প্রথম অশ্বেতাঙ্গ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক
ইতিহাস সৃষ্টির সম্ভাবনা মাস দুয়েক আগেই তৈরি হয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির সাধারণ সদস্যরা সেই সম্ভাবনাকে গুড়িয়ে দিয়ে লিজ ট্রাসকেই ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হিশেবে বেছে নিয়েছিলেন।
মিথ্যাচার, অসততা ও বেপরোয়া আচরণের নানা অভিযোগের জের ধরে গত জুলাই মাসে বরিস জনসন তাঁর দলের নেতৃত্ব এবং দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিলে পরবর্তী নেতা ও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়।
এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার শুরু থেকে পার্লামেন্টে নিজ দলের সহকর্মীদের ব্যাপক সমর্থন নিয়ে বহু এগিয়ে থাকলেও দলের সাধারণ সদস্যদের ভোটে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হবার লড়াইয়ে হেরে যান ঋষি সুনাক।
অবশ্য এক্ষেত্রে পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের অবদানও কম ছিল না। চ্যান্সেলার ঋষি সুনাকের পদত্যাগই যেহেতু বরিস জনসনের ক্ষমতা থেকে বিদায়ের পথ তৈরি করেছিল সেহেতু তিনিও ঋষি সুনাকের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই মাঠে নেমেছিলেন।
সেপ্টেম্বর মাসে লিজ ট্রাস দলের সাধারণ সদস্যদের ব্যাপক সংখ্যক ভোট পেয়ে নেতৃত্ব লাভের মধ্যদিয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এই ফলাফল বহুজাতিক, বহুসংস্কৃতিক এবং বহুভাষিক আধুনিক ব্রিটেনকে এই বার্তাই দেয় যে, এই দেশের সমাজ এখনো প্রকৃতপক্ষে অশ্বেতাঙ্গ কাউকে দেশটির সর্বোচ্চ নির্বাহী পদে আসীন দেখতে প্রস্তুত নয়।
কিন্তু ব্রেক্সিট আর করোনা মহামারীর থাবায় বিপর্যস্ত ব্রিটেনে অস্থিরতার আগুনে ঘি ঢালে নতুন প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসের নেওয়া অর্থনৈতিক কর্মসূচি আর নানান পদক্ষেপ।
তাই দায়িত্ব নেবার দুই মাসেরও কম সময়ের দেশটির রাজনৈতিক ইতিহাসে নজির সৃষ্টি করে গত সপ্তাহে লিজ ট্রাস প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন।
অবশেষে ব্রিটিশ রাজনীতিতে স্মরণকালের নাটকীয়তা আর নানা হিসাব-নিকাশের বেড়াজাল পেরিয়ে ঋষি সুনাক ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ দলের নেতা এবং একই সাথে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হলেন। ২৪শে অক্টোবর ২০২২ তারিখটি তাই যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি বড় মাইলফলক হয়েই থাকবে।
ঐতিহ্যগতভাবে ধনীদের পক্ষের এবং রক্ষণশীল আদর্শে বিশ্বাসী কনজারভেটিব দলের ঋষি সুনাক নিজেও ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। পড়ালেখা অভিজাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, ক্যারিয়ারও কর্পোরেট জগতে। তাই প্রধানমন্ত্রী হিশেবে তাঁর নেয়া পদক্ষেপ এদেশের সাধারণ জনগণের কষ্ট লাঘবে কতটুকু সহায়ক হবে তা সময়ই বলে দেবে।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনাক শুধু প্রথম এশীয়ই নন বরং প্রথম কোন অশ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। তিনি এদেশের সংখ্যালঘু কিংবা তাঁর জাতিগত জনগোষ্ঠীর পক্ষে বিশেষ কোনো পদক্ষেপ নেবেন এমনটি আশা করা ঠিক নয়।
তিনি কতদিন প্রধানমন্ত্রী থাকবেন তা-ও বর্তমান টালমাটাল রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে নিশ্চিত করে বলা কঠিন। কিন্তু ঋষি সুনাকের প্রধানমন্ত্রী হবার মধ্যদিয়ে যে বার্তাটি শুধু ব্রিটেন নয় সারা বিশ্বের সংখ্যালঘু এবং দুর্বল জনগোষ্ঠীর মানুষ পেয়েছেন, সেটি হচ্ছে- যোগ্যতা থাকলে শীর্ষে আরোহন কঠিন হলেও অসম্ভব নয়।
ব্রিটিশ সমাজে সফলদের জন্যও, যোগ্যদের জন্যও শীর্ষে যাবার ক্ষেত্রে যে অদৃশ্য কাঁচের দেয়ালটি আছে সেটি ঋষি সুনাক ভেঙে দিয়েছেন।
এই বার্তাটিই বহুজাতিক সমাজের বঞ্চিত অংশের, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে এবং তারা শীর্ষে আরোহণের ক্ষেত্রে প্রেরণা পাবেন। এই প্রেরণা অসম্ভব শক্তিশালী, সকল অসম্ভবকে সম্ভব করার অব্যর্থ দুয়ার।
অভিনন্দন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক।