অজয় পাল ♦
লণ্ডন, ২১ এপ্রিল ২০২১:
(বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কঠিন দিন যাপন শেষে বিজয়ানন্দে ঘরে ফেরার আর স্বাধীন বাংলাদেশে বেঁচে থাকা পরিবার-পরিজনের সাথে মিলিত হবার মধুর স্মৃতিচারণ করে সদ্যপ্রয়াত অজয় পাল ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে এই লেখাটি প্রকাশ করেছিলেন। দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে বহু মানুষের কাহিনী তুলে এনেছেন অজয় পাল তাঁর লেখনীতে। কিন্তু এ কাহিনী তাঁর নিজের। তবে নিজের হলেও একই সাথে তা হয়ে ওঠেছে বাংলাদেশের আরো লাখো মানুষের অভিজ্ঞতা আর অনুভূতির প্রতিনিধি। অজয় পাল পরলোকে পাড়ি জমিয়েছেন গত সপ্তাহে। তাঁর এই অনবদ্য লেখাটি পত্রিকার বিশেষ ক্রোড়পত্রে ছাপা হলো তাঁর প্রতি নিবেদিত শ্রদ্ধায়, স্মরণে- তাঁর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে। –সম্পাদক, পত্রিকা।)
সাত সকালে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে সহসা জেগে উঠলাম। বাইরে থেকে শুক্লা বৌদির কণ্ঠ ভেসে এলো: “দাদা, ও দাদা, উঠুন- দরজা খুলুন।” কোনো খারাপ খবর মনে করে লাফিয়ে উঠে দরজা খুলতেই দেখি বৌদির মুখে একদলা হাসি ঢেউ খেলছে। শুক্লা বৌদিকে ওমন করে হাসতে কখনো দেখিনি। রহস্য জানতে চাইলে কোনো ভনিতা না করেই বললেন, আগে মিষ্টি, পরে বাকিটা। বিনা ভাড়ায় চার মাস ধরে বৌদির ঘরে আছি, আর এ-তো সামান্য মিষ্টির বায়না। তথাস্তু বলতে একটুও বিলম্ব হলো না আমার। বৌদি এবার হাত ধরে আমাকে টেনে নিয়ে গেলেন তাঁদের মূল ঘরে। বিছানায় বসে রেডিওতে আকাশবাণী শুনছিলেন শুক্লা বৌদির স্বামী মন্টুদা। আমাকে দেখামাত্র উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, “রেডিও শুনুন, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে।”
আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম আমি। বলেন কি দাদা? রেডিওর আওয়াজটা বাড়িয়ে দিয়ে ফের বললেন, শুনুন। এবার কান খাড়া করে শোনলাম, পাকবাহিনী রণে ভঙ্গ দিয়েছে এবং আজই (১৬ ডিসেম্বর) ঢাকায় আত্মসমর্পণ করবে। আকস্মিক এমন আনন্দের সংবাদ শুনে কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। বৌদি বললেন, বসুন, চা বানিয়ে আনি। বললাম, এখন না বৌদি। আমি আসছি। এই বলে ফিরে গেলাম নিজের ঘরে। প্রাতঃকর্ম সেরে অল্পক্ষণ পরেই বেরিয়ে পড়লাম। উদ্দেশ্য একটাই, রাস্তায় শরণার্থীদের প্রতিক্রিয়া দেখা। দূর-দূরান্তের শরণার্থী শিবিরগুলোতে তখন জয়বাংলা শ্লোগান চলছিলো। স্থানীয় জনগণের মধ্যেও আনন্দের উচ্ছ্বাস ছিলো লক্ষ্যণীয়।
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের কুলাই বাজারে একাত্তরের ছয়টি মাস ধরে ছিলো আমার অবস্থান। শুরুতে এক নিকটাত্মীয়ের বাসায় ছিলাম। দুর্বিসহ জীবন যাপনের এক পর্যায়ে বাজারের চা-বিক্রেতা মন্টুদার বাসার একটি কক্ষে ভাড়াটে হিসেবে থাকলেও চার মাস ভাড়া দেয়া হয়নি। মন্টু দা অবশ্য ভাড়ার জন্য কখনো চাপ দেননি। আমি বাজারের ভেতরে এক নিকটাত্মীয়ের সুবাদে একটা ছাপড়া ঘরে টুকটাক ব্যবসা করতাম এবং সুযোগ হলেই বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা ঘুরে দেশে আটকে পড়া পিতা-মাতাসহ ছোট ভাইদের কোনো সন্ধান পাওয়া যায় কিনা জানার চেষ্টা করতাম। মাঝে মধ্যে আগরতলা থেকে প্রকাশিত দৈনিক জাগরণ পত্রিকায় লিখতাম।
