সৈয়দ তোশারফ আলী ♦
আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে মার্কিন ভিসানীতি, এই সময়ের প্রধান আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অন্যসব বিষয় থেকে মুখ ফিরিয়ে কেবল এই ইস্যুটি নিয়েই আলোচনা-পর্যালোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। আন্দোলন যারা করছে তাদের লক্ষ্য ভোটাধিকার অর্জন ও স্বচ্ছ, সুন্দর নির্বাচন। সেই নির্বাচনে যাতে বাংলাদেশের নির্বাচকমণ্ডলী সরকার গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে তার নিশ্চয়তা চাইছে আমাদের উন্নয়নের অংশিদার বন্ধুরাষ্ট্রসমূহ। কিন্তু সরকার স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বললেও প্রতিপক্ষ তাকে আস্থায় নিতে পারছে না। কারণ, তারা অতীতে ক্ষমতাসীন কোন দলীয় সরকারের অধীনে স্বচ্ছ নির্বাচন হতে দেখেনি। এক্ষেত্রে তিনটি বিষয় একসূত্রে গাঁথা। এই তিনটি বিষয় হলো, ভোটাধিকার অর্জন, স্বচ্ছ নির্বাচন এবং গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন। আর এজন্যই আগামী নির্বাচন যাতে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের মত প্রহসনে পরিণত না হয়, সেজন্য নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি জোরালো থেকে জোরালোতর হচ্ছে।
কিন্তু একবার কোন ব্যবস্থা পরিত্যাক্ত হলে তা ফিরিয়ে আনা কঠিন হয়ে পড়ে। এজন্য প্রয়োজন হয় নতুন ফর্মূলা। কিন্তু সরকারী ও বিরোধী রাজনীতিতে সেই উদ্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস এবং অন্যান্য মার্কিন কূটনীতিকদের মধ্যে ডোনাণ্ড ল্যু ও ওজরা জেয়া অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ যাতে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে, তার জন্য কূটনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে যাচ্ছেন। জনগণ স্বাধীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ পেলে, তখনই কেবল নির্বাচিত সরকার গঠিত হবে, যার আইনগত ও নৈতিক বৈধতা থাকবে। তাই অর্থবহ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে যথেষ্ট মাথা ঘামাতে হচ্ছে। একদা মার্কিন নীতি নির্ধারণে জন ফস্টার ডালেস-এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কথা আমরা জানি। শান্তির জন্য যুদ্ধ প্রয়োজন, তিনি ছিলেন এই নীতির প্রবক্তা। ওয়ার অর পিস নামে তিনি একটি বই লিখে তাঁর তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে তিনি একবার আলাপকালে প্রশ্ন করেছিলেন, গণতন্ত্র ও কমিউনিজমের মধ্যে আপনি কোনটি পছন্দ করেন। ডালেস আশা করেছিলেন, নেহরু সাদাকে সাদা এবং কালাকে কালা বলবেন। কিন্তু নেহরু তাঁর প্রশ্নের সরাসরি জবাব দেননি। জোসেফ স্ট্যালিনের সঙ্গে ছিল তাঁর বন্ধুত্ব।
তবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতিও ছিল তাঁর অকৃত্রিম শ্রদ্ধা। আর যাই হোন, তিনি বিপ্লববাদী ছিলেন না। তিনি গণতন্ত্রের পথে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ চেয়েছিলেন। এই সমন্বয়ের চিন্তা তাঁকে দ্বিধাগ্রস্ত করে রেখেছিল। ডালেস তাঁকে ভুল বুঝেছিলেন এবং ক্ষেদের সঙ্গে মন্তব্য করেছিলেন, “আমি স্ট্যালিনকে বুঝি কিন্তু নেহরু আমার কাছে দুর্বোধ্য।” এখন পরিস্থিতি অনেক বদলেছে, ভলগা, গঙ্গা, পদ্মা, ইয়াংসি দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। স্নায়ু যুদ্ধ, ঠাণ্ডা যুদ্ধ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা হতো দুই পরাশক্তির ভেরতকার দ্বন্দ্ব বোঝাতে। আশির দশকে এসে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার অভ্যন্তরীণ সংকট আর আড়াল করতে পারেনি। পেরেস্ত্রোইকা (পুনর্গঠন) গ্লাসনস্ত (স্বচ্ছতা) প্রভৃতি সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিয়েও সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে ব্যর্থ হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। শেষ পর্যন্ত ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যায়। এমন কি বার্লিন দেওয়ালও উঠে যায়। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে শক্তির ভারসাম্য বদলে যায়। অন্যদিকে ১৯৭০ সালে মার্কিন-চীন সম্পর্কের নতুন যাত্রা শুরু হয়। সেই সম্পর্কের সূত্র ধরে চীন তার দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা কাজে লাগিয়ে পশ্চিমা পুঁজিকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। বর্তমানে চীনের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ হতে চলেছে। একাত্তরে রুশ-ভারত অক্ষ শক্তির সমর্থনে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
তারপর এর অগ্রযাত্রা নানা উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলেছে। আদর্শিক প্রশ্নে বাংলাদেশ গণতন্ত্রের প্রশ্নে দ্ব্যর্থহীন আনুগত্য দেখাতে না পরার কারণে পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে দোলাচল মনোভাব দেখা গেছে বরাবর। অথচ গণতন্ত্রের আশীর্বাদ ভোগ করার আশায় যে বাংলাদেশ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সামিল হয়েছিল সেই বাংলাদেশকে আজ ভোটাধিকার অর্জনের জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনকে অবাধ ও নিরপেক্ষ করার জন্য গণতান্ত্রিক বিশ্বের সাহায্যের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতকে প্রতিবেশী ও পরীক্ষিত বন্ধু হিসেবে পেয়েও বাংলাদেশ গণতন্ত্রের চর্চায় তার সমকক্ষ হতে পারেনি বা হতে চায়নি। কেবল গণতন্ত্রের প্রশ্নেই নয়, তিস্তার পানির দাবিও ভারত কানে তুলছে না। উপরন্তু সিকিমে তিস্তার উৎসমুখ থেকে ১১টি পয়েন্টে ড্যাম ও ব্যারেজ-এর মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করা হয়েছে। সাম্প্রতিক অতিবৃষ্টির কারণে তাদের বাঁধ ভেঙ্গে সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। আর তাই তারা ড্যাম ও ব্যারেজের গেট খুলে পানি ছেড়ে দিয়েছে।
যে কারণে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ৫টি জেলায় বন্যায় বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ ব্যাপারে যা করার ছিল তা আমরা ভারতের বিরোধিতার কারণে করতে পারিনি। অথচ তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরু করতে পারলে এতোদিনে তা শেষ হয়ে যেতো। ভারত-চীন বিরোধের বলি হচ্ছি আমরা। ভারতের সুবিধার জন্য আমরা সব করেছি- নর্থ ইস্টে যাবার জন্য ট্রানজিট সুবিধা দিয়েছি, করিডোর দিয়েছি, ট্রান্সশিপমেন্ট করতে দিয়েছি। এর বিপরীতে আমাদের ব্যবসায়ীদের দাবি ছিল নেপাল-ভুটানে যাবার জন্য বাংলাদেশকে করিডোর সুবিধা দেয়া হোক, কিন্তু ভারত তা দিতে নারাজ। তারপরও সারদীয় দূর্গা পূজা উপলক্ষে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ৫ হাজার টন ইলিশ ভারতে পাঠানো হয়েছে! বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এই ধরনের এক তরফা বন্ধুত্ব ভাল চোখে দেখছে না। অন্যদিকে এই সময়ে প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের নেতৃত্বে রুশ ফেডারেশন ইউক্রেনে আগ্রাসন চালিয়ে বিশ্বরাজনীতিতে এক নতুন বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। সেখানে ন্যাটো জোট ও আমেরিকার সহযোগিতা না থাকলে ইউক্রেন এতোদিনে ধুলায় মিশে যেতো। রুশ আগ্রাসনে ইউক্রেন যেমন বিধ্বস্ত হচ্ছে তেমনি ইউরোপের দেশগুলোও গ্যাস ও জ্বালানি সমস্যা মোকাবিলা করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। এই মুহূর্তে যুক্তরাজ্যে ৬.৭ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি বিরাজ করছে। এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলোও মারাত্মক সংকটে পড়েছে।
