কামরুজ্জামান ♦
লণ্ডন, ১০ এপ্রিল: যুক্তরাজ্যে শরণার্থীদের অনুপ্রবেশ বেড়েই চলছে। হোম অফিসের হালনাগাদ তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২২ সালে এর আগের বছরের তুলনায় যুক্তরাজ্যে শরণার্থীর সামগ্রিক অনুপ্রবেশ বেড়েছে ৪৭ শতাংশ, যা কয়েক বছরের মধ্যে রেকর্ড। এসব অনুপ্রবেশকারীদের ৮৫ শতাংশ এসেছে ছোট নৌকায় চেপে।
যার ফলে ২০২২ সালে নৌকায় করে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে যুক্তরাজ্যে অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যাও বহুগুণ বেড়ে গেছে। ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে নৌকায় আসা শরণার্থীর সংখ্যা বেড়েছে ৬০ শতাংশ। জীবন বাজি রেখে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমানো এসব মানুষের বেশির ভাগই আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের নাগরিক।
গত ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে প্রকাশিত হোম অফিসের হালনাগাদ তথ্য বিশ্লেষণ করে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। হোম অফিসের প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, নৌ, আকাশপথসহ বিভিন্ন উপায়ে অবৈধভাবে গত বছর যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করে ৫৪ হাজার ৯০ জন, যা আগের বছর ছিল ৩৬ হাজার ৮১৩। ২০২২ সালের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি থেকে মার্চ) ৬ হাজার ৮৫৫ জন, পরের তিন মাসে (এপ্রিল থেকে জুন) ১০ হাজার ১৪৮ জন, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর-এই তিন মাসে সবচেয়ে বেশি ২২ হাজার ৩৯৭ এবং শেষের তিন মাসে অর্থাৎ- অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে ১৪ হাজার ৬৯০ জন মানুষ যুক্তরাজ্যে ঢুকেছেন কোনো বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই।
হোম অফিসের তথ্যমতে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে নৌকায় করে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে যুক্তরাজ্যে আসার প্রবণতা সাম্প্রতিক সময়ে অনেক বেড়েছে। গত বছর ছোট নৌকায় করে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে ৪৫ হাজার ৭৫৫ জন ব্রিটেনে প্রবেশ করে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসেছে উত্তর আফ্রিকা, সাব-সাহারা অঞ্চল এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে; ১৯ হাজার ৬৭৭ জন। উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসেছে সুদান থেকে; ১ হাজার ৭০৪ জন এবং মিসর থেকে পাড়ি জমিয়েছে ১ হাজার ১৬০ জন। সাব-সাহারা অঞ্চলের মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইথিওপিয়া ও প্রতিবেশি ইরিত্রিয়া থেকে বেশি মানুষ ব্রিটেনে এসেছে ছোট নৌকায় চেপে। যুদ্ধ থেকে প্রাণ বাঁচাতে জীবন বাজি রেখে তারা উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছেন উন্নত জীবনের আশায়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ইরাক, ইরান, লেবানন এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া ও ইয়েমেন থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষ যুক্তরাজ্যে ঢুকেছে নৌকায় করে। গত বছর ইরান থেকে নৌকায় করে ৫ হাজার ৬৪২ জন, ইরাক থেকে ৪ হাজারর ৩৭৭ জন, সিরিয়া থেকে ২ হাজার ৯১৬ জন, কুয়েত থেকে ৩৮২ এবং ইয়েমেন থেকে ১৫৩ জন যুক্তরাজ্যে অনুপ্রবেশ করে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ ইউরোপের যেসব দেশে পাড়ি জমাচ্ছে, তার মধ্যে যুক্তরাজ্য অন্যতম। ইউরোপের অন্য দেশগুলোতে থেকেও যুক্তরাজ্যে অবৈধ প্রবেশ থেমে নেই। গত বছরও ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছোট নৌকায় করে ব্রিটেনে প্রবেশ করে ১৩ হাজার ৭১৩ জন। হোম অফিসের তথ্য বলছে, ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে আলবেনিয়া থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষ অবৈধভাবে নৌকায় করে যুক্তরাজ্যে এসেছে। গত বছর দেশটি থেকে ১২ হাজার ৩০১ জন যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। দেশটি থেকে শুধুমাত্র গত বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে- তিন মাসে ৯ হাজার ৩৭ জন যুক্তরাজ্যে অনুপ্রবেশ করেছে। এরপর তুরস্ক থেকে ১ হাজার ৭৬ জন অবৈধ অভিবাসী হিসেবে যুক্তরাজ্যে আসেন।
