পত্রিকা প্রতিবেদন ♦
লণ্ডন, ১৫ মে: আবারও অসত্য তথ্য প্রচার করে চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিলেন যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম। সম্প্রতি যুক্তরাজ্য সফররত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের মধ্যকার ‘বৈঠক’ এবং দুই নেতার আলাপচারিতা নিয়ে গণমাধ্যমে যে ব্রিফিং দিয়েছেন হাইকমিশনার মুনা তাসনিম- ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় তার কোনোটিরই সত্যতা স্বীকার করেনি।
এর আগে বাংলাদেশে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে যুক্তরাজ্যের লণ্ডন আই-সহ বিভিন্ন নান্দনিক স্থাপনায় আলোকসজ্জার কৃতিত্ব দাবি করে তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম। তখন ব্রিটিশ-বাংলাদেশি বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের উদ্যোগে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে লণ্ডন আই-সহ বিভিন্ন স্থাপনায় আলোকসজ্জা করা হয়েছিলো। কিন্তু সাইদা মুনা তাসনিম সেটিকে হাইকমিশনের কর্মসূচীর অংশ দাবি করে তাদের উদ্যোগে ওইসব আলোকসজ্জা করা হয়েছিলো বলে কৃতিত্ব দাবি করেন। পরে তা অসত্য প্রমাণিত হয়।
এবার ব্রিটিশ-প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈঠক নিয়ে অসত্য তথ্য প্রচার করে বাংলাদেশের মর্যাদাহানির পাশাপাশি হাইকমিশনার হিসেবে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতাকে আবারও প্রশ্নবিদ্ধ করলেন সাইদা মুনা তাসনিম।
যুক্তরাজ্যের রাজ সিংহাসনের নতুন অধিপতি রাজা তৃতীয় চার্লসের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সম্প্রতি লণ্ডনে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই অনুষ্ঠানের বিশ্বের শতাধিক দেশের নেতারা হাজির হয়েছিলেন। অতিথি হিসেবে আগত বিশ্বনেতাদের সম্মানে গত ৫ই মে মার্লবারা হাউজে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা হয় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের। এই বৈঠক নিয়ে হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম গণমাধ্যমকে বলেন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একজন সফল অর্থনৈতিক নেতা হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন, আপনি আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা। আমি আপনাকে অনেক বছর ধরে অনুসরণ করছি। আপনি একজন সফল অর্থনৈতিক নেতা। দুই নেতার এই সাক্ষাতকে প্রথমে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক বলেও আখ্যায়িত করেন হাইকমিশনার। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তাঁর দুই মেয়ে ও স্ত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভক্ত। তিনি গত অক্টোবরে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে তাঁর মেয়েরা শেখ হাসিনার মতো মহান নেতা হবেন- এই কামনা করেছেন। সুনাক বলেছেন, আপনি আমার দুই মেয়ের জন্য মহান অনুপ্রেরণা।
দুই নেতার বৈঠক ৩৫ মিনিট স্থায়ী হয় বলেও দাবি করেন বাংলাদেশের হাইকমিশনার। হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিমের এমন ব্রিফিংয়ের ভিত্তিতে বাংলাদেশের সরকারী সংবাদ সংস্থা বাসস প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বাংলাদেশের অন্য সংবাদমাধ্যমগুলোও বাসস-এর ওই সংবাদ পুনঃপ্রকাশ করে। এরপর দ্রুত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক শেখ হাসিনার প্রশংসার বিষয়টি ভাইরাল হয়ে যায়।
কিন্তু দুই নেতার বৈঠক ও আলাপচারিতার বিষয়ে সাপ্তাহিক পত্রিকার পক্ষ থেকে জানতে চাইলে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় রাষ্ট্রদূত সাইদা মুনা তাসনিমের প্রচার করা কোনো বক্তব্যের সত্যতা স্বীকার করেনি। আনুষ্ঠানিক জবাবে তাঁরা বরং জানিয়েছে, যেসব দেশের সঙ্গে দ্বি-পাক্ষিক বৈঠক হয়েছে সেগুলোর ছবি ও সংবাদ বিজ্ঞপ্তি যুক্তরাজ্যের সরকারী ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা আছে। সেই ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বি-পাক্ষিক কোনো বৈঠকের খবর ব্রিটিশ সরকারের ওয়েবসাইটে নেই। অর্থাৎ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় শেখ হাসিনার সাথে ঋষি সুনাকের দ্বি-পাক্ষিক কোনো বৈঠক যে হয়নি সেটা সরাসরি বলতে চায়নি। এটি বোধগম্য যে, কূটনৈতিক শিষ্টাচার