ফিরে আসি আগের কথায়। সেই যে ঘর থেকে বেরোলাম, আর ফিরে যাওয়া হয়নি মন্টুদার ঘরে। ঘরের বিছানা পত্র ও রাতের এঁটো বাসন কোসন পডয় থাকলো অগোছালো। দোকানটিও পডয় থাকলো তালাবদ্ধ। এই বেরিয়ে যাওয়াটাই যে শেষ যাওয়া, সেটাও বলা হলো না মন্টুদা কিংবা শুক্লা বৌদিকে। অকৃতজ্ঞ ও নির্লজ্জের মতো আজ বলছি, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পঞ্চাশ বছর পরও সেই মন্টুদা ও তাঁর পরিবারের খোঁজ খবর একটি বারের জন্যও নেয়া হয়নি আমার। অথচ এই দীর্ঘ সময়ে বিশ্বের বহু দেশ ভ্রমণ করেছি। এই পরিবারটি এখন কেমন ও কিভাবে আছে, সে তথ্যটিও আমার অজানা। চার মাসের ঘর ভাড়াও অপরিশোধ্য রয়ে গেছে। এই অমার্জনীয় অপরাধটুকু ক্ষমা করে দিও মন্টুদা/শুক্লা বৌদি।
সেদিন কুলাই বাজারের প্রধান রাস্তায় এসে দেখি ভিন্ন এক চিত্র। দণ্ডায়মান একটি ট্রাকে তাড়াহুড়া করে উঠছেন শরণার্থীরা, আর ট্রাকের সহকারী “খোয়াই, খোয়াই” বলে হাকডাক করছে। সবার মুখেই তখন জয়বাংলা শ্লোগান। এরই মধ্যে লক্ষ্য করলাম ট্রাকে উঠে বসা পরিচিত এক শরণার্থী গোস্বামী বাবু আমাকে ট্রাকে উঠার জন্য ইশারা করছেন। আমি সাতপাঁচ না ভেবে উঠে পড়লাম। গোস্বামী বাবু বললেন, সীমান্ত খুলে দিয়েছে। চলুন, মা-বাবার সন্ধান করবেন না? বললাম, আমি যে মন্টুদাকে কিছুই বলে আসিনি। জবাবে বললেন, অসুবিধা কি? প্রয়োজনে দু’একদিন পরে আবার ফিরে আসবেন। ভাবলাম, তাইতো। মা-বাবার খোঁজ খবর নিয়ে আবার ফিরে আসবো ।
অল্পক্ষণের মধ্যেই খোয়াই সীমান্তে পৌঁছে গিয়ে দেখি, সদ্য শত্রুমুক্ত বাংলাদেশ অভিমুখে শরণার্থীদের স্রোত বইছে। কোনো যানবাহন নেই। হাঁটা ছাড়া গত্যন্তর নেই। জনস্রোতে আমরাও মিশে গেলাম। বলে নেয়া ভালো, রওয়ানা হবার আগেই সীমান্তে কুলাই বাজারের একজন ক্ষুদে ব্যবসায়ীর সাথে দেখা হয়ে গেলে তার মাধ্যমেই মন্টুদার কাছে একটি চিরকুট পাঠিয়ে আমার অবস্থান জানিয়ে দেয়ার চেষ্টা করি। আমি জানি না, এটা তাঁর কাছে পৌঁছেছিলো কি না।
পায়ে হেঁটে হবিগঞ্জে পৌঁছার পরেই নবীগঞ্জ অভিমুখী একটি ট্রাক পেয়ে যাই। সঙ্গত কারণেই আমার প্রথম গন্তব্য এই নবীগঞ্জ। একাত্তরের এপ্রিল মাসে মা-বাবাসহ ছোট ভাইদের নবীগঞ্জে রেখেই অগ্রবর্তী দল হিসেবে আমরা বড় তিন ভাই খোয়াই সীমান্ত দিয়ে ভারতে পৌঁছাই। একদিন পর তাদের সকলেরই খোয়াই এসে পৌঁছার কথা। কিন্তু নির্ধারিত দিনে আমরা খোয়াই গিয়ে দেখি, সীমান্ত জুড়ে চরম উত্তেজনা। এপারে ভারতীয় সেনাবাহিনী, আর ওপারে পাকবাহিনী অবস্থান নিয়ে আছে। সেই থেকে মা-বাবাসহ ভাইদের সাথে দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত যোগাযোগ ছিলো বিচ্ছিন্ন।
