গাজীউল হাসান খান ♦
একদিকে ইউরোপের গ্রিস থেকে আটলান্টিকের অপর পারে অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চল সম্প্রতি যখন দাবানলে ভস্মীভূত হচ্ছিল, তখন এশিয়া মহাদেশে ভারত, পাকিস্তান, চীন, থাইল্যাণ্ড এবং এমনকি জাপানের বেশ কিছু অঞ্চলে অতিবৃষ্টির কারণে ভেসে যাচ্ছিল ফসলের জমি। আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকার অনাবৃষ্টি এবং এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে অতিবৃষ্টির কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফসলের মাঠ। এতে নিকট ভবিষ্যতে বিশ্ব খাদ্যঘাটতির বড় এক সংকটে পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ অবস্থায় খাদ্যঘাটতি মোকাবেলায় আফ্রিকা, এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নেতারা রাশিয়া ও ইউক্রেনের দিকে আশা-ভরসা নিয়ে তাকালেও হঠাৎ করে বেঁকে বসলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
গত বছর তুরস্ক ও জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত ইউক্রেনের উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য রপ্তানির চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেন কৃষ্ণ সাগরের তীরবর্তী আরেক দেশ অর্থাৎ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট। তাঁর অভিযোগ হচ্ছে, বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের খাদ্যঘাটতি মোকাবেলায় রাশিয়া যখন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, তখন একের পর এক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে দেশটিকে চরম বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সামরিক জোট চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষের পরিসমাপ্তির পরিবর্তে কিয়েভকে বর্ধিত হারে অস্ত্র সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রজ্বলিত আগুনে আরো ঘৃতাহুতি দিয়ে যাচ্ছে।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত বন্ধ করার লক্ষ্যে উপরোল্লিখিত ঘটনার পরও সম্প্রতি আফ্রিকার দেশগুলোর আনীত শান্তি প্রস্তাব বিবেচনায় আগ্রহী হয়েছেন।
গত ২৭ ও ২৮ জুলাই রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে অনুষ্ঠিত রুশ-আফ্রিকান অর্থনৈতিক ফোরামের শীর্ষ সম্মেলনে প্রায় ৫০টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানসহ উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের বিভিন্ন প্রস্তাবে মতৈক্য প্রকাশ করলেও প্রেসিডেন্ট পুতিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ব্যাপারে তাঁর শর্ত মেনে না নেওয়া পর্যন্ত কৃষ্ণ সাগরের ভেতর দিয়ে ইউক্রেনের আর কোনো খাদ্যশস্য ভর্তি জাহাজ চলাচল করতে দেবেন না বলে জানিয়েছেন। তবে সোমালিয়া, ইরিত্রিয়া, সুদান, মালি, জিম্বাবুয়ে, সেন্ট্রাল আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রসহ ছয়টি দেশের প্রতিটিকে রাশিয়া বিনা মূল্যে ২৫ থেকে ৫০ হাজার টন খাদ্যশস্য সরবরাহ করার ঘোষণা দিয়েছে। এই খাদ্যশস্য আগামী তিন থেকে চার মাসের মধ্যে আফ্রিকার উল্লিখিত দেশগুলোতে পৌঁছে দেওয়া হবে। তা ছাড়া প্রেসিডেন্ট পুতিন আফ্রিকান দেশগুলোতে প্রদত্ত ২৩ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ঋণ মওকুফের ঘোষণা দিয়েছেন, যা তাদের মোট ঋণের প্রায় ৯০ শতাংশ।
এর পাশাপাশি চীনও পৃথকভাবে আফ্রিকার বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে প্রায় ৬০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। মোদ্দাকথা, রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের ভাষায় আফ্রিকাকে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের অব্যাহত শোষণ-শাসন থেকে মুক্ত করতে হবে। আফ্রিকার দেশগুলোকে আর নয়া উপনিবেশ হতে দেওয়া যাবে না এবং পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ক্ষমতার বহুকেন্দ্রিক ভরকেন্দ্র গড়ে তোলা হবে।