বজায় রেখে তারা বিষয়টি ‘নিজ দায়িত্বে বুঝে নেবার’ পথ প্রশ্নকারীকে বাৎলে দিয়েছে। এছাড়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বেশ কয়েকটি দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তোলা ছবি নিজের টুইটারে প্রকাশ করেছেন। কিন্তু শেখ হাসিনার সঙ্গে কোনো ছবিও সেখানে নেই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা নিয়ে ছড়ানো হাইকমিশনারের বক্তব্যের সত্যতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পরবর্তীতে আবারও সাপ্তাহিক পত্রিকার পক্ষ থেকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ইমেইল পাঠানো হয়। কিন্তু এর আনুষ্ঠানিক কোনো জবাব দেয়নি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। তবে একজন প্রেস অফিসার টেলিফোনে পত্রিকাকে বলেছেন, আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি নিয়ে কোনো জবাব দেয়া সম্ভব নয়। তবে তিনি বলেন, দুই প্রধানমন্ত্রীর সৌজন্য সাক্ষাতে পরস্পরের মধ্যে ব্যক্তিগতকী কথাবার্তা হয়েছে, সেসব নিয়ে মিডিয়া ব্রিফিং করা কোনো হাইকমিশনারের কাজ নয়। দুই দেশের মধ্যে যেকোনো আনুষ্ঠানিক বৈঠক নিয়ে যুক্তরাজ্য সরকার সাধারণত সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। আর যেসব প্রশংসার কথা বলা হচ্ছে সেগুলো দুই নেতার সৌজন্যমূলক আলাপের সঠিক প্রতিফলনও নয়। ওই প্রেস অফিসার আরও বলেন, মালবারা হাউজে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা নেতাদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করেছেন। সেখানে কোনো নেতার সঙ্গে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ৩৫ মিনিট ধরে বৈঠকের বিষয়টি বাস্তবসম্মত নয়। গত ৮ মে লণ্ডনে এক সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী ও উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানও নিশ্চিত করেন, দুই নেতার মধ্যে দ্বি-পক্ষিক বৈঠক নয়, সৌজন্য সাক্ষাত হয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একসাথে তিনটি হাই প্রোফাইল দেশ ভ্রমণ করেছেন। বিশ্বব্যাংকে অনুষ্ঠান করেছেন। রাজার আমন্ত্রণে যুক্তরাজ্যে এসেছেন। রাজার অনুষ্ঠানে প্রায় ১৪০টি দেশের নেতা ছিলেন। কিন্তু কয়েকজন নেতার সঙ্গে বসে কথা বলেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। যার মধ্যে আমাদের প্রধানমন্ত্রী একজন। এটাই তো আমাদের জন্য অনেক বড় ব্যাপার। কিন্তু হাইকমিশনার বাড়িয়ে বলতে গিয়ে এখন পুরো বিষয়টি বিতর্কিত করে ফেলেছে। তিনি একমত হন যে, হাইকমিশনারের অতিরঞ্জন ব্রিটিশ সরকারের কাছে বাংলাদেশ ও শেখ হাসিনার সরকারকে অসম্মানিত করেছে। একটি ভিডিওচিত্রে দেখা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ঋষি সুনাক একটি সোফায় পাশাপাশি বসে গল্প করছেন। ভিডিও চিত্রের কথপোকথন থেকে ধারণা করা যেতে পারে যে, তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোনঝি টিউলিপকে নিয়ে কথা বলছেন। শেখ হাসিনা লণ্ডনে কদিন থাকবেন এমন প্রশ্নও করতে শোনা যায় ঋষি সুনাককে। এ সময় বেশ হাসিখুশি দেখা যায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে।
সাইদা মুনা তাসনিমের বক্তব্য অসত্য প্রমাণিত হওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশনের বক্তব্য জানতে চেয়ে ইমেইল পাঠানো হয়েছিলো গত ৯ মে মঙ্গলবার। হাইকমিশনের মিনিস্টার প্রেসের সাথে ফোনেও যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এর কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে কমিউনিটির নেতৃস্থানীয় এক ব্যক্তি বলেছেন, দুটি দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যকার সাক্ষাৎ নিয়ে এধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদান কূটনৈতিকসুলভ তো নয়ই, বরং তা চরম দায়িত্বহীন আচরণ। এ ধরনের দায়িত্বহীন আচরণ বাংলাদেশ এবং সরকারের প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতি বৃহত্তর পরিসরে নতুন করে আস্থাহীনতা তৈরী করবে। তাঁর প্রশ্ন, এসব করে রাষ্ট্রদূত কী হাসিল করতে চেয়েছিলেন? তিনি আরো বলেন, অহেতুক এসব বিভ্রান্তি সৃষ্টির তৎপরতা বন্ধ করা উচিত। কারণ, তিনি আমাদের রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করেন। তাঁর কথাবার্তা অসত্য প্রমাণিত হলে তা আমাদের জাতিকে খাটো করে আর সেটি আমাদেরকে পীড়িত করে।