বাংলাদেশে বিরোধী মত দমনের পাশাপাশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আর গুমকাণ্ডে সরকারের আইনশৃৃখলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত বিভিন্ন এজেন্সীর সংশ্লিষ্টতার গুরুতর নানা অভিযোগ বর্তমান সরকারকে দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক সমালোচনার মুখে রেখেছে। এসব কারণেই দেশটির র্যাব-পুলিশের শীর্ষ কর্তাদের বিদেশে নিষিদ্ধ হবার মতো লজ্জাজনক ঘটনাও ঘটে গেছে ইতোমধ্যে। কিন্তু সরকার এসবের কোনো তোয়াক্কা না করে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। কারণ, দেশের ভেতরে তো বটেই এবার বিদেশে থাকা সমালোচকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্যোগী হয়ে ওঠেছে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো।
মাস দুয়েক আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রালয়ের এক নয়া ফরমান জারির মধ্যদিয়েই প্রবাসে কণ্ঠরোধে পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানা গিয়েছিলো। দেশের জাতীয় গণমাধ্যমের খবর থেকে আমরা জেনেছি, পররাষ্ট্র বিষয়ক সংসদীয় কমিটির বৈঠকেই সেই পরামর্শমূলক সিদ্ধান্ত হয়েছিলো। ওখানে অবশ্য চতুরতার সঙ্গে ‘সরকারে’র আগে ‘দেশ’ জুড়ে দিয়ে ব্যাপারটিকে আপাতদৃষ্টিতে আইনসিদ্ধ করার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়েছে যা আবার অনেকেরই চোখ এড়ায়নি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে এম আবদুল মোমেন, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদসহ সংশ্লিষ্ট এমপিদের উপস্থিতিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র বিষয়ক সংসদীয় কমিটির ওই সুপারিশে বলা হয়েছিলো, বিদেশে বসবাসকারি কেউ দেশের সরকার এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করলে ওই ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনতে সংশ্লিষ্ট দেশেই আইনী ব্যবস্থা নিতে দূতাবাসকে ব্যবহার করা হবে। এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা নিশ্চিত করলেন।
সম্প্রতি সংসদে তিনি বলেছেন, যারা বিদেশে বসে দেশ ও সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত রয়েছে সরকার তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে কাজ করছে। গত ২রা নভেম্বর সংসদে দেয়া এই সম্পর্কিত বক্তব্যে তিনি বলেছেন, ‘যারা (বিদেশে অবস্থান করে) সরকার বিরোধী কর্মকাণ্ড, উসকানিমূলক ও বানোয়াট বক্তব্য প্রদানের সঙ্গে জড়িত, সরকার তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য কাজ করছে।’
আমরা জানি, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শুধু অপপ্রচার কেনো, রাষ্ট্রের সুনাম ক্ষুন্ন হয় কিংবা রাষ্ট্রীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় এমন তৎপরতা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বলে বিবেচিত হতে পারে এবং এর জন্য বিচার এবং শাস্তির ব্যবস্থা অবশ্যই থাকবে। কিন্তু এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে সরকারবিরোধীতাকে এক করে গুলিয়ে ফেলে পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার ও তার মন্ত্রণালয়। সরকারের যারা আজকে এই নীতি তৈরী করছেন তারা কি মনে করেছেন, তাদের চাতুর্য ধরতে মানুষ অক্ষম? এই সরকার কি সভ্য দুনিয়ার বাইরে অবস্থান করছে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যে কোন কাজ অপরাধ হলেও যে কোন দেশের সরকারের নীতির ও পদক্ষেপের সমালোচনা করা ও এর জনবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরোধীতা করা মানুষের মৌলিক অধিকার। এটি বেআইনী হতে পারে না।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসে থাকা বাঙালীদের অবদান কী ছিলো তা পঞ্চাশ বছর পর নতুন করে বলার দরকার নেই। বিলেত ছিল মুক্তিযুদ্ধের তৃতীয় ফ্রন্ট। প্রবাসীদের নানা অবদান যেমনি মুক্তিযুদ্ধে, তেমনি দেশ গঠনে আছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ও উন্নয়নে রয়েছে অব্যাহত বৈদেশিক মুদ্রার যোগান। সেই প্রবাসীদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলাও এক ধরনের ধৃষ্ঠতা।
আমরা বলতে চাই, প্রবাসীদের ওপর ক্ষমতাসীনদের যে কোন নির্বতনমূলক পদক্ষেপে দূতাবাস ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ব্যবহারের ফলাফল অশুভ হতে বাধ্য। যে দূতাবাসকে দেশ ও জাতির উন্নয়নে এবং প্রবাসীদের কল্যাণে কাজ করতে প্রণোদনা দেওয়ার কথা সেখানে প্রবাসীদের ‘শায়েস্তা’ করতে তাদেরকে নিজের দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ কেলেঙ্কারীজনক হবে।
আমরা আশা করবো, বাংলাদেশের সরকার তাদের এই পদক্ষেপ যে আইনবহির্ভূত তা দ্রুত অনুধাবনে সক্ষম হবে। পাশাপাশি এটিও অনুধাবন জরুরী যে, পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গেলে দেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরতে এবং অপপ্রচার মোকাবেলা করতে সরকারী উদ্যোগে সংবাদ ও নিবন্ধ প্রকাশে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের দ্বারস্থ হবার মতো পরিকল্পনা নিতে হয়।