এশিয়া থেকেও আসছেন আশ্রয়প্রার্থীরা গত বছর এশিয়ার দেশগুলো থেকে ছোট নৌকায় করে অবৈধভাবে ব্রিটেনে ঢুকেছে ১০ হাজার ১৯৭ জন যার বেশির ভাগ এসেছে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান (৮ হাজার ৬৩৩ জন) থেকে। দেশটি থেকে পশ্চিমা দেশগুলোর সেনা প্রত্যাহার ও তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর আফগানদের দেশ ছাড়ার প্রবণতা বেড়েছে। নৌকায় ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে যুক্তরাজ্যে অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও ভিয়েতনামের নাগরিকেরাও রয়েছে।
যুক্তরাজ্যে অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা মাইগ্রেন্ট ভয়েসের চেয়ারপারসন হাবিবুর রহমান সাপ্তাহিক পত্রিকাকে বলেন, যুক্তরাজ্যে বৈধ অভিবাসীর পাশাপাশি অবৈধ অভিবাসীর সংখ্যা বেড়েছে। চাহিদা রয়েছে এমন সেক্টরে কর্মী নিয়োগ ভিসায় এবং স্টুডেন্ট ভিসায় অনেক লোক যুক্তরাজ্যে এসেছেন বৈধভাবে। তেমনি ইউক্রেন যুদ্ধ এবং আফগানিস্তান সংকটের কারণে যুক্তরাজ্যে অনুপ্রবেশ বেড়েছে। এ ছাড়া আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পীড়িত মানুষ আশ্রয়ের আশায় ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রপথে অবৈধ উপায়ে যুক্তরাজ্যে আসছেন।
আরও যেভাবে যুক্তরাজ্যে আসছে মানুষ পর্যাপ্ত কাগজপত্র ছাড়া অথবা ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে আকাশপথে যুক্তরাজ্যে অনুপ্রবেশের ঘটনাও ঘটছে, যা ২০২২ সালে ছিল ৪ হাজার ৫৬৯ জন। আকাশপথের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রবেশ ঘটেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরান থেকে, ১ হাজার ৩৯১ জন। এরপর আছে ইউরোপের দেশ জর্জিয়া থেকে ৮০৮ জন এবং আলবেনিয়া থেকে ৬৬০ জন আকাশপথে অবৈধভাবে যুক্তরাজ্যে ঢোকে। জাহাজে করেও ব্রিটেনে অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে। তবে এই প্রবণতা অন্য উপায়ের চেয়ে অনেক কম। গত বছর জাহাজে চেপেঅবৈধভাবে ব্রিটেনে আসা মানুষের সংখ্যা ছিল ৩১০ জন যার বেশির ভাগই উত্তর আফ্রিকা ও ইউরোপের নাগরিক। এ ছাড়া সীমান্তরক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে গত বছর যুক্তরাজ্যে অনুপ্রবেশকারী ৩ হাজার ৪৫৬ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। এই ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে যুক্তরাজ্যের হোম অফিসের প্রেস অফিসের এক কর্মকর্তা বলেছেন, সব ধরনের অনুপ্রবেশের ব্যাপারে তারা নিরুৎসাহিত করে। এ জন্য তারা প্রচারণার পাশাপাশি নিরাপত্তা জোরদার করেছে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আশ্রয় আবেদন যুক্তরাজ্যে অনুপ্রবেশের সঙ্গে হু হু করে বাড়ছে আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা। যুক্তরাজ্যের হাউস অব কমন্স লাইব্রেরি গত ১ মার্চ এ বিষয়ে হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করে। সেখানে দেখা গেছে, ২০০২ সালের পর থেকে ২০২২ সালে সবচেয়ে বেশি ৭৪ হাজার ৭৫১টি আশ্রয় আবেদন পড়েছে। এসব আবেদনে ৮৯ হাজার ৩৯৮ জন যুক্তরাজ্যে থাকার আবেদন করেন। ২০০২ সালে এই আবেদনের সংখ্যা ছিল ৮৪ হাজার ১৩২টি। যদিও গত ২০ বছরের মধ্যে ২০১০ সালে এই আবেদনের সংখ্যা ছিল সর্বনিম্ন- ১৭ হাজার ৯১৬ জন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হোম অফিসের প্রেস অফিসের এক কর্মকর্তা বলেছেন, আশ্রয়প্রার্থীদের রুয়ান্ডায় পাঠানোর বিষয়টি জোর দিয়ে বিবেচনা করা হচ্ছে। আদালতের আপত্তি না থাকলে হোম অফিস শীঘ্রই এই প্রক্রিয়া শুরু করতে চায়।
প্রসঙ্গত, যুক্তরাজ্যের সরকার আশ্রয়প্রার্থীদের আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডায় পাঠানোর পরিকল্পনা করছে। যদিও আদালত সরকারের সেই পরিকল্পনাকে অবৈধ বলে রায় দিয়েছেন। সরকার আদালতের সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করেছে। এখন আপিল সুরাহার ওপর নির্ভর করছে সরকারের সেই পরিকল্পনা কার্যকর হবে কি-না।