গাজীউল হাসান খান ♦
ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের বিগত ৭৬ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের সিনেট নেতা চার্লস সুমার দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে বলেছেন। এটি কি একটি নির্দেশ, না অনুরোধ? আর যা-ই হোক, নেতানিয়াহু একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। অপরদিকে সুমার যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠ ডেমোক্রেটিক দলের নেতা। এখানে প্রটোকল বা রাষ্ট্রীয় নিয়ম-কানুনের কথা বলছি না, বলছি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সম্প্রতি বহুবার ইসরায়েলের কট্টরপন্থী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করতে অনুরোধ জানিয়েছেন। পরামর্শ দিয়েছেন অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে ইসরায়েলে নতুন করে নির্বাচন দিতে। জো বাইডেনসহ বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা ও জনগণের মতে, ইহুদিবাদী ও কট্টরপন্থী রাজনীতিক নেতানিয়াহুর পক্ষে বর্তমান গাজা সমস্যার সমাধান দেওয়া সম্ভব নয়। কোনো মানবিক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে গাজার বুভুক্ষু মানুষকে পর্যাপ্তভাবে খাদ্য ও অন্যান্য ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিতেও নারাজ নেতানিয়াহু। অথচ এরই মধ্যে শিশু ও নারীসহ গাজায় মৃত্যুর সংখ্যা ৩২ হাজার ছুঁই ছুঁই করছে।
হামাসের বিরুদ্ধে বিগত সাড়ে পাঁচ মাসের যুদ্ধে ইসরায়েলের কোথাও কেউ তাদের সেনাবাহিনীর বিজয় দেখতে পায়নি। সারা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ এখন ইসরায়েলের বর্তমান সামরিক অভিযান এবং নেতানিয়াহুর নেতৃত্বের বিরুদ্ধে চলে গেছে। এমনকি ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদিরাও। তারা এই মুহূর্তে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পক্ষে এবং কট্টরপন্থী নেতানিয়াহুর নেতৃত্বের সম্পূর্ণ বিরোধী।
ইসরায়েল স্থায়ী যুদ্ধবিরতি ঘোষণাসহ হামাস এবং অন্যান্য প্রতিরোধ যোদ্ধার দাবি না মানা পর্যন্ত তারা কোনো ইসরায়েলি বন্দিদের মুক্তি দেবে না বলে প্রথম থেকেই বলে আসছে। তা ছাড়া প্রতিরোধ যোদ্ধারা এখন তিন পর্যায়ে বা স্তরে গাজা থেকে সম্পূর্ণ ইসরায়েলি বাহিনীর প্রত্যাহারের দাবি করেছে। নতুবা ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের কোনো আপস-নিষ্পত্তির প্রশ্নই ওঠে না বলে তারা জানিয়েছে। প্রতিরোধ আন্দোলনের মূলশক্তি হামাস ছাড়াও ইসলামী জিহাদ এবং অন্যরা ঘোষণা করেছে যে গাজাসহ সম্পূর্ণ ফিলিস্তিন ভূখণ্ড মুক্ত করার আগে তারা থামবে না। সে কারণে অভুক্ত অবস্থায় রমজানের মতো একটি পবিত্র মাসেও তারা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে তাদের প্রস্তুতির কথা জানিয়েছে।
এই অবস্থায় ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠতম মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, তাদের কংগ্রেসের উভয় হাউস, যুক্তরাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক এবং এমনকি ইহুদিরাও নেতানিয়াহুর অপসারণ, যুদ্ধের অবসান এবং ফিলিস্তিন সমস্যার একটি চূড়ান্ত সমাধান দেখতে চায়।
