পত্রিকা ডেস্ক ♦
লণ্ডন, ০৬ নভেম্বর: ফিলিস্তিনের গাজায় গত এক মাস যাবত যে গণহত্যা, বর্বরতা, বোমা হামলা ও ধংসযজ্ঞ চালাচ্ছে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ইসরাইল, তা বিশ্ববাসী আগে কখনো দেখেনি। হাসপাতাল, অ্যাম্বুলেন্স, স্কুল, মসজিদ, গির্জা, শরণার্থী কেন্দ্র, আবাসন- কোনো কিছুই রেহাই পাচ্ছেনা বর্বর ইসরাইলি বাহিনীর হাত থেকে। প্রতিদিন শত শত নারী, শিশুকে হত্যা করা হচ্ছে বিশ্ববাসীর চোখের সামনে। এর পাশাপাশি গত ৭ অক্টোবর হামলা শুরুর পর থেকে গাজায় পানি, বিদ্যুত, তেল, ও খাবার সরবরাহ বন্ধ করে রেখেছে দখলদার ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ইসরাইল। জাতিসংঘ বলছে, গাজার পরিস্থিতি মানবিক বিপর্যয়কেও ছাড়িয়ে গেছে।
শুধু গাজাবাসী নন, জাতিসংঘের কর্মী, সংবাদকর্মী, চিকিৎসক কিংবা দাতব্য সংস্থার কর্মী কেউ রেহাই পাচ্ছে না সন্ত্রাসী ইসরাইল রাষ্ট্রের হামলা থেকে। জাতিসংঘ জানিয়েছে তাদের ৮৮ জন কর্মী গত এক মাসে গাজায় নিহত হয়েছে। বিশ্বের যে কোনো সংঘাত বিবেচনায় এটি জাতিসংঘের সর্বোচ্চ কর্মী হত্যার ঘটনা।
ইসরাইলের হামলা শুরুর পর ৩১ দিনে গাজা উপত্যকায় মোট ১৭৫ জন চিকিৎসাকর্মী ও ৩৪ জন নাগরিক সুরক্ষাকর্মী নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রী মাই আল-কায়লা। গাজা উপত্যাকা লণ্ডন শহরের চাইতেও ছোট। সেখানে প্রায় ২৩ লাখ ফিলিস্তিনির বসবাস। এমন ঘনবসতিপূর্ণ ছোট্ট এলাকাটিতে ইসরাইল যে মাত্রার বোমা হামলা চালিয়েছে, তা প্রথম কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরও সময়েও ঘটেনি। ইতিমধ্যে গাজার অর্ধেকের বেশি ঘর-বাড়ি গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আর এসব কিছুই চলছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ এর মিত্রদের সরাসরি সমর্থনে।
রাশিয়ার আগ্রাসনের মুখে ইউক্রেনের পক্ষে মরিয়া হয়ে মাঠে নামা যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য এখন ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি গণহত্যাকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিচ্ছে। ইউক্রেনের নিপীড়িত মানুষের জন্য যুক্তরাজ্যের যে মায়াকান্না এবং উদার শরণার্থী ব্যবস্থা তার বিপরীতে ফিলিস্তিনিদের ওপর চালানো বর্বর হামলায় সমর্থন যুক্তরাজ্যের জন্য বড়ই বেমানান। শুধু সমর্থনই নয়, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের পাঠানো অস্ত্রে গাজায় চলছে বর্বর বোমা হামলা। ধংসস্তুপে পরিণত হয়েছে সমস্ত গাজা। গত এক মাসে প্রায় ১০ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে। এরমধ্যে শিশু আছেন ৪ হাজারের বেশি। আহত হয়েছে ৩০ হাজারের বেশি। আর বাস্তুচ্যুত গাজাবাসীর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। সারা বিশ্বের জনগণ সন্ত্রাসী রাষ্ট্র খ্যাত ইসরাইলের নজিরবিহীন বর্বরতার ধিক্কার জানাচ্ছে। লণ্ডনের রাস্তায় চলছে বিক্ষোভ। কিন্তু তবুও ঋষি সুনাক যুদ্ধ বন্ধের আহবান জানাতে নারাজ। উলটো ফিলিস্তিনিদের পক্ষে মিছিল-সমাবেশ বন্ধ করার জন্য নানা পায়তারা চালাচ্ছে।
প্রায় এক মাস ধরে চলা সংঘাতে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকাকে কার্যত দুই ভাগ করে ফেলেছে ইসরাইলি বাহিনী। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র দানিয়েল হাগারি গত রোববার এ তথ্য জানিয়েছেন। এ বিষয়ে দানিয়েল বলেন, গাজা সিটিকে চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে ইসরাইলি বাহিনী। এর মধ্য দিয়ে গাজা এখন উত্তর ও দক্ষিণ-দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি বাহিনীর নির্বিচার বিমান হামলা ও বৃষ্টির মতো বোমাবর্ষণে বিপর্যস্ত সেখানকার মানুষ। প্রাণভয়ে এর মধ্যে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন। জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ) জানিয়েছে, গাজা উপত্যকায় ২৩ লাখ মানুষের বসবাস। ৭ অক্টোবর ইসরায়েলি হামলা শুরুর পর থেকে সেখানকার প্রায় ১৫ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, যা গাজার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৫ শতাংশ। দুই মেরুতে যুক্তরাষ্ট্র ও আরব বিশ্ব ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় ফিলিস্তিনের গাজায় সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়ের লাগাম টানা নিয়ে এখনো বিপরীত মেরুতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও আরব বিশ্ব। গাজায় মানবিক যুদ্ধবিরতির দাবি জানিয়ে আসছে আরব দেশগুলো। তবে ইসরায়েলের সঙ্গে সুর মিলিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। রোববার পশ্চিম তীরের রামাল্লায় ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে বৈঠক করেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। বৈঠকে গাজায় অনতিবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান আব্বাস। তবে মানবিক সহায়তা সরবরাহে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকারের কথা পুনর্ব্যক্ত করলেও যুদ্ধবিরতি নিয়ে কিছু বলেননি ব্লিঙ্কেন। আগের দিন জর্ডানের রাজধানী আম্মানে আরব নেতা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেন ব্লিঙ্কেন। বৈঠকে গাজায় অবিলম্বে মানবিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান আরব প্রতিনিধিরা। এ সময় ‘মানবিক বিরতির’ পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কথা তোলেন ধরেন শীর্ষ এই মার্কিন কূটনীতিক। তবে যুদ্ধবিরতির আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেন, যুদ্ধবিরতি হামাসকে পুনর্গঠিত হতে সাহায্য করবে।
এক পরিবারের ২১ সদস্য নিহত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ সত্ত্বেও গাজায় নির্বিচার হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েল। শনিবার দিবাগত রাতে আল-মাগাজি শরণার্থীশিবিরে হামলায় কমপক্ষে ৪০ জন নিহত হন। নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। আগের দিনই অ্যাম্বুলেন্স বহর ও আশ্রয়শিবিরে ইসরায়েলি হামলায় কমপক্ষে ৩০ জন প্রাণ হারান। এদিকে গাজায় পৃথক ইসরায়েলি হামলায় এক পরিবারের ২১ সদস্য নিহত হয়েছেন।
পারমাণবিক বোমা হামলা বিবেচনার পক্ষে ইসরায়েলি মন্ত্রী ইসরায়েলের মন্ত্রী অ্যামিচে এলিয়াহু এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, হামাসের হামলার পর ইসরায়েল যে পরিসরে পাল্টা হামলা চালাচ্ছে, তাতে তিনি পুরোপুরি খুশি নন। তিনি গাজার সবাইকে হত্যা করতে সেখানে পারমাণবিক বোমা ফেলার পক্ষে।
এনিয়ে তুমুল সমালোচনার মুখে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় থেকে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়। তাতে বলা হয়, এলিয়াহুর মন্তব্য ‘বাস্তবতাবহির্ভূত’। গাজার যেসব বাসিন্দা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন না, তাঁদের প্রাণ রক্ষার চেষ্টা করছে ইসরায়েল। মুসলিম উম্মাকে একত্রিত হওয়ার আহ্বান হানিয়ের মুসলিম উম্মাহকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ফিলিস্তিনের যোদ্ধাগোষ্ঠী হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ে। রোববার কাতারে তিনি ও হামাসের সাবেক প্রধান খালেদ মিশালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন পাকিস্তানের জমিয়তে উলেমায়ে ইসলাম ফজলের (জেইউআইএফ) প্রধান মাওলানা ফজলুর রেহমান। এ সময় ইসমাইল হানিয়ে ওই আহ্বান জানান।