বিশ্বে আবারও খাদ্যসংকটের আশঙ্কাসেন্ট পিটার্সবার্গে অনুষ্ঠিত সদ্যঃসমাপ্ত রুশ-আফ্রিকান শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাপোসা ও মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ সিসিসহ বহু রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান। এ ছাড়া আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের অত্যন্ত উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদলও সম্মেলনে যোগ দিয়েছিল।
এবারের সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল করোনা-পরবর্তী আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের অগ্রগতি। যোগাযোগব্যবস্থা বিনির্মাণ, শিল্প-কারখানা স্থাপন, কৃষিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে রেকর্ড পরিমাণ উন্নয়ন। আফ্রিকার নেতাদের মতে, করোনা-পরবর্তী বিশ্বে এখন রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষ তাঁদের অগ্রগতির পথে আরেক নতুন বাধার সৃষ্টি করেছে, অবিলম্বে যার অবসান হওয়া অত্যন্ত জরুরি। সেসব কারণ থেকেই উৎপত্তি হয়েছে নাইজারের অতি সাম্প্রতিক সামরিক অভ্যুত্থান, সেনেগাল ও মালিসহ আফ্রিকার বিভিন্ন রাষ্ট্রে রাজনৈতিক অসন্তোষ ও বিশৃঙ্খলা। আলজেরিয়া, তিউনিশিয়া, লিবিয়াসহ উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে উঠেছে উপনিবেশবাদী ফ্রান্সের সম্পূর্ণ বিতাড়নের দাবি। কেনিয়া, ঘানা, ইথিওপিয়াসহ আফ্রিকার বিভিন্ন রাষ্ট্রের উন্নয়নপ্রক্রিয়ার উত্তরোত্তর অগ্রযাত্রায় এখন রাশিয়া, চীন, তুরস্ক ও ইরানের সহযোগিতা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। আফ্রিকার দেশগুলোর নেতাদের বক্তব্য হচ্ছে আফ্রিকা দরিদ্র নয়। সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী দেশগুলোই বিভিন্ন ষড়যন্ত্র ও শোষণ-শাসনের মধ্য দিয়ে আফ্রিকাকে পেছনে ফেলে রেখেছে। অথচ বিভিন্ন খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকে আফ্রিকা এখনো বিশ্বের শীর্ষস্থানীয়। দিনে দিনে তারা দুর্বল থেকে দুর্বলতর এবং দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হচ্ছে। সম্পদ ও জনশক্তি থাকা সত্ত্বেও এখনো অন্ধকারাচ্ছন্ন। ক্রমে ক্রমে এখন জেগে উঠছে আফ্রিকা। তাই সাবেক উপনিবেশবাদী কিংবা সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিকে বাদ দিয়ে এখন তারা দ্রুত উন্নয়ন, উৎপাদন, বিনিয়োগ এবং রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য হাত বাড়াচ্ছে চীন, রাশিয়া, তুরস্ক ও ইরানের দিকে। উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের তাঁবেদারদের একে একে সরাচ্ছে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে। কায়েম করতে তৎপর হয়েছে জনসমর্থিত সরকারের, যারা অপশাসন কিংবা শোষণ নয়, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে হাঁটবে আপসহীনভাবে। সে কারণেই এখন দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে আফ্রিকার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক দৃশ্যপট। ঠিক সে সময়েই এবার সেন্ট পিটার্সবার্গে অনুষ্ঠিত হয়েছে রুশ-আফ্রিকান অর্থনৈতিক ফোরামের শীর্ষ সম্মেলন। এতে আফ্রিকাকে সার্বিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতার প্রত্যয় ঘোষণা করেছে রাশিয়া। এগিয়ে এসেছে চীন এবং সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে তুরস্ক ও সৌদি আরব।
