লন্ডনের চিঠি
সাগর রহমান ♦
টানা বৃষ্টি হচ্ছে কয়েকদিন ধরে। সূর্যের দেখা নেই অবশ্য অনেকদিনই। যেদিন বৃষ্টি হয় না, সেদিনও কেমন ঘোলাটে আকাশ। সবকিছু কেমন স্যাঁতস্যাঁতে, ভেজা-ভেজা। আর এখানকার বৃষ্টির ধরণটাই বিরক্তিকর। কেমন যেন অনাহুত অনাকাংখিত অতিথির চলন-বলন এর সমস্ত চলনে, মুখ এবং মুখোশ দুই-ই মুখ ভেংচাচ্ছে যেন সারাক্ষণ। পথচারীদের দূর্ভোগ বাড়ানোই এর একমাত্র লক্ষ্য যেন। কথাগুলো আমার এক বন্ধুর কাছে ব্যাখ্যা করে বলতেই বন্ধুটি আমার নষ্টালজিক প্রবৃত্তির প্রতি ইঙ্গিত করে বললেন, ওটা তোমার বাংলাদেশের বৃষ্টি বিষয়ে রোমান্টিকতা হেতু বৃটিশ বৃষ্টিকে হেয় করে দেখার মানসিকতার বহি:প্রকাশ। ব্যাপারটা নিয়ে তারপর আমি ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে বসলাম। আসলেই কি তাই!
আমি কি আসলেই এক চক্ষু আচরণ করছি ব্রিটিশ বৃষ্টির প্রতি? বাংলাদেশে বৃষ্টি নামলে গ্রামের উঠোনে উঠোনে, কিংবা শহরের ছাদে ছাদে ভিজতে নামার যে আনন্দ – সে আনন্দ চেখে দেখা, এবং চেয়ে দেখা হতে বঞ্চিত হয়ে আছি বহু বছর – এ কথা ভাবতেই কেমন বড় সড় দীর্ঘশ্বাস পড়তে শুরু করে নিজের অজান্তে। মনে আছে একদিন টিএসসিতে সারা বিকেল আড্ডা মারছিলাম। এদিকে ঝুম বৃষ্টি নেমে গেছে। আমার আবৃত্তি গ্রুপের সপ্তাহ খানেক পরেই একটি বড়-সড় আবৃত্তি অনুষ্ঠান। তার আয়োজন এবং রিহার্সেল নিয়ে বিকেল গড়িয়ে অনেক রাত করে ফেলেছি। তারপর চা আর ছোলা-মুড়ি খেয়ে বাড়ির পথ ধরার সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পালা হলেও বৃষ্টির ধরে আসার নাম পর্যন্ত নেই। অঝোরে ঝরছে তো ঝরছেই। এসব দিনে যা হয়, কোন রিকশা-গাড়ি কিছুই পাওয়া যায় না। দুয়েকটা যদি রাজি হয়ও, যে দাম ওরা চায়, সেটি দেবার সার্মথ্য আমাদের ছিল না। অগত্য আমার তিন বন্ধু রাস্তায় নামলাম। গন্তব্য টিএসসি থেকে শাহবাগ মোড়। সেখান থেকে বাসে করে ফার্মগেট। সাথে ছাতা বয়ে বেড়ানোর কথাই আসে না। ঝপঝপানো বৃষ্টির মধ্যেই গান ধরতে ধরতে রাস্তায় নেমে গেলাম। রাস্তা-ঘাট পুরোপুরি ফাঁকা। মাঝে মাঝে দুয়েকটা গাড়ি। শাহবাগ মোড় পর্যন্ত আসতে পুরো গোসল হয়ে গেলো। ওখানে এসে দেখি, বাসও নেই। রাস্তার পাশের ঝুপড়ি দোকানপাট সব বন্ধ। সাধারণত এত তাড়াতাড়ি এসব দোকানপাট বন্ধ হয় না। কিন্তু বৃষ্টির তোড়ে শহর ভেসে যাওয়ার দশা। তাই রাত নয়টা-দশটাতেই মধ্যরাত নেমে গেছে ঢাকা শহরে। অগত্যা আমার ঠিক করলাম – হাঁটা ধরবো, যা থাকে কপালে। যে ভাবা সেই কাজ। আবারও অনুরোধের আসর গাইতে গাইতে পথ চলা। এদিকে আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরেই যাচ্ছে, সে বৃষ্টি জমা হয়ে গেছে রাস্তার নানান জায়গায়। আমার তার মধ্য দিয়েই চলেছি। হাঁটছি তো হাঁটছি। হাঁটতে হাঁটতে ফার্মগেট পৌঁছালাম এক সময়। আমাকে যেতে হবে নাখালপাড়া। অন্য দুজনের পথ ফার্মগেট থেকে আলাদা হয়ে দুদিকে। কিন্তু ফার্মগেট পৌঁছে দেখি – অবস্থা ভয়ানক সংগীন। ফার্মগেট থেকে নাখালপাড়া রাস্তায় বন্যার পানির মতো কোমর অব্দি জল। নিয়নের আলোতে তাতে রীতিমত ঝিকমিক করে ঢেউ খেলছে। আমার দুই বন্ধুকে প্রস্তাব দিলাম আমার সাথে বাসায় আসতে। খিচুড়ি রেঁধে খাওয়ানোর প্রস্তাব দিতেই দুজনেই রাজি। সেই প্রায় মাঝরাত্রিতে কোমর সমান জল ভেঙে আমার তিন বন্ধু এবারে হাঁটতে শুরু করেছি নাখাল পাড়া উদ্দেশ্যে। খানা-খন্দে পড়ে যাওয়ার ভয়, রাস্তার উপচানো ময়লা মেখে ফেলার ভয়-ডর বাদ দিয়ে নিজেদেরকে কোনো হরর সিনেমার জলভূত-মূর্তি কল্পনা করতে করতে হাঁটছি তো হাঁটছিই, এদিকে আকাশভাঙা বৃষ্টি ঝরছে তো ঝরছেই…।
আমি স্টেশানে দাঁড়িয়ে, বাইরের বিচ্ছিরি বৃষ্টিতে চোখ রেখে এমন আনমনে ফেলে আসা ঢাকা শহরের এই জাদুকরী স্মৃতিটির কথা ভেবেই যাচ্ছিলাম যে কখন এদিকে বৃষ্টি থেমে গেছে – টেরই পাইনি। টের পেলাম হুড়মুড় করে লোকজনের এক সংগে রাস্তায় নেমে পড়াতে। এদেশে এত বছর আছি, আমি হলফ করে বলতে পারি, আজ পর্যন্ত কাউকে স্রেফ শখের বশে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বৃষ্টিতে মাখতে দেখিনি আমি! যে বৃষ্টিতে কেউ শখ করে ভিজতে নামে না, তাকে অনাহুত আর অনাকাংখিত বলতে কোনো দোষ কোথায়!
আজ অবশ্য আমি অন্য অভিজ্ঞতার কথা বলতে বসেছিলাম। কিন্তু বৃষ্টির কথা উঠতেই অন্যমনা হয়ে ঐ স্মৃতি চারনের প্রসংগ। যাই হোক, মূল কথাটিতে যাই এবার। ফিরছি লন্ডনের বাইরে, এসেক্স কাউন্টির একটি গ্রামের ভেতরে প্রতিষ্ঠিত একটি এক্টিভিটি সেন্টার হতে। আজ ছিল আমাদের শিক্ষকদের ‘টিম বিল্ডিং‘ কর্মশালা। নানান স্কুল থেকে আমার মতো বেশ কয়েকজন শিক্ষকদের ওখানে আমন্ত্রণ করে আনা হয়েছে যারা পরস্পর পরস্পরের অপরিচিত। সবাই এক সংগে হতেই আমাদেরকে কয়েকটি দলে ভাগ করে দেওয়া হলো। নারী-পুরুষ মিলিয়ে প্রতি দলে ছয় জন করে তিনটি গ্রুপ। আগেই বলে দেওয়া হয়েছিল আমরা যেন ‘ওয়েদার এপ্রোপিয়েট‘ জামা-কাপড় পরে যাই। আমার ‘বাংগাল স্বভাব‘ এখনও জাগ্রত বলে এসব সর্তকবার্তা খুব একটা গায়ে মাখিনি। যেহেতু সকালে স্কুলে যেতে হয়েছে স্কুলে ধরা-চূড়া পরে, অতিরিক্ত জামা কাপড় টানার ইচ্ছে হয়নি