোছের। এদের কারণে বড়জোর মাঝে মাঝে রাস্তায় ট্রাফিক জমে যায়, আর তাতেই অনেক সাধারণ মানুষ এদের উপরে খাপ্পা। কিন্তু মেঘে মেঘে বেলা যে যায় যায়, তা স্ক্রিন-প্রজন্মের আমরা বুঝতেই পারছিনা যেন। চরম ভোগবাদ এবং পুঁজিবাতের পংক্তিতে ডুবে থাকা আমাদের সেসব নিয়ে ভাবার সুযোগই যেন নেই!
আমেরিকার জীববিজ্ঞানী ইও উনলসন বলেছিলেন: “যদি পৃথিবী থেকে মানুষ অদৃশ্য হয়ে যায়, তবে পৃথিবী দ্রুত তার সেই দশ হাজার বছর আগের প্রাকৃতিক ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় ফিরে যাবে, কিন্তু যদি পৃথিবী থেকে পোকা-মাকড় হারিয়ে যায়, তবে পৃথিবীর পরিবেশ খুব দ্রুত বিশৃঙ্খল অবস্থায় নিপতিত হবে।” সোজা কথায়, যে হারে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বলে খ্যাত আমরা মানুষেরা পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে দিচ্ছি, তাতে মনুষ্য প্রজাতিটি ধ্বংস হয়ে গেলে পৃথিবী যেন হাঁফ ছেড়েই বাঁচবে!
লণ্ডন, ২৭ জুলাই, ২০২৩
লেখক: কথাসাহিত্যিক