পত্রিকা ডেস্ক ♦
লন্ডন, ০৯ জানুয়ারি: অবশেষে প্রকাশিত হয়েছে প্রিন্স হ্যারির আত্মজীবনীমূলক বই ‘স্পেয়ার’। এতে তিনি এমন সব কথা লিখেছেন যা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও আলোচনার তুঙ্গে এখন প্রিন্স হ্যারি। অকপটে সত্যি তুলে ধরায় অনেকেই তার প্রশংসা করছেন আবার কেউ কেউ তার লেখাকে ‘ছেলেমানুষি’ বলে সমালোচনাও করছেন।
আত্মজীবনী ‘স্পেয়ার’জুড়ে প্রিন্স হ্যারি তাঁর জীবনে মা ডায়ানা না থাকার কষ্টের কথা বলেছেন। ‘স্পেয়ার’ ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল না।
- ডায়ানার মৃত্যুর পর ঠিকমত কাঁদতেও পারেননি
- আমি কি তোমার আসল বাবা, বলেছিলেন চার্লস
- বাবার বিয়ের আগে ক্যামিলার সঙ্গে দেখা করেন দুই ভাই
- কলার চেপে ধরে মেঝেতে ফেলে দিয়েছিলেন উইলিয়াম
- আফগানিস্তানে ২৫ জনকে হত্যার কথা স্বীকার
- গোঁড়ামি থেকে মুক্ত করেছে মেগান
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্পেনে বইটির কিছু কপি আগেই বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর বইয়ের মূল বিষয় ফাঁস হয়ে যায়। ফলে স্পেনিশ ভাষা থেকে অনুবাদ করেই যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যমগুলো এ নিয়ে খবর প্রকাশ করতে শুরু করে। রাজ পরিবারের নানা বিস্ফোরক ঘটনা নিয়ে শুরু হয় তোলপাড়। বইটির প্রচারে অংশ হিসেবে প্রিন্স হ্যারি আইটিভিতে তিন পর্বের সাক্ষাতকারও দিচ্ছেন। প্রথম সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, ১৯৯৭ সালে মা ডায়ানা প্রিন্সেস অব ওয়েলসের মৃত্যুর পর মাত্র একবার কাঁদতে পেরেছিলেন। ওই সাক্ষাৎকারে সাংবাদিক টম ব্র্যাডবিকে হ্যারি বলেন, জনসম্মুখে শোক প্রকাশের সুযোগ তাঁদের ছিল না। যখন তাঁর মাকে সমাহিত করা হয়, তখন তিনি একবারই কাঁদতে পেরেছিলেন।
ডিউক অব সাসেক্স আরও বলেন, কেনসিংটন প্যালেসে ফুল ছড়ানো রাস্তায় ভিড়ের মধ্যে হাঁটার সময় তিনি নিজেকে অপরাধী ভাবছিলেন। আইটিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারটি আজ সন্ধ্যায় সম্প্রচার হওয়ার কথা। প্রিন্স হ্যারি বলেছেন, ১৯৯৭ সালের আগস্ট মাসে প্যারিসে গাড়ি দুর্ঘটনায় তাঁর মায়ের মৃত্যুর কয়েক দিন পর ভাইয়ের সঙ্গে তিনি শেষকৃত্যের ফুটেজটি দেখেছিলেন। হ্যারি বলেন, আমি সমাহিত করার স্থানে মাত্র একবার কেঁদেছিলাম। ‘স্পেয়ার’ বইতে এ নিয়ে বিস্তারিত আছে বলেন তিনি। কেনসিংটন প্যালেসের বাইরে হাঁটার সময় অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল এবং অপরাধবোধ হচ্ছিল, বলেন হ্যারি। তাঁর ধারণা উইলিয়ামেরও সে সময় একই অনুভূতি হচ্ছিল। প্রিন্স হ্যারি আরও বলেন, ‘আমাদের মায়ের কাছে ৫০ হাজার ফুলের তোড়া ছিল। আমরা সেখানে মানুষের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছিলাম। হাসছিলাম…।’
তিনি আরও বলেন, ‘যাদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছিলাম, তাদের হাত ভেজা ছিল। আসলে চোখের পানিতে তাদের হাত ভিজে গিয়েছিল।’ প্রিন্স হ্যারি আরও বলেন, ‘সবাই আমার মায়ের কাছের মানুষ ছিল। তবে আমার মায়ের সবচেয়ে কাছের দুজন, সবচেয়ে ভালোবাসার দুজন সেই মুহূর্তে কোনো আবেগ প্রকাশ করতে পারেনি।’