আমার। সেন্টারে পৌঁছে প্রমাদ গুনতে হলো। জানানো হলো, এক্টিভিটি যা হবার, সব হবে মাঠে, মাঠের পাশে জংগলার এপাশে ওপাশে। বাইরে তাকিয়ে দেখি ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। অবস্থা এমন যে ওয়েদার এপ্রোপিয়েট কাপড় আনিনি বলে কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ বন্ধ করার প্রশ্নই আসে না। অতএব যে অবস্থায় ছিলাম, সেই কোট-টাই-ওভারকোট – সেসব নিয়েই তৈরি হয়ে গেলাম। পরবর্তী আধাঘন্টা নানান ধরনের ‘বাচ্চা-সুলভ‘ কর্মকান্ড করতে হলো আমাদের। প্রতি দলে একজন মুখপাত্র ঠিক করে দিয়ে, সেই মুখপাত্র বাদে বাকি আমাদের সবার চোখে কালো কাপড়ের পট্টি বেঁধে বলা হলো – মুখপাত্রের মৌখিক নির্দেশ পালন করতে করতে সামনে হাঁটা শুরু করতে হবে। মাথার উপরে বৃষ্টি হচ্ছে। এদিকে ফিনফিনে ঠা-াতো আছেই। তারওপর দমকা বাতাসের আঁচ পাওয়া যাচ্ছে (এখানে এখন ঝড় ‘কিরণ (খুব সম্ভবত উচ্চারণটা এ ধরনের হবে)‘ বইছে গত দুদিন ধরে। তো সেই বৃষ্টি এবং ঠাণ্ডা এবং বাতাস উপেক্ষা করে, চোখে কালো কাপড়ের অন্ধত্ব বরণ করে শুরু হলো আমাদের মাঠের দিকে যাত্রা। আমাদের দলের মুখপাত্র একটু পর পর সর্তকবাণী উচ্চারণ করছে, খানিকটা ডানে, ওপাশটাতে কাদা, বামে সরো, আরে বামে, ওদিকটাতে জল জমে আছে, দুই ফুট সামনে একটা ছোট গর্ত…। তার ধারাবিবরণী শুনতে শুনতে আমরা দলের অন্য সদস্যরা একে অপরের হাত ধরে ধরে এগিয়ে যাচ্ছি তো যাচ্ছিই। অবশেষে মিনেট পাঁচেক হাঁটার পর এক জায়গায় আমাদের থামতে বলা হলো, এবং চোখের পট্টি খোলার অনুমতি দেওয়া হলো। চোখ খুলে দেখি মাঠের মাঝখানে বেশ জংলা ঘেরা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি, পায়ের নিচে ঘাস, কোথাও কোথাও সামান্য কাদা।
সে জায়গায় পৌঁছার পর আমাদেরকে একের পর এক আরো নানা ধরনের কর্মকাণ্ড (দলবদ্ধ চ্যালেঞ্জ) মোকাবেলা করতে হলো, যা – সত্যি বলতে, আবহাওয়া অতটা বৈরি না হলে হয়তো বেশ উপভোগ্যই হতো। একদল নানা বয়সী শিক্ষক-শিক্ষিকা জলে-কাদায় নানা ধরনের ক্রীড়া করছে – পিছলা খেয়ে গড়িয়ে পড়ছে, তাকে তুলতে গিয়ে অন্যজন পড়ে যাচ্ছে – এমনতর দৃশ্য দেখার মধ্যেও একটা ছেলেমানুষি সুলভ আনন্দ আছে। যাই হোক, অবশেষে প্রায় দেড় ঘন্টা এসব করার পর আমাদেরকে একটু ভদ্রস্থ হবার সুযোগ দেওয়া হলো। তারপর পুরো আয়োজনের যে প্রধান সমন্বয়ক, একজন ব্রিটিশ শিক্ষিকা, আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন, আজকের এই সব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমি আপনাদেরকে এ কথাটি মনে করিয়ে দিতে চাই যে, আপনাদের হাইস্কুলে যেসব বাচ্চারা পড়তে আসে, ইয়ার সেভেনে, তারা ঠিক এরকমই অপরিচিত জায়গায় অপরিচিত মানুষের ভীড়ে এসে উপস্থিত হয়। প্রথম কিছুদিন তারা অন্ধের মতোই – উদভ্রান্ত অবস্থায় – আপনাদের বিশাল স্কুলের বাউন্ডারিতে ঘোরাফেরা করে, নিজেদেরকে প্রায়ই তাদের অজানা দ্বীপে দ্বীপান্তরিত বলে মনে হয়, ঠিক কী করে উঠবে, কীভাবে নিজেকে খাপ খাওয়াবে, কী করলে দৈনন্দিন সহজ হয়ে উঠবে – সেটা বুঝতে পারে না। আমি আশাকরি, আজকে অভিজ্ঞতা থেকে আপনারা ঐ নতুন শিক্ষার্থীদেরকে পড়ানোর সময় তাদের মানসিক চ্যালেঞ্জগুলোর কথা ভাববেন, তাদের জন্য শিক্ষাকার্যক্রম ঠিক করার সময় তাদের প্রতিবন্ধকতাগুলো মাথায় রাখবেন…”
আমার চুল ভেজা, সেগুলোকে টিস্যুতে শুকিয়ে তোলার এবং ভেজা কাপড়ের ঠাণ্ডা হজম করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে মনে মনে আজকের পুরো আয়োজনকে এতক্ষণ শাপ-শাপান্ত করছিলাম, কিন্তু ভদ্রমহিলার বক্তৃতায় রীতিমত নড়ে-চড়ে বসলাম। মনে হলো, হায় খোদা! তাইতো। হাইস্কুলে বাচ্চারা যখন ইয়ার সেভেনে এসে ভর্তি হয় আমাদের কাছে, তাদের কথা তো ঠিক এভাবে, এই দৃষ্টিকোণ থেকে ভেবে দেখিনি কখনো। ভদ্রমহিলা বক্তৃতা দীর্ঘায়িত করলেন না, বাচ্চাদের কী ধরনের প্রতিবন্ধকতা বা চ্যালেঞ্জ – সে বিচার আমাদের সুবিবেচনা এবং ভাবনার অবকাশের জন্য ছেড়ে দিয়ে বাসার ফেরার অনুমতি দিয়ে দিলেন। এদেশের বাচ্চাদের শিক্ষা অর্জনের পদ্ধতি, তার সুবিধা এবং অসুবিধাগুলো নিয়ে এই যে গভীরতর এবং মৌলিক ভাবনা, এবং সে ভাবনাগুলোকে বাস্তবায়নের জন্য বাচ্চাদের শিক্ষকদেরকে আগে সে সব বিষয়ে শিক্ষিত করে তোলার যে ব্যাপারটা – যত দিন যাচ্ছে, ততই আমাকে মুগ্ধতর করে তুলছে। শীতে কাঁপছি যদিও, মাথার রাজ্যের চমকপ্রদ ভাবনা নিয়ে ট্র্রেন ধরে এখন স্টেশানে, আর বাইরে মুখ বের করতেই সেই ফের বৃষ্টির কবলে। বৃষ্টি দেখতেই হঠাৎ ঐ শুরুর স্মৃতিছবি। যাই হোক, বৃষ্টি থেমেছে আপাতত। বেরুবো, ফোনে ‘টুইট‘ করে নোটিফিকেশান। খুলে দেখি, এক বন্ধু মেসেঞ্জারে একটি ভিডিও শেয়ার করেছে। ঢাকায় স্কুল শিক্ষার্থীদের বাবা-মায়েরা নতুন শিক্ষা-পদ্ধতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন। একজন মা সাংবাদিকদের বাড়িয়ে ধরা মাইক্রোফোনে বেশ রাগতস্বরে বলছেন, “এই সব ডিমভাজি আলুভাজি শেখার জন্য আমরা বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে চাই না…। “ইন্টারেস্টিং!
লণ্ডন, ০১ নভেম্বর, ২০২৩
লেখক: কথা সাহিত্যিক