নীতি-নির্ধারকদের বোধোদয় ঘটবে কি?
প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার একটি বড় যোগানদাতা। বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েই চলছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক নানামুখী আর্থিক সংকটের পাশাপাশি দেশটিতে এই রেমিটেন্সের প্রবাহ আশঙ্কাজনক হারে কমছে।
সর্বশেষ, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যের উপর ভিত্তি করে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন সেই আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ওই রিপোর্টে বলা হচ্ছে, মাত্র এক মাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ প্রবাসী আয়ের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে বাংলাদেশে যাওয়া রেমিটেন্স প্রবাহ ৪০% এরও বেশি কমে গেছে। ওই রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, আগস্ট মাসে আবুধাবি থেকে প্রবাসীদের পাঠানো ৩০ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি রেমিটেন্স এক মাসের ব্যবধানে কমে গিয়ে সেপ্টেম্বরে মাত্র ১৮ কোটি ডলারে নেমে এসেছে।
একইভাবে সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং কুয়েত এই শীর্ষ প্রবাসী আয়ের চারটি দেশ থেকে উল্লেখযোগ্য হারে রেমিটেন্স হারিয়েছে বাংলাদেশ। গত এক মাসে বাংলাদেশের প্রবাসী আয় কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশ। হঠাৎ করে এই রেমিটেন্সের আমদানি কমে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য অশনি সংকেত বলেই মনে করছেন এই খাত-সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি বিশেষ করে আর্থিক অনিশ্চয়তা এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি বাংলাদেশের এই রেমিটেন্স প্রবাহে প্রভাব ফেলেছে তাতে সন্দেহ করার কোন কারণ নেই। কিন্তু শুধু বহির্বিশ্বের আর্থিক দুরবস্থা কিংবা আন্তর্জাতিক অস্থিরতা বাংলাদেশের রেমিটেন্স কমার জন্য দায়ী নয়।
আমরা বাংলাদেশের রেমিটেন্স প্রবাহ বৃদ্ধির সাথে সাথে এ নিয়ে দেশের কর্তাব্যক্তিদের বিভিন্ন সময় দম্ভ প্রকাশ করতে দেখেছি। যেন এই রোজগার কিংবা আয় তাদেরই কৃতিত্ব। অথচ বিদেশে পাড়ি দেয়া মানুষেরা যে কত কষ্ট করে পাউন্ড-ডলার আর রিয়াল কামাই করেন তা প্রবাসী না হয়ে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। এদের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের ফসলই এতদিন নিশ্চিন্তে ভোগ করেছে বাংলাদেশ। এর সুরক্ষায় রাষ্ট্র উল্লেখযোগ্য কিছু করেছে কি?
প্রবাসীদের কল্যাণের জন্য সরকারি উদ্যোগ প্রায় নেই বললেই চলে। উল্টো প্রবাসীরা বিদেশের মাটিতেও নিজের দেশের সরকারের নানা এজেন্সির অব্যবস্থাপনা, অবহেলা এবং ক্ষেত্রবিশেষে অন্যায্য আচরণের শিকার। আর নিজের দেশে বেড়াতে কিংবা বিনিয়োগ করতে গিয়েও প্রবাসীদের হেনস্থা হওয়ার কাহিনী, লাঞ্চিত হওয়ার ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এদের স্বস্তি কিংবা নিরাপত্তা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ।
মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাত ব্যবসায়ীকে যেভাবে হয়রানী করা হয়েছে এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ব্যবস্থা তাদের প্রতি যে আচরণ করেছে তা যে কোন প্রবাসী বিশেষ করে পরবর্তী প্রজন্মকে বাংলাদেশ-বিমুখ করতে বাধ্য।
ইউরোপসহ যেসব দেশে প্রবাসীদের স্থায়ী হবার সুযোগ আছে সেসব দেশে বসবাসকারী তাদের প্রজন্মের কাছে বাংলাদেশ নিয়ে এমনিতেই ভাবার সুযোগ কম। তার ওপর এধরনের নেতিবাচক ঘটনা বাংলাদেশের ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রবাসীদের আরো বেশি আস্থাহীন করে তোলে।
আমরা মনে করি, বাংলাদেশে রেমিটেন্সের ভান্ডারে এই টান স্থায়ী হয়ে পড়লে দেশের অনেক কিছুতেই টান পড়বে। কারণ, রেমিটেন্সের প্রবাহ বাড়াতে সরকারি আড়াই টাকার প্রণোদনাই যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশকে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট থেকে উদ্ধার করতে এবং রেমিটেন্স প্রবাহকে সন্তোষজনক মাত্রায় ধরে রাখতে হলে বিদেশে অর্থপাচার বন্ধে কঠোর হতে হবে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তস্করদের লুটপাটের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। তা না হলে প্রবাসীরা যতই রেমিটেন্স পাঠান তা আবার দুর্নীতিবাজদের মাধ্যমে ডলার-পাউন্ড হয়ে বিদেশে চলে আসবে।
আমরা আশা করব প্রবাসী আয়ের এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সরকারের নীতি-নির্ধারক মহল উপলব্ধি করবে এবং দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে উদ্যোগী হবে।