স্পেয়ারে হ্যারি বলেছেন, শেষকৃত্যে কীভাবে তিনি মায়ের কফিনের পেছনে পেছনে হেঁটেছিলেন। সেখানে ভিড় ছিল। আর অনেক মানুষের সামনে তিনি কাঁদতে পারেননি। প্যারিসে যেখানে মা মারা গিয়েছিলেন, সেই দুর্ঘটনাস্থলে সুড়ঙ্গের মধ্যদিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একজন চালককে পেয়েছিলেন বলেন হ্যারি। মায়ের মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পর হ্যারি বালমোরালে নিজের বিছানায় বসে পড়েছিলেন। তবে সে সময় বাবা তাঁকে জড়িয়ে ধরেননি। কোনো সান্তনাও দেননি। আত্মজীবনীতে হ্যারি দাবি করেছেন, তাঁর বাবা চার্লস বিশেষ করে মানসিক রোগীদের একটি আশ্রয়কেন্দ্র পরিদর্শনের গল্প বলতে পছন্দ করতেন। তিনি সেখানে একজন মানসিক রোগীর সঙ্গে দেখা করেন, যিনি নিজেকে প্রিন্স অব ওয়েলস দাবি করতেন। ওই সময় প্রিন্স অব ওয়েলস ছিলেন চার্লস নিজেই।
বাবার গল্পের স্মৃতিচারণ করে হ্যারি আত্মজীবনীতে লেখেন, ‘(চার্লস বলেন,) এমনকি আমি যে তোমার আসল বাবা কি না, কে জানে? প্রিয় বৎস্য, সম্ভবত তোমার বাবা আসলে ব্রডমুরেই আছেন!’ বাবার এমন কথাকে ‘তেতো স্বাদের’ কৌতুক হিসেবেই দেখেছেন হ্যারি। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, যে সময় এই কৌতুকটি করা হয়েছিল, তখন মেজর জেমস হিউইট তাঁর আসল বাবা বলে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছিল। হ্যারি লেখেন, ‘তিনি (হ্যারির বাবা) হাসি থামাতে পারছিলেন না। যদিও এটা আমোদিত হওয়ার মতো কোনো কৌতুক ছিল না। কারণ, ঠিক তখনই গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছিল আমার প্রকৃত বাবা আমার মায়ের সাবেক প্রেমিকদের একজন মেজর জেমস হিউইট।’
হিউইট ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অশ্বারোহী দলের সাবেক কর্মকর্তা ছিলেন। প্রিন্স হ্যারির মায়ের (ডায়ানা) সঙ্গে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি তাঁর প্রেমের সম্পর্ক ছিল। পার্টিতে পরিচয়ের সূত্র ধরে ডায়ানাকে ঘোড়ায় চড়া শেখানোর প্রশিক্ষক হন হিউইট। নিজের ‘প্রিন্সেস ইন লাভ’ বইতে হিউইট বলেছিলেন, দুজনের সম্পর্ক ১৯৮৬ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর টিকে ছিল। এমনকি চার্লসের স্ত্রী থাকা অবস্থায়ই ডায়ানার সঙ্গে এই প্রেমের সম্পর্ক ছিল। হ্যারি লেখেন, ‘আমার জন্মের দীর্ঘ সময় পরও মেজর হিউইটের সঙ্গে ডায়ানার দেখা হয়নি।’
এমন বাস্তবতা সত্ত্বেও তাঁর পিতৃত্বের বিষয় নিয়ে গুঞ্জন চাউর হয়েছিল বলে আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেন ব্রিটিশ রাজপরিবারের এই সদস্য। চার্লস-ক্যামিলার বিয়ে চাননি হ্যারি-উইলিয়াম দ্য সানের প্রতিবেদনে বলা হয়, বইয়ে হ্যারি লেখেন, তিনি ও তাঁর বড় ভাই উইলিয়াম চাননি তাঁদের বাবা চার্লসের সঙ্গে ক্যামিলার (বর্তমানে কুইন কনসোর্ট) বিয়ে হোক। তাঁদের আশঙ্কা ছিল, সৎমা হিসেবে ক্যামিলা খুব খারাপ হবেন। তাই তাঁরা তাঁদের বাবাকে অনুরোধ করেছিলেন তিনি যেন এ বিয়ে না করেন। শুধু বাবার সঙ্গেই নয়, বিয়ের আগে ক্যামিলার সঙ্গেও দেখা করেছিলেন দুই ভাই। তবে হ্যারি ও উইলিয়াম এটাও ভেবে রেখেছিলেন যে ক্যামিলা যদি চার্লসকে খুশি রাখতে পারেন, তবে তাঁরা মন থেকে তাঁকে ক্ষমা করে দেবেন। তবে যখন তাঁরা ক্যামিলার সঙ্গে দেখা করেছিলেন তখন হ্যারির বয়স কত ছিল, তা বিস্তারিতভাবে জানা যায়নি। বইয়ে হ্যারি আরও লেখেন, মা ডায়নার মৃত্যুর শোক কাটানোর উপায় খুঁজতে তিনি ‘অপার্থিব ক্ষমতা’-এর অধিকারী এক নারীর দ্বারস্থ হয়েছিলেন। ওই নারী বলেছিলেন, ‘তোমার মা বলেছে, তিনি যে জীবন কাটাতে পারেননি, সে জীবন তুমি কাটাচ্ছো। তিনি তোমার জন্য যেমন জীবন চেয়েছিলেন, তেমন জীবনই তুমি পেয়েছো।’
