অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত বিদ্যুৎ প্রকল্পই এখন সরকারের গলার কাঁটা। ডলার সংকটে জ্বালানি কিনতে না পারায় মুখ থুবড়ে পড়েছে প্রকল্পগুলো। ৫ জুন থেকে বন্ধ হয়ে যায় বিদ্যুৎ খাতের মেগা প্রকল্প পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। অথচ বিদ্যুৎ উতপাদন বন্ধ থাকলেও গুনতে হচ্ছে ক্যাপাসিটি চার্জ।
।। মুজিব মাসুদ ।।
লন্ডন, ০৫ জুন: অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত বিদ্যুৎ প্রকল্পই এখন সরকারের গলার কাঁটা। জ্বালানি সংকটে প্রকল্পগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে। একই সঙ্গে বন্ধ থাকার পরও গুনতে হচ্ছে ক্যাপাসিটি চার্জ। আর ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে তীব্র দাবদাহ এবং চরম লোডশেডিং। সবমিলে এই মুহূর্তে বিদ্যুৎই সরকারকে বড় ধরনের অস্বস্তিতে ফেলেছে। কতদিনে এই অস্বস্তি দূর হবে, তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না কেউ। তবে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে এই অবস্থা থেকে যেন বের হয়ে আসা যায়, সেই চেষ্টা করছি।’ রোববার সচিবালয়ে তিনি এ কথা বলেন। এতে স্পষ্ট-জ্বালানি সংকটের কারণে চলমান লোডশেডিং আরও কিছুদিন থাকবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিদ্যুতের এই চরম লোডশেডিংয়ে ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে রেন্টাল আর কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টগুলো। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল থেকে আবারও বিদ্যুৎ কেনা শুরু করেছে সরকার। পাশাপাশি তাদের ক্যাপাসিটি চার্জও দিতে হচ্ছে। ডলার সংকটে কয়লা কিনতে না পারায় ৫ জুন থেকে বন্ধ হয়ে যায় বিদ্যুত খাতের মেগা প্রকল্প পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। এতে ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কমে যাবে জাতীয় গ্রিড থেকে। বন্ধ পায়রার জন্যও গুনতে হবে কোটি কোটি টাকার ক্যাপাসিটি চার্জ। খাতসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বড় ধরনের সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে বিদ্যুৎ সেক্টর। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়, পিডিবি ও বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর কতিপয় অসাধু ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রের সঙ্গে জড়িতরাই এই সিন্ডিকেটের মূল হোতা। তাদের হাতেই জিম্মি হয়ে আছেন দেশের মানুষ। আর পুরো সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে আছেন পিডিবির এক অসীম ক্ষমতাধর ব্যক্তি।
এ প্রসঙ্গে রোববার পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। বৃহস্পতিবার বিদ্যুৎ ভবনে তার কার্যালয়ে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। তার অফিসের টিএন্ডটি নম্বরে ফোন করলেই বলা হয়, স্যার মিটিংয়ে আছেন।
অভিযোগ আছে, পিডিবির অদক্ষতা আর অপরিকল্পনায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র। খোদ পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের দেশীয় মালিকানাধীন অংশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, আরও আগে থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে এই অচলাবস্থা তৈরি হতো না। মূলত ক্যাপাসিটি চার্জের ভাগবাঁটোয়ারা, রেন্টাল-কুইক রেন্টাল থেকে বিদ্যুৎ কেনাসহ নানা কারণে সিন্ডিকেট যথাসময়ে কয়লা আমদানিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাবে, ২০০৯ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। বর্তমানে ২৩ হাজার ৪৮২ মেগাওয়াট। ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য মিলে ২৭ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। কিন্তু গ্রাহক চাহিদা গরমকালে ১৪ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার মেগাওয়াট এবং শীতকালে ৮/৯ হাজার মেগাওয়াট। অর্থাৎ উৎপাদনক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। অলস বসিয়ে রাখতে হচ্ছে সচল বিদ্যুৎকেন্দ্র।
