আজ থেকে চার দশকের বেশী কাল আগে এই মে মাসেই বর্ণবাদীদের নৃশংস আক্রমণে প্রাণ কেড়ে নিয়েছিলো আলতাব আলীর। সেই সময়ে রাস্তাঘাটে আক্রমণ ছিলো প্রতিদিনের ঘটনা। তবে ব্রিটেনের স্থানীয় নির্বাচনের দিন ১৯৭৮ সালের ৪ঠা মে’র নৃশংস বর্ণবাদী হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বাঙালি কমিউনিটিতে ভিন্ন মাত্রার জাগরণ সৃষ্টি করে।
১৯৭৮ সালের ৪ঠা মে পূর্ব লন্ডনের এডলার স্ট্রিটে কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে বর্ণবাদীরা আলতাব আলীকে খুন করে। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর জেগে ওঠে প্রবাসী বাঙালি। অন্যান্য অভিবাসীরাও বর্ণবাদী নির্যাতন-নিপীড়ন ও অধিকার আদায়ের দাবীতে সোচ্চার হয়। আলতাব আলী ছিলেন বাংলাদেশি এক ফ্যাক্টরি শ্রমিক ও অভিবাসী। সেই দিন হাইড পার্ক হয়ে ১০ ডাউনিং স্ট্রীটে তার প্রতীকী কফিনের মিছিলে শরীক হয়েছিলেন কমপক্ষে সাত হাজার মানুষ। এই ঘটনা অন্যায় আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে শান্তিপ্রিয় সকল মানুষকেই এক কাতারে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। শুরু হয় বর্ণবাদীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলার আরেক অধ্যায়।
বর্ণবাদীদের হামলায় আলতাব আলি শহীদ হওয়ার পর বিক্ষোভে ফেটে পড়েন বহু সংস্কৃতির সহাবস্থানের প্রতীক লন্ডনের হাজারো মানুষ। আলতাব আলীর মৃত্যুতে পূর্ব লন্ডনে যে গণজাগরণ সৃষ্টি হয় তারই হাত ধরে ধর্ম-বর্ণ-ভাষা নির্বিশেষে এই কমিউনিটি আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচার নতুন সংগ্রামে নেমেছিলো। নব্বই দশকেই যে জায়গাটিতে (তৎকালীন সেইন্ট মেরিজ গার্ডেন) আলতাব আলী শহীদ হয়েছিলেন সেখানেই নির্মিত হয়েছে আলতাব আলী পার্ক। বর্ণবাদের হিংস্র শিকার বাঙালি আলতাব আলীর স্মৃতিঘেরা মাটিতেই জায়গা নিয়েছে মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে প্রাণ দেয়া সাহসী সন্তানদের স্মারক। সেই পার্কেই এখন দাঁড়িয়ে আছে আমাদের গর্বের শহীদ মিনার। বলা যায়, আলতাব আলী পার্ক এখন বাঙালিদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়ার প্রেরণা, আন্দোলন-সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু।
আলতাব আলী যে বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় খুন হয়েছিলেন ৩২ বছর পর এক মে মাসে বর্ণবাদীদের মুখে ছাই দিয়ে সেই এলাকা থেকেই নির্বাচিত হয়েছিলেন প্রথম বাঙালি-ব্রিটিশ এমপি রুশনারা আলী। এরপর তাঁর পথ ধরে আরো তিন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপি টিউলিপ সিদ্দিক, রূপা হক ও আপসানা বেগম পার্লামেন্টে গেছেন। সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়ে এই টাওয়ার হ্যামলেটসেই রীতিমতো ধ্বংসাবশেষ থেকে ফিনিক্স পাখির মতো সাত বছর পর জনতার মেয়র হিশেবে বিপুল জয়ের গৌরব নিয়ে দায়িত্বে ফিরে এসেছেন লুৎফুর রহমান। তবে দিন দিন এদেশের রাজনীতিতে এই কমিউনিটির পদচারণা বৃদ্ধি আর ব্রিটিশ মূলধারার রাজনীতিতে বাংলাদেশি কমিউনিটির অভিষেক হয়েছে বলে বর্ণবাদ শেষ হয়নি। বরং রাজনীতিতে আমাদের ছোটখাটো সাফল্যে কোন কোন মহলের বিরাগভাজন হয়েছে এই কমিউনিটি। নতুন সময়ে অন্য রূপে আরও শক্তিশালী হয়ে জেঁকে বসেছে প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদ। এই বর্ণবাদের নখর রাস্তার স্কিনহেডদের অস্ত্র থেকেও ভয়ঙ্কর। এটি দেখা যায় না, কিন্তু যে বা যারা এর আক্রমণের শিকার হন তারা টের পান এটি কত ভয়াবহ। প্রাতিষ্ঠানিক এই বর্ণবাদের অদৃশ্য দীর্ঘ হাতটি দেখতে আমাদের সক্ষম হতে হবে। আর এই সক্ষমতা অর্জন করলেই কেবল এর মোকাবেলা করা সম্ভব।
সুতরাং বর্ণবাদ-বিরোধী আন্দোলনের প্রতীক শহীদ আলতাব আলীর এবারের মৃত্যুবার্ষিকে আমাদের প্রত্যয় হোক- ঐক্যবদ্ধভাবে প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদ আর বৈষম্যের মোকাবেলা। আর আমরা যেন আলতাব আলীকে শ্রদ্ধা আর মমতার সাথে স্মরণে রাখি। এটি শহীদ আলতাব আলীর জন্য যতটুকু জরুরী তার চেয়ে বেশী জরুরী আমাদের নিজেদের সুরক্ষার জন্য কারণ, বর্ণবাদের অদৃশ্য দীর্ঘ হাতের কারসাজি থেমে নেই। আলতাব আলীরা যে আমাদের জন্য বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সজাগ থাকার প্রেরণা!