জর্দান নদী অর্থাৎ ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত বৃহত্তর ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার যে অবাস্তব স্বপ্ন দেখেছিলেন নেতানিয়াহু, তা বাস্তবে রূপায়িত হওয়ার আগে বর্তমান ইসরায়েল রাষ্ট্রই ভেঙে যেতে পারে বলে অনেকে ধারণা করছে। এ ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম ‘ইসরায়েলের কৌশলী শয়তান’ বলে পরিচিত নেতানিয়াহু। একমাত্র তিনিই হামাসকে নিশ্চিহ্ন করার আগ পর্যন্ত, যা সম্পূর্ণ অসম্ভব—যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চান এবং ধুলায় মিশিয়ে দিতে চান গাজাসহ সমগ্র ফিলিস্তিনকে। নেতানিয়াহুর এসব একতরফা চিন্তা-ভাবনা বা কৌশলগত অবস্থানের মূল কারণ হচ্ছে, এ মুহূর্তে তিনি যুদ্ধবিরতিতে গেলে পরবর্তী মুহূর্তেই তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরে গিয়ে নির্বাচন দিতে হবে। এতে তাঁর ভরাডুবি ছাড়াও অন্যান্য দুর্নীতির মামলায় তাঁকে জেলে যেতে হতে পারে।
এ অবস্থায় সব কিছু জেনেশুনেই নেতানিয়াহু মহাবিপদে ফেলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে। ইসরায়েলকে অর্থ ও সমরাস্ত্র সাহায্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন নির্বাচনে জো বাইডেনের জনপ্রিয়তা কিংবা বিভিন্ন রাজ্যে সমর্থনের হার দ্রুত কমছে। গাজায় যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছতে ব্যর্থতার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান, জর্জিয়া ও পেনসিলভানিয়াসহ ‘সুইং স্টেট’ বা দোদুল্যমান রাজ্যগুলোতে বাইডেনের নির্বাচনী পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। এতেও বাইডেনের কথা শুনছেন না নেতানিয়াহু। এই কট্টরপন্থী নেতা শুধু তাঁর নিজের স্বার্থ ও ক্ষমতায় থাকার বিষয়টিই নির্লজ্জভাবে বিবেচনায় রাখছেন, আর কোনো দিকে তাকাচ্ছেন না। নেতানিয়াহুর বক্তব্য শুনলে মনে হয়, এমন একটি সুবিধাবাদী, নির্লজ্জ ও বেহায়া মানুষ আর দ্বিতীয়টি দেখা যায় না। এ কথা ঠিক যে গাজা অভিযান ও তাঁর ভুল রাজনীতির কারণে নেতানিয়াহুকে শেষ পর্যন্ত হয়তো ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হতে পারে। তবে মনে হয়, তিনি সরে যাওয়ার আগে সর্বনাশ করে দিয়ে যাবেন জো বাইডেনের। জো বাইডেন তাঁর নেতানিয়াহুপ্রীতি ও গাজায় যুদ্ধ বন্ধে ব্যর্থতার কারণে নিজের জিতে যাওয়ার মতো দ্বিতীয় টার্মের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনটিতে হেরে যেতে পারেন। সেসব যতই চিন্তা করেন, বাইডেন ততটাই উত্তেজিত হয়ে পড়েন। একদিকে বার্ধক্য ও শারীরিক অক্ষমতা এবং অপরদিকে নেতানিয়াহু সৃষ্ট কঠিন পরিস্থিতি বাইডেনের ভবিষ্যেক সম্পূর্ণভাবে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো একগুঁয়ে, গোঁয়ার, চরিত্রহীন ও বিকৃত মনমানসিকতার অধিকারী ব্যক্তিকে দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ করে দিতে পারে। তবে উল্লেখ করার মতো বিষয় হচ্ছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সুবিধাবাদী নেতানিয়াহুর সম্পর্ক খুব ভালো যাচ্ছে না। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় নেতানিয়াহুর অনুরোধে তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে তাঁদের রাজধানী স্থানান্তর, দখলকৃত গোলান হাইটসের ওপর ইসরায়েলের অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ নেতানিয়াহুর ক্রমাগত অবৈধ বসতি বিস্তারের ক্ষেত্রে নীরব ছিলেন। কিন্তু গত নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প বাইডেনের কাছে হেরে যাওয়ার পর নেতানিয়াহু সব কিছু বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন বলে ট্রাম্প অভিযোগ করেছেন।
ট্রাম্প তাঁর শাসনকালে বিশ্ব মুসলিম ও আরবদের প্রতি যে অসংযত আচরণ করেছেন, তা ভুলে যাওয়ার মতো নয়। নেতানিয়াহুর ফিলিস্তিনিদের অধিকার খর্ব করে একটি বৃহত্তর ইসরায়েল গড়ে তোলার ইন্ধন পেয়েছিলেন ট্রাম্পের কাছ থেকেই। নিজের ইহুদি জামাতা জ্যারেড কুশনারের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘আব্রাহাম একর্ডের’ মতো ফিলিস্তিনিদের স্বার্থবিরোধী একটি কূটনৈতিক উদ্যোগে সরাসরি সমর্থন দিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফিলিস্তিনিদের দুর্ভাগ্য ও দুরবস্থাকে কেন্দ্র করে শুধু ইসরায়েল কিংবা যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, উচ্চ পর্যায়ে জুয়া খেলা হয়েছে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ আরববিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে। মুসলিম বিশ্ব ও আরবদের পশ্চিমারা বিভিন্ন বিষয়ে হিংসা, এমনকি ঘৃণা করলেও তারা বারবার তাদের ফাঁদে পা দিয়েছে। ফিলিস্তিনিদের অধিকার ও স্বার্থের প্রশ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে আরববিশ্ব ইসরায়েলসহ যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। তখন এর পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ ছিল ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের কাছ থেকে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, উন্নত সমরাস্ত্র ও পারমাণবিক প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা লাভ করা। সে কারণে সৌদি কিংবা আমিরাত, মরক্কো কিংবা বাহরাইন, কখনোই কেউ উপেক্ষিত ফিলিস্তিনিদের কথা ভাবেনি। কিন্তু এখন দৃশ্যপটের দ্রুত পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। এবং এর পেছনে অলৌলিক এক মহাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে হামাস নামের কিছু প্রতিরোধ যোদ্ধা এবং তাদের সহযোদ্ধা ইসলামী জিহাদ ও অন্যরা। আজ সমগ্র বিশ্ব তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। বলছে, ৭ অক্টোবরের ইসরায়েলের অভ্যন্তরে হামাস ও অন্যদের হামলা ছিল বিগত ৭৫ বছরের ইহুদিবাদী নির্যাতন, নিষ্পেষণ ও দখলদারির বিরুদ্ধে ন্যায়সংগত প্রতিবাদ। বিগত দিনের ইহুদিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র এবং প্রতিবেশী জ্বালানিসমৃদ্ধ আরবদের চরম অবহেলার কারণে ফিলিস্তিনের মুক্তির প্রশ্নটি বিশ্বরাজনীতি বা কূটনীতির দৃশ্যপট থেকে প্রায় হারিয়েই যাচ্ছিল, হামাসের নেতৃত্বাধীন প্রতিরোধ যোদ্ধারা তা আবার পুনরুদ্ধার করেছে। লেবাননের গেরিলা যোদ্ধা হিজবুল্লাহ কিংবা ইয়েমেনের হুতি-আনসারুল্লাহ বাহিনীর সহযোগিতায় ফিলিস্তিনিরা আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনিদের পরাজয় হবে না যত দিন তারা মুক্তির প্রশ্নে আপসহীন থাকে। তা ছাড়া প্রস্তাবিত টেকনোক্রেটিক সরকার গঠনের ব্যাপারে আরো কৌশলী ভূমিকা পালন করতে হবে, যাতে সুবিধাবাদী চক্র এর ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে।
২১ মার্চ, ২০২৪
লেখক: বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যস্থাপনা পরিচালক, ‘প্যালেস্টাইন—এক সংগ্রামের ইতিহাস’ গ্রন্থের প্রণেতা