ট্রাকে চেপে নবীগঞ্জে পৌঁছেও তাদের কোনো সন্ধান পেলাম না। কেউ সঠিক কোনো তথ্যও দিতে পারলো না। আবার ফিরলাম হবিগঞ্জ। সেখান থেকে শায়েস্তাগঞ্জ হয়ে লস্করপুর রেলওয়ে স্টেশন লাগোয়া আদ্যপাশা গ্রামে পৌঁছালাম। এখানে আমার মামার বাড়ি। একজন নিকটাত্মীয় জানালেন, তারা বাহুবলের নন্দনপুর গ্রামে আমাদের আদি বাড়িতে গিয়েছিলেন। সেখানে আলবদর রাজাকাররা বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয় এবং আমাদের এক জ্যাঠতুতো ভাইকে হত্যা করে। পরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা সিলেটে চলে যান। এর বেশি আর কোনো তথ্য জানা গেলো না।
এবার আমার সিলেট অভিযাত্রা। শায়েস্তাগঞ্জ থেকে ফের ট্রাকে চাপলাম। সিলেটের মজুমদারী এলাকার এক তরুণের সাথে এই ট্রাকে বসেই কথাবার্তা। শেরপুর থেকে সে ট্রাকে উঠেছিলো। তরুণটি জানালো, ১১, ১২ ও ১৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনারা সিলেট নগরীর বিভিন্ন স্থানে বিমান থেকে প্রচণ্ড হামলা চালায়। এতে বহু লোক হতাহত হয়েছে। খবরটা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। মা-বাবাসহ ছোট ভাইয়েরা বেঁচে আছে কিনা, সে চিন্তায় আমাকে পেয়ে বসলো।
সন্ধ্যার আগেই ট্রাকটি এসে দক্ষিণ সুরমা পৌঁছায়। লক্ষ্য করলাম, সুরমা নদীর দুপারে অসংখ্য মানুষের জটলা। পাক বাহিনী কর্তৃক ডিনামাইট হামলায় বিধ্বস্ত কিনব্রিজটি ঝুলে আছে নদীর মধ্য বরাবর। নৌকায় নদী পারাপার চলছে। তোপখানা বরাবর আমিও নদী পেরোলাম। এপারের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তখন ভেসে আসছিলো “জয় বাংলা” জয় ধ্বনি। ওদিকে আমার মোটেই ভ্রুক্ষেপ নেই। দাড়িয়াপাড়ার বাসায় পৌঁছে কি খবর শুনবো, সেই দুশ্চিন্তায় আমাকে পেয়ে বসেছিলো। রাস্তার ডানে বামে কোনো মানুষের দিকেই তাকাচ্ছিলাম না। ভয় ছিলো এই, যদি পরিচিত কারো সাথে দেখা হয়ে যায়, আর শুনিয়ে দেয় কোনো দুঃসংবাদ।
আমি কেবল-ই হাঁটছি। ইতোমধ্যে মির্জাজাঙ্গাল এলাকায় নিম্বার্ক আশ্রমের সামনে পৌঁছে গেলাম। আশ্রমের পেছনেই পুকুর পাড়ে তখন আমাদের বসতি। আশ্রমের সামনে দাঁড়িয়ে প্রণাম করে এবার সোজা বাসার দিকে। পুকুরের বাঁকটা ঘুরতেই দেখি মা আমার বারান্দায় দাঁড়িয়ে। মা-কে দেখামাত্র আনন্দ আমাকে জেকে ধরে। ভো দৌড় গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলাম। মা প্রথমে আমাকে চিনতেই পারছিলেন না। ভালো করে মুখের দিকে তাকিয়ে দেখার পর সে কি কান্না আমার মায়ের। সেই দুর্লভ মুহূর্তের স্মৃতি গত ৫০ বছরে বহুবার আমাকে দোলা দিয়ে গেছে। একটি বারের জন্যেও ভুলতে পারিনা। ইতোমধ্যে ভাইয়েরাও এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। বাবা তখন বাসায় ছিলেন না। অল্পক্ষণের মধ্যেই বাবাও চলে এলেন কি আনন্দ তখন আমার।
আজ বলতেই হয়, একাত্তরের এই দিনটির কথা যখনই মনে পড়ে, বারবার আমার কাছে ফিরে ফিরে আসে ত্রিপুরার সেই কুলাই বাজার, সেই মন্টুদা ও শুক্লা বৌদি সহ সেখানকার অগনন প্রিয় মুখ। এই মুখগুলোর মধ্যে অন্যতম হলেন টেইলর অমর শর্মা, ব্যবসায়ী ছানাদা, অতুল বাবু ও হীরালাল বাবু। সেই কষ্টের দিনগুলোতে কুলাই বাজারে অমর শর্মার দোকানে বসে প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনতাম। তাঁরা বলতেন, অন্যায় করে কেউ কখনো পার পায়না। পাকিস্তানও পার পাবে না। আজ হোক, কাল হোক, বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। সেটাই সত্য হয়েছে। অমরদা, প্রণাম তোমাদের সকলকে।