পত্রিকা প্রতিবেদন ♦
লণ্ডন, ১৩ ফেব্রুয়ারি: ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় চার্লস ঘুরে গেলেন বাঙালী পাড়া। যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশী কমিউনিটির প্রাণকেন্দ্র বাংলা টাউনে এক ঘন্টা বিশ মিনিটের সফরে এসেছিলেন তিনি স্ত্রী কুইন কনসর্ট ক্যামিলাকে সঙ্গে নিয়ে। বাঙালীর গৌরবময় ভাষার মাস ফেব্রুয়ারীর ৮ তারিখে এই রাজকীয় সফরের শুরু হয় শহীদ মিনারে কমিউনিটির নানা পেশার মানুষের সাথে কুশল বিনিময় আর সংক্ষিপ্ত আলাপচারিতার মধ্যদিয়ে।
বর্ণবাদী হামলায় নিহত আলতাব আলী স্মরণে বৃক্ষরোপণ
সফরের শুরু শহীদ মিনারে সমাপ্ত হলো মসজিদ পরিদর্শনের মধ্যদিয়ে
উল্লেখ্য, বাঙালির বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামের স্মারক আলতাব আলী পার্কে অবস্থিত বাংলা ভাষার সংগ্রাম, ত্যাগ আর ঐতিহ্যের প্রতীক এই শহীদ মিনার। শহীদ মিনার থেকে বেরিয়ে গাড়িযোগে বাংলা টাউন গেইট এরপর ব্রিকলেন ধরে হেঁটে গিয়ে ঐতিহ্যবাহী গ্রাম বাংলা রেস্টুরেন্ট পরিদর্শন শেষে তিনশ’ বছরের ইতিহাসসমৃদ্ধ ভবনে বর্তমানে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থনাকেন্দ্র ব্রিকলেইন জামে মসজিদ পরিদর্শনের মধ্যদিয়ে শেষ হয় রাজার বাংলা পাড়া সফর।
বাকিংহাম প্যালেসের ঘোষিত সফরসূচী অনুযায়ি সকাল ১১টায় রাজা ও কুইন কনসর্ট এসে পৌঁছান আলতাব আলী পার্কের ফটকে। সেখানে তাঁদের স্বাগত জানান রাজ প্রতিনিধি গ্রেটার লণ্ডনের লর্ড লেফটেন্যান্ট স্যার কেনেথ ওলিসা ওবিই। তিনি এ সময় টাওয়ার হ্যামলেটস বারার স্পীকারকে রাজার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। তার সাথে উপস্থিত ছিলেন টাওয়ার হ্যামলেটসের বারার ডেপুটি লেফটেন্যান্ট ড. আব্দুল বারী এমবিই। টাওয়ার হ্যামলেটসের স্পীকার কাউন্সিলার শাফি আহমদ এবং নির্বাহী মেয়রের প্রতিনিধি ডেপুটি মেয়র মাইয়ুম তালুকদার রাজ-অতিথিদের স্বাগত জানান। এর পরই বাংলা পাড়ায় রাজা ও কুইন কনসর্টকে স্বাগত জানান সফরের আয়োজক প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ বাংলাদেশী পাওয়ার এণ্ড ইন্সপিরেশন (বিবিপিআইয়ের) প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি আয়েশা কোরেশী এমবিই জেপি ও কাউন্সিলার আবদাল উল্লাহ। রাজা ও কুইন কনসর্ট এরপর আলতাব আলী পার্কে অপেক্ষমান আমন্ত্রিত অতিথিদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় ও করমর্দন করেন। রাজ অতিথিরা এরপর চলে আসেন শহীদ মিনারের মূল চত্বরে। এ সময় মালবেরী স্কুল এবং লণ্ডন এন্টারপ্রাইজ একাডেমীর শিক্ষার্থীরা ব্রিটেনের জাতীয় পতাকা নেড়ে তাঁদেরকে স্বাগত জানায়।
এখানে রাজা ও কুইন কনসর্টের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় ৭০-এর দশকে লণ্ডনে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়া ব্যক্তিবর্গ, স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা, বাংলা মিডিয়া ও সংষ্কৃতি জগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে। রাজা ও কুইন কনসর্টের সাথে এখানে যাঁদের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় তাঁদের মধ্যে ছিলেন বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব টাওয়ার হ্যামলেটসের সাবেক ডেপুটি লীডার রাজন উদ্দিন জালাল, সাবেক লীডার হেলাল উদ্দিন আব্বাস ও আনসার আহমদ উল্লাহ; ব্রিটেনে বর্ণসাম্য নিয়ে কাজ করা ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’ রানীমেইড ট্রাস্টের প্রধান নির্বাহী ড. হালিমা, লণ্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি মোহাম্মদ এমদাদুল হক চৌধুরী, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ড. জাকি রেজওয়ানা আনোয়ার, উর্মি মাজহার, প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি নবাব উদ্দিন ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ আব্দুস সাত্তার।
পরিচিতি পর্বে বিভিন্নজনের সাথে অতিথিদের সংক্ষিপ্ত আলাপচারিতায় ব্রিটেনে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামের পাশাপাশি বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন ও শহীদ মিনারের তাৎপর্য, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি বিষয় স্থান পায়। একে একে রাজ-অতিথিকে অভ্যর্থনা জানাতে অধীর আগ্রহ নিয়ে শহীদ মিনারের মূল চত্ত্বরে প্রতীক্ষায় থাকা মালবেরী স্কুলের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলেন রাজা চার্লস ও কুইন কনসর্ট।
উল্লেখ্য, আলতাব আলী পার্কে রাজা এসে পৌঁছবার আগেই সফরের আয়োজক বিবিপিআই, লণ্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব, শহীদ মিনার কমিটি, মালবেরী স্কুল এবং লণ্ডন এন্টারপ্রাইজ একাডেমীর পক্ষ থেকে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। বাঙালীর ভাষার মাসে বাংলা টাউনে ব্রিটেনের রাজার সফর অন্য মাত্রার তাৎপর্য বহন করে বলে অনেকেই মনে করেন।
সফরের আয়োজক ও কুইন কনসর্টকে সঙ্গে নিয়ে রাজা চার্লস এরপর ৪৫ বছর আগে এই এলাকায় বর্ণবাদীদের হামলায় নিহত আলতাব আলী স্মরণে শহীদ মিনারের কাছেই এলম ট্রি-র একটি চারাগাছ রোপণ করেন। এ সময় সঙ্গীত শিল্পী সোহিনী আলম পরিবেশন করেন বিবিপিআইয়ের থিম সং: যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে। এর পর রাজা ও কুইন কনসর্ট তাঁর গাড়িবহর নিয়ে অসবোর্ন স্ট্রিট হয়ে ব্রিক লেইনে বাংলা টাউন গেইটে পৌঁছান। সেখানে রাজদম্পতিকে স্বাগত জানান ব্রিটেনে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাই কমিশনার সাইদা মুনা তাসনীম ও বাংলাদেশী উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ। এখানে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলা টাউন ফটকের কাছে রাস্তার পার্শ্ববর্তী ভবনে ‘মাটির টান’ শীর্ষক দেয়ালচিত্রের অঙ্কন শিল্পী মোহাম্মদ আলী এমবিই এবং বিশিষ্ট ব্রিটিশ বাংলাদেশী ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা ও চ্যারিটি সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। এসময় হাজারো জনতা হাত নেড়ে, তাঁদের সাথে হাত মিলিয়ে ও তাঁদের পু?স্তবক উপহার দিয়ে অতিথিদের শুভেচ্ছা জানান। স্থানীয় ক্রাইস্টচার্চ স্কুলের শিশু শিক্ষার্থীরা ব্রিটেনের জাতীয় পতাকা নেড়ে রাজ অতিথিদের শুভেচ্ছা জানায়। প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী সোনিয়া সুলতানা ও তাঁর দলের বাংলার লোকজ নৃত্য পরিবেশন আর ঢোলক বাদ্য বাজিয়ে রাজা ও কুইন কনসর্টকে ব্রিকলেইনে বরণ করে নেয় হয়।
ব্রিকলেইনে উচ্ছসিত জনতার সাথে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর রাজা যান ঐতিহ্যবাহী গ্রাম বাংলা রেস্টুরেন্টে। একটি নৃত্যদলের প্রদর্শনীর সঙ্গে রাজা ও কুইন কনসোর্ট হেঁটে যান ‘গ্রাম বাংলা’ রেস্টুরেন্ট পর্যন্ত। সেখানে রাজা কথা বলেন সফল বাংলাদেশিদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘ব্রিটিশ বাংলাদেশি পাওয়ার অ্যাণ্ড ইন্সপিরেশন’ (বিবিপিআই) সঙ্গে যুক্ত নারীদের সঙ্গে। পরিচিতি হন বিবিপিআই জামদানী নেটওয়ার্কের সাথে সম্পৃক্ত ব্রিটিশ বাঙালি নারী উদ্যোক্তার সাথে। এসময় প্রপা রেজওয়ানা আনওয়ার কুইন কনসর্টকে বিবিপিআই জামদানী নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের একটি বিখ্যাত জামদানী শাড়ি উপহার দেন। আরেক নারী তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত বইয়ের একটি কপি রাজা চার্লসকে উপহার দেন। গ্রাম বাংলা থেকে রাজকীয় অতিথিরা হেঁটে যান ঐতিহাসিক ব্রিক লেইন জামে মসজিদে। রাস্তার দু’পাশে তখনও হাজারো মানুষ দাঁড়িয়ে রাজদর্শনের অপেক্ষায়। রাজা ও কুইন কনসর্টকে মসজিদে স্বাগত জানান মসজিদের ট্রাস্টিবৃন্দ। এসময় মুসলিম রীতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে মাথায় কাপড় দেন কুইন কনসর্ট। মসজিদের ট্রাস্টিবৃন্দ এবং অন্যান্য অতিথিদের সাথে রাজদম্পতি কুশল বিনিময় করেন। অতিথিদের কাছে মসজিদ ভবনের তিনশ’ বছরের ইতিহাসের কথা তুলে ধরা হয়। এসময় একজন খ্রীস্টান ও একজন ইহুদী ধর্মনেতা সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, বাঙালি পাড়ায় এটি রাজা চার্লসের প্রথম সফর। রাজা হওয়ার আগে রাজকুমার চার্লস ২০০১ সালে পূর্ব লণ্ডনে বাংলাদেশিদের পরিচালিত ইস্ট লণ্ডন মসজিদ পরিদর্শনে এসেছিলেন। এরও আগে আশির দশকে তিনি এই এলাকার একটি গৃহায়ন প্রকল্প উদ্বোধনে এসেছিলেন।
যুক্তরাজ্যে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশির বসবাস পূর্ব লণ্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটসে। এই কাউন্সিলেরই একটি নির্বাচনী ওয়ার্ড বাংলা টাউন। সেখানেই অবস্থিত লণ্ডনের কারি ক্যাপিটালখ্যাত ব্রিক লেন। আর এই বাংলা টাউনকে ঘিরেই রয়েছে এদেশে বাঙালির বর্ণবাদ বিরোধী সংগ্রামের স্মারক আলতাব আলী পার্ক যেখানে মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে আছে বাংলা ভাষার সংগ্রাম, ত্যাগ আর ঐতিহ্যের স্মারক শহীদ মিনার। বাংলা টাউন সফর শেষে করে যান রাজা স্ট্রাটফোর্ডে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অব ইস্ট লণ্ডনে। সেখানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির ১২৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠান এবং চিকিৎসা শিক্ষার একটি নতুন ভবন উদ্বোধনে অংশ নেন।
সফরের পুরোটা সময় জুড়েই তাদের সঙ্গ দেন আয়োজক প্রতিষ্ঠান বিবিপিআই-এর প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি আয়েশা কোরেশী এমবিই জেপি ও কাউন্সিলার আবদাল উল্লাহ।
এক বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, ‘আমাদের কমিউনিটি এবং পূর্ব পূরুষদের অবদানকে তুলে ধরতে রাজার এই ঐতিহাসিক সফর আয়োজন করতে পেরে আমরা গর্বিত এবং আনন্দিত।’
উল্লেখ্য, গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর এলিজাবেথের মৃত্যুর পর প্রথাগতভাবেই তাঁর উত্তরাধিকারী হয়েছেন বড় ছেলে তৃতীয় চার্লস। রাজা হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করলেও আগামী ৬ মে অভিষেক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তাঁর নতুন রাজত্বের আনুষ্ঠানিক অভিষেক উদযাপন করা হবে।