এ অবস্থায় সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্র তার পরাশক্তিগত আধিপত্যকে ধরে রাখার জন্য ইউক্রেন সংঘর্ষের পরিসমাপ্তি কিংবা শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াকে কার্যকর না করে সংঘাতকে আরো দীর্ঘস্থায়ী করে বিশ্বশান্তিকে বিপন্ন করে তুলছে। পরিবেশগত ধ্বংসলীলা থেকে বিশ্বকে প্রতিরক্ষার চেয়ে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার থেকে শুরু করে সামরিক দিক থেকে অস্থির করে তোলার চেষ্টা করছে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলকে। রাশিয়া, চীন ও তুরস্ক সে প্রক্রিয়ার গতি রোধ করার জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিচ্ছে, কিন্তু তা কোনোমতেই সহজসাধ্য হচ্ছে না। কারণ সাম্রাজ্যবাদ কিংবা নয়া উপনিবেশবাদীদের বিদায়ঘণ্টা বাজলেও তারা তাদের কায়েমি স্বার্থকে ধরে রাখার জন্য প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন কৌশল গ্রহণ করছে। একদিকে তারা চায় কৃষ্ণ সাগর ও বসফরাস প্রণালির মধ্য দিয়ে ইউক্রেন তার উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকায় ছড়িয়ে দিক; অন্যদিকে রাশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ দিয়ে নিজের আধিপত্য ধরে রাখতে দ্বিধা করছে না মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। এ অবস্থার অবসানের জন্য রাশিয়া কৃষ্ণ সাগর দিয়ে ইউক্রেনের জাহাজ ভর্তি খাদ্যশস্য চলাচল বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রকে তার অর্থনৈতিক অবরোধ উঠিয়ে নিতে হবে। এতে রাশিয়াসহ বিশ্ববাসী আবার মুক্তবাজার, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ পাবে। তা না হলে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের তাঁবেদার গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে রুখে দাঁড়াতে বাধ্য হবে। তেমন একটি সময় এখন বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থিত হয়েছে। কৃষ্ণ সাগর দিয়ে ইউক্রেনের খাদ্যশস্য সরবরাহে সম্পাদিত চুক্তিকে আবার সচল করার জন্য তুরস্ক ও জাতিসংঘ রাশিয়ার সঙ্গে নতুন করে উদ্যোগ নিচ্ছে। কিন্তু কোনো কিছুই একতরফা নয়। রাশিয়ার বক্তব্য অগ্রাহ্য করার মতো নয়। বর্তমান বিশ্বমন্দার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের ভবিষ্যৎ খাদ্যসংকট মোকাবেলার বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে আফ্রিকার মতো মহাদেশে খাদ্যের অভাবে মৃত্যুবরণ করবে অগণিত মানুষ। সেদিকে দৃষ্টি রেখেই অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষের অবসান ঘটাতে হবে এবং ইতি টানতে হবে ক্রমাগত অর্থনৈতিক অবরোধ জারির বিষয়টিতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যদি সে পথে হাঁটতে রাজি না হন, তাহলে তাঁকে বাধ্য করতে হবে।
এখন সময় এসেছে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এবং ঐক্যবদ্ধভাবেই সব অপশক্তিকে রোধ করতে হবে। তা না হলে বর্তমান রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষকে কেন্দ্র করেই জো বাইডেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো একটি ধ্বংসাত্মক বিষয়ের সূত্রপাত করতে দ্বিধা বোধ করবেন না। কিন্তু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ভুলে গেলে চলবে না যে তারা যেমন ভিয়েতনাম ও আফগানিস্তানের মতো দেশের মানুষের বিরুদ্ধে তাদের অন্যায় আক্রমণে সাফল্যের দুয়ারে পৌঁছাতে পারেনি, তেমনি ইউক্রেনকেও তারা এগিয়ে নিতে ব্যর্থ হবে। সংঘাত কিংবা যুদ্ধ কোনো সমস্যার স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। শান্তিকামী মানুষের চূড়ান্ত লড়াই অবশ্যই একদিন সাফল্যের মুখ দেখবে। সে কারণেই বিশ্বের অন্যতম প্রধান পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রকে সময় থাকতে বিষয়টি উপলব্ধি করতে হবে এবং বিশ্বমানবতার মুক্তি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নিজ থেকেই এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক: বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক