স্বাধীনতা অর্জন যত সহজ, রক্ষা করা তার চেয়ে বেশি কঠিন। কথাটা গুণীজনদের। উনিশ একাত্তর সালের ২৬ মার্চ সেই অমিত সাহস নিয়ে বাঙালি স্বপ্নের স্বাধীনতা অর্জনের পথে নেমেছিলো। সশস্ত্র সেই অসম যুদ্ধে জয়ও এসেছিলো।
যুগ যুগের অপশাসন ছিঁড়ে পরাধীন, উপনিবেশিত, অবদমিত এবং শোষিত জনগোষ্ঠীর জন্য ২৬ মার্চ একাত্তর রচিত হল বাঙালি নামক জাতির স্বাধীন সত্ত্বার। হানাদার পাকবাহিনির বিরুদ্ধে নয় মাস সশস্ত্র লড়াই করে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে যে সূর্য উদিত হল জাতির ভাগ্যাকাশে, তা অর্থবহ করে তোলার গুরুদায়িত্ব পড়লো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। আমরা বহন করে চলেছি সেই অমূল্য লাল-সবুজ পতাকার মর্যাদা রক্ষার দায়ভার।
কিন্তু একটি পতাকার জন্মের কথা বলা যত সহজ, সেটি দেশের সকল মানুষের জন্য অর্থবহ করে তোলার কাজটা তত সহজ নয়। এই পতাকা বহন করার সার্থকতা নিহিত রয়েছে সেই দেশের জনগণের শোষণমুক্তি কতটা হল, তার ওপর।
স্বাধীনতা পেল জাতি। কিন্তু নতুন শোষকরা থাবা উচিয়ে এলো জাতির ঘাড়ে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার হারিয়ে গেল কবে, কোথায়? তার ঠিকানা খুঁজতেই যুগ যুগ পার হয়ে গেলো। মুক্তিযুদ্ধের অর্ধশতাব্দী পার হলেও শোষণমুক্তি ঘটেনি, বরং বিপন্ন মানুষ আরো নানা মাত্রায় বিপন্ন হয়েছে। বাংলাদেশ এখন একাত্তরের সাড়ে সাত কোটি মানুষের দেশ নয়, আঠারো কোটি মানুষ বাস করে এই ভূখণ্ডে। জনসংখ্যার এই ঊর্ধগতির দেশে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দুর্নীতি, ঘুষ এবং লুটপাট নানা অপরাধ। বেড়েছে উন্নয়নও। বড় বড় স্থাপনা নির্মাণ ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির অন্তরালে সাধারণ মানুষ নিষ্পেষিত হচ্ছে, বাড়ছে শোষণের মাত্রা। এমনকি ন্যায়বিচারের স্থলে বাড়ছে অবিচার।
‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করতে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি বর্তমান রাজনীতির ব্যবস্থা এমন একটি অবস্থা তৈরি করেছে, যেখানে রাষ্ট্র, সরকার এবং রাজনৈতিক দলের মধ্যে আর কোনো পার্থক্য নেই। তাই সরকারের বা সরকারি দলের সমালোচনা করা রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রমের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের বা ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সমালোচনা আর রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার মতো দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়কে একই কাতারে বিবেচনা করা হচ্ছে।’
আমরা জানি, স্বাধীনতালাভ আর মুক্তিলাভ এক বিষয় নয়। যদিও একটার সাথে আরেকটার হাত ধরাধরি এমন যে, একটা বিনে আরেকটা অর্থহীন। আমরা একাত্তরে স্বাধীনতা লাভ করেছি, কিন্তু জাতির মুক্তি এখনো সুদূর পরাহত। এই মুক্তি আর সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার লড়াইটা কবে শুরু হবে, কারা করবেন- সেই অপেক্ষায় আর কত দিন? একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের পর জাতি ভেবেছিল, এই বুঝি চাওয়া শেষ, রক্তসাগর দিয়ে দেনাও চুকেছে, এবার পাওয়ার পালা। কিন্তু দুর্ভাগা জাতির এই আশা অচিরেই ম্লান হয়ে যায়। আসে একের পর এক সামরিক শাসন, দুঃশাসন। নানা কৌশলে অবিচারের বিস্তার ঘটতে থাকে। শোষক ও লুটপাটকারি সৃষ্টি হতে থাকে সমানতালে। চলে দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার, জাতিকে পঙ্গু করার শত ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত।
এবারের স্বাধীনতা দিবসে বার্তা একটাই- যে জঞ্জাল জমা হয়েছে আমাদের সামনে সেসব সরাতে হবে, নাহলে স্বাধীন দেশটি নিয়ে আমাদের গর্ব ক্রমশঃই ম্লান হতে থাকবে। ‘বীরের জাতি’ বলে যে অঙ্গীকার সামনে রেখে আমাদের গর্বের ইতিহাস রচিত হয়েছিল একাত্তরে, সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের কঠিন কাজ এখন জাতির সামনে।
আমরা বিশ্বাস করতে চাই, যুদ্ধ বিজয়ী জাতি সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নেও সক্ষম হবে একদিন। সেই প্রতীক্ষায় এবারের স্বাধীনতা দিবসে আমাদের ‘আশায় বসতি’। এবারের স্বাধীনতার দিবসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের কাজটিও আমাদের তৎপর হওয়া দরকার।
স্বাধীনতা দিবসে বাংলার সকল শহীদের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তিম অভিবাদন আর নিত্য সংগ্রামী জনতার প্রতি অনিঃশেষ শুভ কামনা।