একটা সময় ছিল, যখন সারা দেশে বিদ্যুৎ ঘাটতির কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং হতো। বাসাবাড়ি, কলকারখানায় মানুষের দুর্ভোগের শেষ ছিল না। কারণ, উৎপাদন হতো চাহিদার অর্ধেকেরও কম। এখন চিত্র পুরোপুরি উলটো। চাহিদার দ্বিগুণ উৎপাদনক্ষমতা। আর এই অতিরিক্ত উৎপাদনক্ষমতাই এখন সরকারের গলার কাঁটা। উদ্বৃত্ত উৎপাদনক্ষমতা নিয়ে স্বস্তিতে নেই বিদ্যুৎ বিভাগ। অপরিকল্পিতভাবে বিদ্যুৎ শক্তি বৃদ্ধির কারণে মোটা অঙ্কের আর্থিক ক্ষতি গুনতে হচ্ছে সরকারকে। পুরো অর্থই ক্যাপাসিটি চার্জের নামে গেছে কতিপয় বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের পেছনে। গড়ে প্রতিবছর ৫ হাজার কোটি টাকার ওপরে এই ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে। অভিযোগ আছে, কেউ কেউ পুরোনো ও ভাঙাচোড়া বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট বসিয়েও ক্যাপাসিটি চার্জ হাতিয়ে নিয়েছে। একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্ল্যান্ট-ফ্যাক্টর ৮০ শতাংশের ওপরে হলেও অনেক রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বছরে তার সক্ষমতার ১২ শতাংশ, কোনোটি মাত্র ১৬ শতাংশ উৎপাদনে ছিল। এরপরও এসব কেন্দ্র উৎপাদন না করে কূটকৌশলে বছরে ২৪২ কোটি থেকে ৩৬০ কোটি টাকা আয় করেছে। ২০১০ সালের নভেম্বরে চালু একটি রেন্টাল কেন্দ্রের চুক্তির মেয়াদ ছিল ২০১৩ সাল পর্যন্ত। এ সময়ে উদ্যোক্তা শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ আয় করেছে ২৮৩ কোটি টাকা। পরে আরও পাঁচ বছরের জন্য চুক্তি নবায়ন করা হয়। অভিযোগ আছে, চুক্তির সময় কেন্দ্রের সক্ষমতা কৌশলে বেশি করে দেখানো হয়, যাতে ক্যাপাসিটি চার্জ বেশি হয়। চুক্তিতে যে সক্ষমতা দেখানো হয়, সে অনুযায়ী কেন্দ্রগুলো উৎপাদন করতে পারে না। কিন্তু ক্যাপাসিটি চার্জ সরকারকে ঠিকই গুনতে হয়েছে।
জানা যায়, ১৫ বছরে এই সরকারের গচ্চার পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকার বেশি। বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয়েছে ডলারে। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য এটা বড় বোঝা। বিদ্যুৎ বিভাগের দূরদর্শী পরিকল্পনার অভাবে সরকারি কোষাগার থেকে হাজার হাজার কোটি ডলার বেরিয়ে গেছে। তাদের মতে, চাহিদার চেয়ে উৎপাদনক্ষমতা সামান্য পরিমাণ বেশি থাকতেই পারে। কিন্তু তা দ্বিগুণ করে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ অলস বসিয়ে রাখার কোনো যুক্তি নেই।
এদিকে বিশেষজ্ঞদের অভিমত, এ মুহূর্তে বর্তমানে আমদানি করা বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে বিদ্যুৎ খাত। বিদ্যুৎ সেক্টরের রিমোট কন্ট্রোল এখন রপ্তানিকারকদের হাতে। এ মুহূর্তে ১৮শ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ ভারত থেকে আমদানি করা হচ্ছে। শিগগিরই আরও ৮০০ মেগাওয়াট যোগ হবে আদানি পাওয়ার থেকে। এছাড়া ভারত, নেপাল ও ভুটান থেকে আরও ১ হাজার মেগাওয়াট আমদানির প্রক্রিয়া চলছে। তাদের বক্তব্য-পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, যদি কোনো কারণে আমদানি করা বিদ্যুৎ নিয়ে কোনো সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে আরও বড় ধরনের বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে পড়তে হতে পারে দেশকে।
