আমরা কি করছি?
এবারের একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের বাহাত্তর বছর পূর্ণ করলো। ১৯৫২ সালের পয়ত্রিশ মিনিট। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অত্যন্ত গৌরবজনক দিন-ক্ষণ। বায়ান্নের একুশে ফেব্রুয়ারি মধ্যদুপুরের ১-১০ মিনিট থেকে ১-৪৫ মিনিট সময়টি এক অপরিমেয় শক্তিতে ভবিষ্যতের কোন কালে দুনিয়া কাঁপাবে বলে কি কেউ জানতো সেদিন? আর কে জানতো ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি?’ গানটি কোটি কোটি মানুষের কণ্ঠে অমোঘ শক্তি হবে সংগ্রামের? কেউ কি জানতো, বিশ্বময় প্রতি বছর নিপীড়িত মানুষেরা গেয়ে ওঠবে নিজ নিজ ভাষা রক্ষার প্রেরণায়, অমরত্ব পাবে সে গান। সেটি কি জানতেন গানের লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী? শহীদ রফিক, বরকত আর শফিউরদের বুকের রক্তে নিপীড়কের বজ্রকঠিন দণ্ড আর দর্প ভেঙ্গে দেওয়ার গান গাইবে বিশ্ববাসী, অধিকার আদায় ও লড়াইয়ের মন্ত্রে দীক্ষিত হবেই মানুষ- কে জানতো? কিন্তু মাতৃভাষার প্রতি প্রবল মমতা আর আত“মর্যাদায় বলিয়ান বাঙালী তরুণেরা জীবন দিয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেই বিশ্বাস ও চিরঞ্জীব চেতনার নাম আজ ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’।
‘একুশ মানে মাথা নত না-করা’। এ বাণী এখন বিশ্ব-মানুষের আত্মসম্মান আর আত্মমর্যাদা প্রকাশের ভাষা। কী অপরূপ শক্তি এই বাক্যবন্ধে। পৃথিবীর সব নিপীড়িত মানুষ ভবিষ্যত মানবিক বিশ্ব গড়ে তুলবে ‘একুশ মানে মাথা নত না-করা’ এই মন্ত্রে। বাঙালির প্রদর্শিত পথে, সংগ্রামের দীক্ষায়। কারণ, বাংলা ভাষার জন্য আত্মত্যাগের দিনটির স্বীকৃতি এখন বিশ্বজুড়েই। ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের স্বীকৃতি লাভের পর থেকে প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে সারা বিশ্বেই পালিত হয়।
একুশের ভাষা শহীদরা আমাদের কাঁধে যে অঙ্গীকার তুলে দিয়েছিলেন, বাহাত্তর বছর পর বাংলার এই বিশ্বায়নের পরও আমরা কি সে অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করতে পেরেছি? অথচ আমরা গর্বভরে উচ্চারণ করি, একুশের হাত ধরেই বাঙালি জাতিরাষ্ট্র একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ শহীদের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে। কিন্তু ঐতিহাসিক এই অর্জনের পর আমাদের অগ্রগতির মানদণ্ড কোথায় গিয়ে ঠেকেছে, তা কি তলিয়ে দেখা হয়েছে গত বাহাত্তর বছরে? মাতৃভাষার ব্যবহারিক শক্তিকে প্রতিষ্ঠা করার যে আলোকজ্জ্বল সুযোগ আমরা স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পেয়েছিলাম, তা পরিচর্যা না-করে দিনে দিনে তার সংহার চলছে। আমাদের নিজস্ব শহীদ দিবসকে রেখে এখন আমরা একুশে ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পালনে অধিক উৎসাহী। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পাওয়ার আনন্দে বাঙালি ভুলেই গেছে যে আন্দোলনটি ছিল মূলত আমাদের রাষ্ট্রভাষার জন্য। এটি দুঃখজনক। বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, আমরা বাংলাভাষাকে স্কুল পর্যায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কোন গুরুত্ব না দিয়ে ইংরেজীকে প্রাধান্য দিয়ে নিজ ভাষাকে দূরে ঠেলে চলেছি সজ্ঞানে।
বাহাত্তর বছর আগের এই দিনে মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার দাবিতে শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অকুতোভয় বীর সন্তানরা নেমে এসেছিলেন রাজপথে। আমরা নিজেরা সারা বছর মাতৃভাষাকে অনাদর-অবহেলা করে যাই। প্রদর্শনীর জন্য কোন ভবনের দেওয়ালে কিংবা কোনো স্থাপনায় বাংলা অক্ষরে আলোর ঝলকানি দেখে আমরা ক্ষণিকের উচ্ছাসে মাতি। অথচ সেই ভবনের ভেতরের বাংলা শিক্ষার আলো যখন নিভিয়ে দেয়া হয় অর্থাভাবের অজুহাতে তখন আমরা বিচলিত হইনা। অধিকার রক্ষার জন্য দাঁড়ানো তো দূরের কথা।
আমাদের নিজেদের প্রশ্ন করা উচিৎ, আমরা কী করছি? শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে না দিয়ে আসুন আমরা সজাগ হই। মাতৃভাষার উন্নতিই একুশের শিক্ষা- এই বিশ্বাসে এবারের একুশে বিশ্বজুড়ে বাংলাভাষীদের সকল মনোযোগ জমা হোক।
সকল শহীদের প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা, সংগ্রামীদের প্রতি অভিনন্দন ও ভালোবাসা।