১৯৯৭ সালে প্যারিসে এক গাড়ি দুর্ঘটনায় নিহত হন ডায়না। তখন হ্যারির বয়স ছিল ১২ বছর। ২০০৫ সালে ক্যামিলাকে বিয়ে করেন চার্লস। হ্যারির বক্তব্যের বরাতে গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, অপার্থিব ক্ষমতাধর ওই নারীর মাধ্যমে প্রয়াত মায়ের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য তাঁর কথোপকথন হয়েছে। ওই নারীর সঙ্গে কোথায় ও কখন হ্যারির সাক্ষাৎ হয়েছে, সে ব্যাপারে বিস্তারিত জানা যায়নি। কলার চেপে ধরে মেঝেতে ফেলে দেন উইলিয়াম আত্মজীবনীতে বড় ভাই প্রিন্স অব ওয়েলস উইলিয়ামের বিরুদ্ধে শারীরিকভাবে জখমের অভিযোগ এনেছেন হ্যারি।
প্রিন্স হ্যারি লেখেন, অভিনেত্রী মেগান মার্কেলকে বিয়ে করায় দুই ভাইয়ের সম্পর্ক ভেঙে যায়। ২০১৯ সালে লন্ডনের প্রাসাদের ওই সংঘাতের কথা উল্লেখ করে হ্যারি লিখেছেন, মেগানকে ‘বাজে’, ‘বদরাগী’ ও ‘বেপরোয়া’ বলতেন উইলিয়াম। এসব অভিযোগকে ‘সংবাদমাধ্যমের শেখানো বুলি’ হিসেবে দেখতেন হ্যারি। একপর্যায়ে দুজনের মধ্যে এ সংঘাত চরম আকার ধারণ করে। হ্যারি লেখেন, উইলিয়াম ‘আমার কলার চেপে ধরে, গলার চেইন ছিঁড়ে ফেলে এবং…মেঝেতে ছিটকে ফেলে দেয়’। এতে পিঠে দৃশ্যমান জখম হয় হ্যারির। আফগানিস্তানে ২৫ জনকে হত্যার কথা স্বীকার আফগানিস্তানে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অ্যাপাচি হেলিকপ্টারে পাইলট হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় ২৫ জনকে হত্যা করেছেন প্রিন্স হ্যারি। আত্মজীবনীতে এ কথা স্বীকার করেছেন তিনি। বর্তমানে ৩৮ বছর বয়সী ডিউক অব সাসেক্স তালেবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আফগানিস্তানে দুই দফা দায়িত্ব পালন করেন। প্রথমবার ২০০৭-০৮ মেয়াদে বিমান হামলার ফরওয়ার্ড এয়ার কন্ট্রোলার কলিংয়ে দায়িত্ব পালন করেন প্রিন্স হ্যারি। পরে ২০১২-১৩ মেয়াদে অ্যাটাক হেলিকপ্টারের পাইলট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
প্রিন্স হ্যারি লেখেন, ‘আমার সংখ্যাটা ছিল ২৫। এটি এমন একটি সংখ্যা নয়, যা আমাকে তৃপ্ত করে, তবে এটি আমাকে বিব্রতও করে না।’ প্রিন্স হ্যারি বলেছেন, মেগানের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার আগে তিনি অনেক গোঁড়া ছিলেন। মেগানের সান্নিধ্য তাঁকে গোঁড়ামি থেকে মুক্ত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সম্প্রচারমাধ্যম সিবিএসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রিন্স হ্যারি এমন মন্তব্য করেছেন।
বিয়ে করার পর পারিবারিক বিরোধের জেরে ২০২০ সালে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে স্ত্রী মেগানকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান প্রিন্স হ্যারি। বিবাদ মিটিয়ে রাজপ্রাসাদে ফেরার ইচ্ছা নেই বলেও জানিয়েছেন তিনি। রাজপরিবারের বইটিতে প্রকাশিত তথ্যের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবে না বলে জানিয়েছে।