বিদ্যুৎ বিভাগের গবেষণা শাখা পাওয়ার সেল বলছে, আপাতত নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের আর প্রয়োজন নেই। তারপরও নতুন বাজেটে বলা হয়েছে ২০৩০ সাল পর্যন্ত দেশে ৪০ হাজার এবং ২০৪১ সাল নাগাদ বিদ্যুৎ উৎপাদনে পরিকল্পনা আছে ৬০ হাজার মেগাওয়াট। বর্তমানে সরকারি খাতে ৪ হাজার মেগাওয়াটের ১১টি প্রকল্প, যৌথ উদ্যোগে ৩ হাজার ১০৮ মেগাওয়াটের ২টি এবং বেসরকারি খাতে ১২ হাজার ৯৮ মেগাওয়াটের ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। এছাড়া একের পর এক রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তিও নবায়ন করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বেশির ভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকরা প্রভাবশালী ও সরকারি দলের নেতা। যার কারণে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও নানা ছুতোয় কেন্দ্রগুলো নবায়ন করা হচ্ছে।
কনজুমার অ্যাসোসিয়েশনের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপকশামসুল আলম বলেন, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে রেন্টাল ও কুইক রেন্টালসহ শতাধিক প্রকল্প উৎপাদনে আনা হয়। তারপরও এগুলো থেকে মানসম্মত বিদ্যুৎ মেলেনি। দলীয় ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হয়েছে। চাহিদা না থাকায় এসব কেন্দ্র প্রায়ই বন্ধ থাকে। বসে থেকে বছর বছর ক্যাপাসিটি পেমেন্ট নিচ্ছে। আবার সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রেখে বেসরকারি কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে। ব্যয়বহুল এসব প্রকল্প থেকে বেরিয়ে আসার কথা থাকলেও নানা অজুহাতে রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের চুক্তি বারবার নবায়ন করা হচ্ছে। সরকারঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের বাড়তি সুবিধা দিতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, অপ্রয়োজনীয় কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে ভর্তুকির টাকা বিদ্যুৎ খাতের টেকসই উন্নয়নে কাজে লাগানো সম্ভব। অধ্যাপক শামসুল আলম আরও বলেন, বিভিন্ন মহলের স্বার্থজনিত নানা কারণে বিদ্যুৎ খাতে এ অবস্থা। তিন বছরের চুক্তিবদ্ধ রেন্টাল প্রকল্প ১৫ বছরের জন্য ব্যবসা করার সুযোগ পাচ্ছে। ফলে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বেড়েই চলেছে।
বাংলাদেশের বৈদেশিক দেনাবিষয়ক কর্মজোটের (বিডবিøউজিইডি) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের বিদ্যুতের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খুবই নাজুক। দেশের এক-তৃতীয়াংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। বসে বসে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে টাকা আদায় করা এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো অর্থনীতির গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপর সরকার কোম্পানিগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়ে আসছে। ফলে বিদ্যুৎ খাতে বিশাল অর্থনৈতিক বোঝা বহন করতে হচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, এত বিশাল ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধের পরও সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে উৎপাদনে আসার জন্য মোট ৪৯ হাজার ৩৯২ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন আরও ৪৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দিয়েছে। এর অধিকাংশই গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। যদিও পেট্রোবাংলা বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাসের মাত্র ৫৫ দশমিক ৩০ শতাংশ সরবরাহ করতে সক্ষম।