মাওলানা ফজলুর রেহমান কাতারে বসে আরব নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে গাজায় ত্রাণ পৌঁছানোর পথ বের করার আশা করছেন। কারণ, ৭ই অক্টোবর রকেট হামলার জবাবে গাজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করছে ইসরাইল। তাদের হামলা অব্যাহত রয়েছে। জেইউআইএফ মুখপাত্র আসলাম ঘৌরি বলেছেন, উভয় পক্ষ ফিলিস্তিন ইস্যু নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছে। আলোচনায় পাকিস্তানের এই বর্ষীয়ান রাজনীতিক ও হামাস নেতৃত্বের মধ্যে বিভিন্ন ইস্য্যুতে কথা হয়। এক্সে দেয়া পোস্টে মাওলানা ফজল বলেন, গাজায় ইসরাইলের নৃশংসতার প্রেক্ষিতে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন তিনি। একই সঙ্গে হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। বৈঠকে ইসমাইল হানিয়ে ইসরাইলের আগ্রাসনের মুখে মুসলিম উম্মাকে একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, এটা মুসলিম উম্মাহর দায়িত্ব। অন্যদিকে কাশ্মীরে চলমান নৃশংসতার বিষয় জোর দিয়ে তুলে ধরেন হামাসের সাবেক প্রধান খালেদ মিশাল। তাদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মিশে যায় মাওলানা ফজলুর দৃষ্টিভঙ্গি। তারা বলেন, নিরীহ শিশু ও নারীদের রক্তে রঞ্জিত উন্নয়নশীল বিশ্বের হাত। খালেদ মিশাল পাকিস্তানে মাওলানা ফজলুর প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন। বলেন, তিনি পাকিস্তানে ফিলিস্তিনি দূতের মতো ভূমিকা রাখছেন।
ফিলিস্তিনিরা অসহনীয় যন্ত্রণার মধ্যে আছে
ওবামা সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, গত ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে যে হামলা চালিয়েছে, তা ভয়ংকর। তবে তিনি মনে করেন গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে যা চলছে তা ‘অসহনীয়’ যন্ত্রণা। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একপেশে তথ্য ছড়ানো হচ্ছে উল্লেখ করে এর সমালোচনা করেছেন ওবামা। পড সেভ আমেরিকা পডকাস্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ওবামা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের যদি গঠনমূলক কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ থাকে, তবে তা নিতে বলব। বাস্তব পরিস্থিতি আমাদের স্বীকার করতে হবে। যা কিছু ঘটছে তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত থাকতে পারে, তা আমাদের মেনে নিতে হবে। হামাস যা করেছে, তা ভয়ংকর। একে ন্যায্য বলে দাবি করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এটাও সত্য যে ফিলিস্তিনে যে দখলদারি চলছে এবং ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে যা কিছু ঘটছে, তা অসহনীয়।’ সাক্ষাৎকারে ওবামা আরও বলেন, আরেকটি বাস্তবতা হলো দাদা-দাদি, নানা-নানি, প্রপিতামহ, প্রপিতামহী কিংবা মামা-খালা, চাচা-ফুফুদের কাছ থেকে যদি আপনারা ইহুদিবিদ্বেষী উন্মাদ আচরণের গল্প না শুনে থাকেন, তবে আপনারা ইহুদিদের ইতিহাসকে মেনে নিতে পারবেন না। এটাও সত্য যে গাজায় ফিলিস্তিনিরাসহ যারা প্রাণ হারাচ্ছে, তাদেরও হামাসের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে কিছু করার ছিল না। টিকটকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাস্তব পরিস্থিতি উপেক্ষা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন ওবামা। ওবামা বলেন, ‘আপনারা সত্য বলার ভান করতে পারেন, আপনারা যা ঘটছে তা নিয়ে একপেশে কথা বলতে পারেন এবং কিছু ক্ষেত্রে আপনারা আপনাদের নৈতিক অবস্থান থেকে সরে থাকতে পারেন। কিন্তু তাতে কোনো কিছুর সমাধান হবে না। সুতরাং সমস্যার সমাধান করতে চাইলে আপনাদের পুরো ঘটনাকে সত্যভাবে উপস্থাপন করতে হবে। আপনাদের স্বীকার করতে হবে যেকোনো পক্ষই একেবারে নির্দোষ নয়। আর এর সঙ্গে আমরাও কোনো না কোনোভাবে জড়িত।’