ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলে জোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বাধ্য হয়ে সরকার ওই আইনটি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়। এর পরিবর্তে সাইবার নিরাপত্তা আইন নামে নতুন একটি আইন করার উদ্যোগ নিয়েছে। সরকার পূর্বতন আইনের অজামিনযোগ্য আটটি ধারাকে জামিনযোগ্য ও কিছু ধারায় শাস্তি কমানোর কথা বলেছিল। কিন্তু মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের যে খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে, সেটির সঙ্গে পূর্বতন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খুব একটা পার্থক্য নেই। যেন নতুন নামে কুখ্যাত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন চালিয়ে নিতে চাইছে সরকার।
প্রস্তাবিত বিলটি ইতিমধ্যে জাতীয় সংসদে উত্থাপনও করা হয়েছে। এই বিল আবার পাঠানো হয়েছে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে। পাঁচ দিনের মধ্যে কমিটির পর্যবেক্ষণ জানানোর কথা। কিন্তু প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩-এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন দিতে অংশীজনদের সঙ্গে কোনো কথাই বলেনি সরকার।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে যখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হয়, তখন সংবাদমাধ্যমের অংশীজনসহ দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলো জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছিল। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা তা আমলে নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি।
সরকারের পক্ষ থেকে বার বার বলা হয়েছিল, ডিজিটাল মাধ্যমের অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্যই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা ডিএসএ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখেছি এটি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ ও ভিন্নমত দমনের কাজেই ব্যবহৃত হয়েছে। সংসদে আইনমন্ত্রীর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৭ হাজার ১টি মামলা হয়েছে। এ আইনে কতজনকে আটক করা হয়েছে, তা তিনি জানাতে পারেননি। মানবাধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন আর্টিকেল ১৯-এর তথ্য অনুযায়ী, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গত প্রায় সাড়ে তিন বছরে ১১৫টি মামলায় ২২৯ সাংবাদিককে আসামি করা হয়েছে।
গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৫৬ জনকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মামলা করার পরপরই যাচাই-বাছাই ছাড়া আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়।
সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিসের (সিজিএস) বিশ্লেষণে দেখা যায়, ডিএসএর মামলার মধ্যে ২৭ দশমিক ৪১ শতাংশ মামলা হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে।
প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কটি অজামিনযোগ্য ধারাকে জামিনযোগ্য করা হয়েছে। কিছু ধারায় শাস্তির পরিমাণ কমানো হয়েছে। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন না হওয়ায় সংবাদমাধ্যমের অংশীজনসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের উদ্বেগ থেকেই যাবে।
সবচেয়ে বড় উদ্বেগেরে বিষয় হলো- সাইবার বা ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য এই আইনের কথা বলা হলেও ভিন্নমত দমনে এই এই আইন ব্যবহারের সুযোগ আবারও থেকে যাচ্ছে।
অংশীজনদের তোয়াক্কা না করে সাইবার নিরাপত্তা আইনের খড়সা চ‚ড়ান্ত করায় স্পস্ট হয়েছে যে ভিন্নমত দমনের অস্ত্র হিসেবে এই আইনের ব্যবহার নিয়ে সরকারের মানসিকতার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।
আমরা কিছুদিন আগে সরকারী ওয়েবসাইট থেকে কোটি কোটি মানুষের তথ্য চুরির ঘটনায় দেখেছি – বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটা ভঙ্গুর। ওই ঘটনায় দ্বায়িত্বশীল কাউকে বিচারের মুখোমুখি করতে দেখিনি।
বাংলাদেশে ডিজিটাল কিংবা সাইবার নিরাপত্তার জন্য অবশ্যই একটি আইনের প্রয়োজন। কিন্তু ভিন্নমত দমনের অস্ত্র হিসেবে যদি ওই আইন করা হয় তাহলে সেটি রাষ্ট্রের ও জনগণের প্রকৃত কোনো কাজে আসবে না।