মানুষ মারার চরম নিষ্ঠুর বাণিজ্য কবে বন্ধ হবে?
বাংলাদেশের হাসপাতাল আর ক্লিনিকগুলোর বিরুদ্ধে রোগী ও সেবাগ্রহীতাদের অভিযোগের কমতি ছিলো না আগেও। কিন্তু সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একের পর এক ঘটনায় স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার নামে বাংলাদেশে হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোর মানুষ মারার চরম নিষ্ঠুর বাণিজ্য একেবারে স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ছে। এই অরাজক পরিস্থিতি একদিনে সৃষ্টি হয়নি। দিনের পর দিন মানুষ মারার মতো অমার্জনীয় অপরাধ করেও এরা পার পেয়ে গেছে বলে কোনো অঘটন ঘটলেও পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়না। তাহলে এসব প্রতিষ্ঠানের নজরদারীর দায়িত্বে যারা রয়েছেন তাদের কাজ আর দায়িত্বটা কী?
সম্প্রতি প্রকাশিত বিভিন্ন রিপোর্ট পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাতে সত্যিকার অর্থেই ভয়ানক এক অবস্থা বিরাজ করছে। গত ৩১শে ডিসেম্বর খতনার জন্য পাঁচ বছরের আয়ান আহমেদকে অ্যানেন্থেসিয়া দেয়ার পর আর জ্ঞান ফেরেনি তার। সাত দিন পর ছেলের লাশ নিয়ে ফিরেছেন মা-বাবা। ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এ ঘটনায় দেশ জুড়ে তোলপাড়ের মধ্যেই গত মঙ্গলবার জে এস মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে খতনা করাতে গিয়ে শিশু আয়হাম তাহমিদ মারা গেছে। এক্ষেত্রেও অভিযোগ অ্যানেন্থেসিয়ায় অবহেলা। এর আগের দিন গত সোমবার ধানমণ্ডির একটি হাসপাতালে এন্ডোসকপি করতে গিয়ে ৩২ বছরের যুবক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। এই ঘটনায় রিপোর্ট না দেখে অ্যানেন্থেসিয়া দেয়ার অভিযোগ করেছে পরিবার। গত ১৬ জানুয়ারি বরগুনার বামনায় লাইসেন্সবিহীন অবৈধ সুন্দরবন হসপিটাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে প্রসূতি নারী মেঘলাকে ভর্তি করানোর পর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় অনভিজ্ঞ আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা সবুজ কুমার দাসসহ পাঁচ-ছয়জন মিলে তার অস্ত্রোপচার শুরু করেন।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট মতে, সেখানে মেঘলার পেটে অস্ত্রোপচারের প্রায় দুই ঘণ্টা পর অবস্থা বেগতিক দেখে জীবিত নবজাতক সন্তানকে ফের মায়ের পেটে ঢুকিয়ে দিয়ে দ্রুত বরিশালে নিতে বলেন চিকিৎসকরা। রোগীর অবস্থার অবনতি হলে পথে তাকে ভান্ডারিয়া হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। একটি প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করতে গিয়ে পৃথিবীতে কত মানুষ নিজের জীবনের ঝুঁকি নেয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজের প্রাণও দেয়। আর বাংলাদেশে চিকিৎসার নামে কী অবলীলায়?এক সাথে দুটি জীবন সংহার করে তথাকথিত চিকিৎসকরা। বাংলাদেশে ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হলেই খবর বের হয়, ঐ হাসপাতাল বা ক্লিনিক অবৈধ। বলা হয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমতি বা লাইসেন্স ছাড়াই চলছিল হাসপাতালটি। কিন্তু এমন ঘটনা ঘটার আগেই কেন এমন হাসপাতাল বা চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ করা যাচ্ছে না বা তাদের শনাক্ত করা যাচ্ছে না দীর্ঘদিনের এই প্রশ্নের কোনো সুরাহা নেই। সুন্নতে খতনার মতো সাধারণ সার্জারিতে সম্প্রতি দুই শিশুর করুণ মৃত্যুর ঘটনা প্রকাশের পরই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, দুটি হাসপাতালই অনুমোদনহীনভাবে চলছিল।
নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন দায়িত্ব নেয়ার পর অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলেছেন। মন্ত্রীর এমন নির্দেশ দেয়ার পরও একের পর এক ঘটনা সামনে আসছে। কারণ, বিষয়টি তো এখানেই শেষ হচ্ছে না। অনেক হাসপাতাল ও ক্লিনিকের লাইসেন্স থাকলেও তারা শর্ত মানছে না। অনেকের বার্ষিক লাইসেন্সও নবায়ন করা নেই। অথচ ঢাকায় ৪১৫টি অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক রয়েছে। ময়মনসিংহে ২৫২টি। চট্টগ্রামে ২৪০টি, খুলনায় ১৫৬টি, রংপুরে ১১১টি, রাজশাহীতে ৫৫টি, বরিশালে ৪৮টি ও সিলেট বিভাগে ৮টি অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক রয়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এরা কী করে মরণ-বাণিজ্যে টিকে থাকে- এই প্রশ্নের জবাব খোঁজা এখন সবচেয়ে জরুরী।
সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর পর জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ চিকিৎসা খাত লাগামহীন নৈরাজ্যে নিষ্ঠুরতার খাতে পরিণত করছে বলে মন্তব্য করছেন।
আমরা এই নিষ্ঠুরতা বন্ধে অবিলম্বে সরকারের দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ দেখতে চাই।