এই পটভূমিতে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন আসন্ন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণ যদি তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে সরকার গঠন করতে না পারে, তাহলে সরকার কেন জনগণের কথা শুনবে। কেন তাদের জীবন-জীবিকার সমস্যা দূর করবে। কেন দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করবে? কেন সিণ্ডিকেটের হাত থেকে জনস্বার্থ রক্ষা করবে? কেন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে? কেন স্বাস্থ্য-চিকিৎসা সুবিধা জনগণের জন্য সহজ প্রাপ্য করবে! ভোটাধিকার না থাকলে জনগণের কাছে সরকারের জবাবদিহিতা থাকে না। তখন সরকার হয় বিদেশের পুতুল, আমলাদের ক্রীড়নক, ধনিক-বনিক শ্রেণীর স্বার্থের রক্ষক। জনবিচ্ছিন্ন সরকার দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ঋণ খেলাপি ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, এ সত্য এতোদিনে প্রমাণিত হয়েছে। আশার কথা যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং মার্কিন কূটনীতিকরা বাংলাদেশকে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনতে নিজেদের চোখ দিয়ে বাংলাদেশকে দেখছেন। তাদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক আশা-আকাঙক্ষা এক ও অভিন্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। তবে দূরবর্তী দেশ হিসেবে তাদেরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিরোধী রাজনীতির দুর্বলতাও তাদের অজানা নয়।
দুই শক্তিধর প্রতিবেশীর মাঝখানে বাংলাদেশকে গণতন্ত্রের অভিযাত্রী করা সহজ ব্যাপার নয়। দুর্নীতির বিস্তার ঘটায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী নীতি আদর্শ থেকে বহু যোজন দূরে সরে গেছে। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ দুর্বল। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও স্বকীয় সত্তা হারিয়ে ফেলেছে। এই অবস্থায় শাসকদলের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নেতা-কর্মীরা দূরদর্শীতার পরিচয় দিলে গণতন্ত্রে উত্তরণ সহজতর হতে পারে, নতুবা পরস্পরবিরোধী শক্তির যে টানা-পোড়েন চলছে তাতে এমন লব্ধি হতে পারে, যা দু’পক্ষের ভাবনার অতীত। প্রতিবেশী যে কোন দেশের গুরুত্ব আমরা বুঝি কিন্তু তাই বলে আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে ছাড় দিতে পারি না। যে যা-ই বলুন, গণতন্ত্র ছাড়া আমাদের স্বাধীনতা অর্থবহ হতে পারে না। তাই আমাদের ভোটাধিকার ফিরে পেতে হবে। রাজনীতিকে ফিরিয়ে আনতে হবে গণতান্ত্রিক পথে। আমাদের দেশের নর-নারীকে তাদের ইচ্ছা ও চাহিদা অনুযায়ী নির্বাচন ও সরকার গঠন করার সুযোগ দিতে হবে। আমরা জানি, এদেশের ছোট বড় কোন দলই গণতন্ত্র চর্চা করে না।
কেউ দলীয় শীর্য পদ ছাড়তে চায় না। গণতন্ত্রের প্রবক্তা নেতারাও না। দলের ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা থাকলে দেশের ভেতরেও গণতন্ত্রের চর্চা থাকতো। নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণ থাকলে মানুষ কথা বলবে, দাবি জানাবে, বেকার যুবকরা চাকরি চাইবে, যারা কম মজুরিতে কাজ করছে তারা বেতন বাড়ানোর দাবি তুলবে, সাধারণ মানুষ দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য সোচ্চার হবে, মিছিল, মিটিং, বিক্ষোভ করবে, দুর্নীতির প্রতিকার চাইবে, তখন শাসকশ্রেণীর উপর চাপ সৃষ্টি হবে। চাটুকারদের ফুরফুরে মেজাজে থাকবার দিন শেষ হবে। এখন নীরব থাকলে আগামীতে আরও বেশি অত্যাচার-অবিচার মুখ বুজে সহ্য করে যেতে হবে। দেশের অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাবে। জনগণ কোন সমস্যারই প্রতিকার পাবে না। আমাদের দেশে ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়ম নিয়ে অনেক কথা শোনা যায়, কিন্তু ব্যবস্থা গ্রহণের উদাহরণ বিরল। তবে জনগণ ভোটাধিকার অর্জন করতে সক্ষম হলে দৃশ্যপট বদলাতে শুরু করবে, এমনই আশা করা হচ্ছে। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং আইনের শাসনের আশীর্বাদ ভোগ করার জন্যই প্রয়োজন গণতান্ত্রিক শাসন।
লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক রোববার, সাবেক সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক